ক্রীড়ার ইতিহাস বলে ক্রিকেট ও রাজনীতি নতুন বিষয় নয়। কিন্তু দেশাত্মবোধের পাচন দিয়ে গণ-উন্মাদনা সৃষ্টি করার অর্থ টিমের প্রতিটি খেলোয়াড় এবং প্রত্যেক নাগরিকের উপর এক ধরনের রাষ্ট্রীয় স্নায়ুবিক চাপ সৃষ্টি, যা কাম্য নয় আদৌ! লিখলেন জয়ন্ত ঘোষাল।
খেলায় হার-জিত আছে। বিশ্বকাপ কেন ভারত পেল না, তার ময়নাতদন্ত ক্রীড়া সাংবাদিকরা করছেন, এমনকী কোচ হিসাবে রাহুল দ্রাবিড়কে সরানো উচিত কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ক্রিকেট খেলতেও পারি না, ক্রিকেট-বোদ্ধা নই, তাই ক্রিকেট নিয়ে কোনও আলোচনাই করব না। কিন্তু ক্রিকেট-প্রেম ভারতে ক্রিকেট জাতীয়তাবাদে পর্যবসিত হোক সেটা চাই না। ক্রিকেট জাতীয়তাবাদ বর্জনীয়।
কথাটা বলা অবশ্য সহজ, কিন্তু এই ‘জাতীয়তাবাদ’ যদি রাজনীতির উপজীব্য হয়, সমাজের কথা তো পরে আসবে, তার আগে রাষ্ট্রই যদি এই ক্রিকেট পুজোকে জাতির পুজোয় পরিণত করে ১৪০ কোটি মানুষকে সব ভুলিয়ে নিমজ্জিত রাখতে চায় গণ হিস্টিরিয়ায়, তবে সে বড় ভয়ংকর। ক্রীড়ার ইতিহাস বলে, ক্রিকেট ও রাজনীতি নতুন বিষয় নয়। বোরিয়া মজুমদার তাঁর ‘ক্রিকেট ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’ (১৭৮০-১৯৪৭) গবেষণা গ্রন্থে দেখিয়েছেন কীভাবে ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন ভারতে স্বাধীন ক্রিকেটের সামাজিক পরিসর তৈরি হয়েছে।
[আরও পড়ুন: বৈঠকে ভারত-বাংলাদেশের বিদেশ সচিব, উত্তর-পূর্বে সন্ত্রাসের মেঘ দেখছে দিল্লি?]
আগে তো ভারতের ক্রীড়াতেও এত বেশি ক্রিকেট ‘অবসেশন’ ছিল না। ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুর’-এর বিশিষ্ট দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ ঐতিহাসিক রণজয় সেন ‘নেশন অ্যাট প্লে: আ হিস্ট্রি অফ স্পোর্ট ইন ইন্ডিয়া’ শীর্ষক সুবিস্তৃত গবেষণার আকর গ্রন্থে দেখিয়েছেন, প্রাচীন পৃথিবীতে ৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে গ্রিক দেশে অলিম্পিয়ায় প্রথম খেলাধুলোর চর্চা শুরু হয়। রণজয় ভারতের ক্রীড়া ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে মহাভারতের যুগে অসিযুদ্ধ অথবা কুস্তির কথা বলেছেন। এই কারণেই ১৯৬১ সালে ‘অর্জুন’ পুরস্কার ও ১৯৮৫ সালে ‘দ্রোণাচার্য’ পুরস্কার চালু হয়।
সুলতান আমলে সেন্ট্রাল এশিয়া থেকে পোলো খেলা আসে ভারতে। ভারতের প্রথম মুসলমান সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবক পোলো খেলতে গিয়ে ঘোড়ার আঘাত পেয়ে মারা যান। ব্রিটিশ আমলেই পোলো অভিজাত খেলায় রূপান্তরিত হয়। তাদের সুবাদে ভারতে আসে হকি। বিখ্যাত হকি প্লেয়ার ধ্যানচঁাদ তৎকালীন ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া সেনাবাহিনীর অধীনে পাঞ্জাব রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে হকি খেলায় মনোবনিবেশ করেন। অনেকেই হয়তো জানেন না, ফুটবলের পাশাপাশি ১৯০৮ সালে ‘বেঙ্গল হকি অ্যাসোসিয়েশন’-ও গঠিত হয়। পরবর্তীতে ফুটবল কীভাবে বাংলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলা হয়ে দঁাড়ায় তা তো জানা। আবার জাতীয় স্তরে অন্য খেলাদের পিছনে ফেলে কীভাবে ক্রিকেট জাতীয় স্তরে প্রধান খেলা হয়ে উঠল তা-ও অজানা নয়।
[আরও পড়ুন: শেষ পর্যায়ে হঠাৎ বিপত্তি! উত্তরকাশীতে ফের থমকে গেল উদ্ধারকাজ, উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রী]
ক্রমেই ক্রিকেট নিছক ২২ গজের খেলা হয়ে আটকে থাকল না আর। হয়ে উঠল পুঁজিবাদের এক অন্যতম রমরমে ব্যবসা। ১৭৮৭ সালে মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব থেকে যাত্রা শুরু করে এখন ২০২৩ সালের ক্রিকেটে কত ব্যাপক পরিবর্তন। টিভি ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যুগে ক্রিকেট পেল রাজকীয় জনপ্রিয়তা। জন্ম হল টিআরপির। আর সেই টিআরপি নিয়ে এল প্রচুর রাজস্ব। অর্থাগম যত বাড়ল, ততই বাড়তে লাগল ক্রীড়া সংস্থাগুলোর ক্ষমতা। রাজনৈতিক নেতারাই বা কেন চুপ করে বসে থাকবে? তাদের ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ এল বিসিসিআই ও আইসিসিতে। বিজ্ঞাপন-বিপণন শিল্পও যোগ দিল এই রাজস্ব বৃদ্ধির আসরে।
সময় বদলাল। মানুষের হাতে সময় কমল। বাড়ল ব্যস্ততা। চার-পঁাচদিন ধরে টেস্ট ম্যাচ দেখার সময় আর নেই। অতএব উপায় ওয়ান ডে ম্যাচ। এরপর আইপিএল। ক্রিকেট ফরম্যাট নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও তো কম হল না। পঁাচদিনের টেস্ট ম্যাচ আর ওয়ান ডে ম্যাচের পর টি-২০ হয়ে গেল সবচেয়ে জনপ্রিয় ফরম্যাট। দেখা গেল পৃথিবীজুড়ে মানুষ এই খেলাটাই সবচেয়ে বেশি দেখছে। বিজ্ঞাপন শিল্পেরও বড় ভূমিকা সেখানে। ক্রিকেটারদেরও রোজগার বাড়ল, তারা নানা পণ্যের মডেল হয়ে আরও অর্থাগমের সুযোগ পেল। শুধু তো ক্রিকেটার নয়, বলিউড ও কর্পোরেট দুনিয়াও শামিল হল এই ক্রীড়া-ব্যবসায়।
অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন বিশ্বকাপ বিজয়ী কোচ জন মার্শাল বুকাননেরর বিখ্যাত বই ‘দ্য ফিউচার অফ ক্রিকেট; রাইজ অফ টি-টোয়েন্টি’। তিনি লিখছেন, ‘হোয়েন মানি টকস্ ক্রিকেট লিসেন্স’। টাকার এই কথা বলার সঙ্গে এবার মিশল জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমের রেসিপি। মানুষ যা ভালবাসে করে, রাজনেতারা প্রকাশে্য তারই সমর্থনে এগিয়ে এসে জনসমর্থন আদায় করে। এজন্য নেহরু ক্রিকেট খেলার ছবি তুলেছেন, রাজনেতারা ফুটবলে শট মারলে তা প্রচারিত হয়। এসব নতুন কিছু নয়। এমনকী ভারত-পাকিস্তান বিরোধের রাজনীতিতেও বারবার ক্রিকেট এসেছে। ইন্দিরা জমানায় পাক রাষ্ট্রপ্রধান জিয়াউল হক ভারত-পাক ক্রিকেট ম্যাচকে কূটনীতির অস্ত্র করে তোলেন। আবার, মুম্বই স্টেডিয়ামে ভারত-পাক ম্যাচ হওয়ার আগে শিবসেনা প্রধান বাল ঠাকরে পিচ খেঁাড়ার হুমকি দেন। তখন অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু রাজনীতি বদলাতে বদলাতে এখন এই ক্রিকেট পুজোকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে। এজন্য গেরুয়া ইউনিফর্ম পরে ভারতীয় খেলোয়াড়রা ফাইনালের আগে ম্যাচ প্র্যাকটিস করলেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভারতের জয়ের আশাকে যেন দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হিসাবে গণ্য করা হল। টিম ইন্ডিয়ার একাদশ খেলোয়াড় যেন যোদ্ধা।
টি-২০ রেজিমেন্ট। ‘ইন্ডিয়া-ইন্ডিয়া’, ‘ভারত-ভারত’, ‘ভারত মাতা কি জয়’– এই মন্ত্র ধ্বনিত হল দেশজুড়ে। এতে রাজনীতির একটা মস্ত বড় সুবিধা হল, আমজনতা দৈনন্দিন সমস্যা ভুলে যেতে গিয়ে মেতে উঠল ক্রিকেট-যুদ্ধে। উত্তর কাশীর সুড়ঙ্গে ৪১জন মজুর প্রায় এক পক্ষকাল বন্দি থাকল। দিল্লিতে এমন দূষণ হল যে, স্কুল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হল সরকার। কাশ্মীরে ঘটে গেল জঙ্গি সন্ত্রাসের ঘটনা। এদিকে তামিলনাড়ুতে রাজ্যপাল-মুখ্যমন্ত্রী বিতর্ক; মূল্যবৃদ্ধি-মুদ্রাস্ফীতি বেকারত্ব-কর্মহীনতা– সব জ্বলন্ত ইসু্য আমরা ভুলে গেলাম। ক্রিকেট পুজো নিয়েই মাতিয়ে রাখল শাসক-প্রভুরা। সময় এসেছে এই ক্রিকেট জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করার। এই দেশাত্মবোধের পাচন দিয়ে গণ-উন্মাদনা সৃষ্টি করা মানে টিমের প্রতিটি খেলোয়াড়ের উপর এক ধরনের রাষ্ট্রীয় স্নায়ুবিক চাপ সৃষ্টি। তা খেলার মানের উপরও প্রভাব ফেলতে পারে। বহুত্ববাদী ভারত যেন একদেশদর্শী ক্রিকেট জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রে পরিণত না হয়।
(মতামত ব্যক্তিগত)