‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’-র (NCRB) ‘ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া ২০২১’ রিপোর্ট বলছে, জাতিবিদ্বেষী অপরাধ সংঘটনের নিরিখে সারা দেশের মধ্যে ১৩,৪১৬টি অপরাধের নজির নিয়ে শীর্ষে উত্তরপ্রদেশ, ঠিক পরেই আছে রাজস্থান, অপরাধের সংখ্যা ৭,৫২৪। এর মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ধরনের হিংসার শিকার স্কুলপড়ুয়ারা। ফলে, সংখ্যালঘু ছেলেমেয়েদের স্কুল-ছুট হওয়ার সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। কলমে ঋত্বিক মল্লিক
এপ্রিল নয়, স্বাধীনতার মাস হিসাবে চিহ্নিত আগস্টকেই বরং এখন বলতে পারি দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে ‘দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ’। কয়েক দিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে চলেছে উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগরের একটি ভিডিও। মাত্র সাত বছর বয়সি এক মুসলিম ছাত্রকে চড় মারার জন্য বাকি ছাত্রদের জনে জনে নির্দেশ দিচ্ছেন এক হিন্দু শিক্ষিকা, চড়ের জোর মনোমতো না হলে আবার পরের জনের ডাক পড়ছে, আরও জোরে চড় কষানোর জন্য। মার খেয়ে ছোট্ট ছেলেটার লাল হয়ে যাওয়া মুখ দেখে দাওয়াই দিচ্ছেন, এবার কোমরে মার লাগাও। ‘জিতনে ভি মহমেডান বচ্চে হ্যায়’- এভাবেই নাকি শায়েস্তা করতে হবে তাদের!
শুধু মুজফ্ফরপুরের ঘটনাই নয়, গত বছরের ২৫ আগস্ট উত্তরপ্রদেশে সভাজিৎ দীক্ষিত নামে জৌনপুরের এক প্রাইমারি স্কুলশিক্ষক ঘেরাও হওয়ার পর জানা গেল, দলিত বাচ্চাদের নাকি তিনি ডাকেন কখনও ‘চামার’, কখনও-বা ‘নালি কা কিড়া’ বলে! ঠিক চারদিন পর, ২৯ আগস্ট আবারও উত্তরপ্রদেশেরই বরাবাঁকিতে ক্লাস টু-র পড়ুয়া দলিত ছাত্রের হাত পুড়িয়ে দেওয়ার নালিশ এল শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। দলিত বাচ্চাকে পাতের ছোঁয়া বাঁচিয়ে আলগোছে গরম খাবার ছুড়ে দিতে গেলে একটু-আধটু পুড়ে তো যেতেই পারে! গত বছর শুধু আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর- একমাসে উত্তরপ্রদেশ আর রাজস্থান মিলিয়ে এরকম ১১টি ভয়ংকর ঘটনা উঠে এসেছে। তবে, সবকিছুকেই ছাড়িয়ে গিয়েছে গত বছর ২০ জুলাইয়ের ঘটনা। নয় বছর বয়সি ইন্দর মেঘওয়াল উচ্চবর্ণের মাস্টারমশাইদের জলের জায়গা ধরেছিল বলে স্কুলের প্রিন্সিপাল এমন চড় কষাল যে, মরেই গেল ছেলেটা!
[আরও পড়ুন: দাগী নেতাদের ভাতায় কোটি টাকা খরচ, অথছ বিজ্ঞানীদের ঝুলি খালি!]
‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’-র (NCRB) ‘ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া ২০২১’ রিপোর্ট বলছে, জাতিবিদ্বেষী অপরাধ সংঘটনের নিরিখে সারা দেশের মধ্যে ১৩,৪১৬টি অপরাধের নজির নিয়ে শীর্ষে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ, ঠিক পরেই আছে রাজস্থান, অপরাধের সংখ্যা ৭,৫২৪। এর মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ধরনের হিংসার শিকার স্কুল-পড়ুয়ারা। প্রতিবাদ করার জোর যাদের নেই, আগ্রাসন তাদের উপরেই নেমে আসছে সবচেয়ে বেশি। শুধু উত্তরপ্রদেশের দিকেই যদি তাকাই, একদিকে আওরাইয়া-য় সাধারণ ছাত্রদের জন্য বরাদ্দ শৌচাগার ব্যবহার করায় ১৮ ঘণ্টা ধরে সেই শৌচাগারেই দলিত ছাত্রকে আটকে রাখল শিক্ষক, ফিরোজাবাদে আর-এক শিক্ষক আট বছরের দলিত ছাত্রকে মেরে তার ডানহাতটাই দিল ভেঙে, বালিয়ার স্কুলে জনৈক কৃষ্ণমোহন শর্মা আবার শিক্ষক হওয়ার সুবাদে লোহার রড, ঝাঁটা দিয়ে পিটিয়ে একেবারে গলা টিপে ধরল ক্লাস সিক্সের পড়ুয়ার- অপরাধ, সে তার বাইকে হাত দিয়েছিল! প্রত্যেকটি ঘটনাই কিন্তু ঘটছে তথাকথিত ‘সেফ স্পেস’-এ, স্কুলের গণ্ডিতেই।
বেশিরভাগ স্কুলে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, ছাত্ররা মোটেই একসঙ্গে মিড-ডে মিল খায় না। আমেঠি, মইনপুরি, উদয়পুর- বিভিন্ন এলাকা থেকে বারবার অভিযোগ আসছে, ভিন্ন ধর্মের ছাত্রদের আলাদা বসিয়ে খেতে দেওয়া হয়। এমনকী, দলিত বা নিম্নবর্ণ বা ভিন্ন জাতের কেউ রান্না করলে শিক্ষকদের কড়া তত্ত্বাবধানে সেই খাবার পুরোটা ফেলে দেওয়া হচ্ছে, এমন নজিরও প্রচুর! সত্যিই তো, সমাজরক্ষার কারিগর তঁারা, জাতরক্ষার এমন মহৎ দায় পালন না করলে কি চলে!
[আরও পড়ুন: লালকেল্লা থেকে স্বপ্নের বেসাতি মোদির, দেশবাসী মোহিত হবে কি?]
আশঙ্কার বিষয়, স্কুলগুলোয় ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছে সংখ্যালঘু ছেলেমেয়েরা, আতঙ্কের আবহ ঘিরে ধরছে তাদের। কচি মগজগুলো জুঝে উঠতে পারছে না এই বিজাতীয় ট্রমার সঙ্গে, বেড়ে চলেছে স্কুল-ছুটের তালিকা। এ বছরেরই ৮ জুন ‘অল ইন্ডিয়া সার্ভে অন হায়ার এডুকেশন’ (AISHE) জানিয়েছে, জম্মু-কাশ্মীর, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, গুজরাত, বিহার, কর্নাটকের মতো রাজ্যগুলোতেও স্কুলশিক্ষায় মুসলিম ছাত্রদের সংখ্যা কমেই চলেছে। শুধু উত্তরপ্রদেশেই মুসলিম ছাত্র ভর্তির হার গত বছরের চেয়ে একধাক্কায় কমে গিয়েছে ১৬ শতাংশ। গুজরাতে দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ডের পরীক্ষায় বসার জন্য নাম নথিভুক্ত করতে হলে যে ফর্ম ভরতে হয় ছাত্রছাত্রীদের, সেখানে ধর্ম লেখার জায়গায় রয়েছে ঠিক দু’টি বিকল্প- মুসলিম আর অন্যান্য। বারবার অভিযোগ করেও এই আপত্তিকর শ্রেণিবিভাজন উপড়ে ফেলা যায়নি কিছুতেই। যাবেই বা কী করে? একেবারে সরকারি মদতে, গত বছর উত্তরপ্রদেশেরই চৌধুরী চরণ সিংহ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের পাঠ্যক্রমে ঢুকে পড়েছিল রামদেবের বই ‘যোগ চিকিৎসা রহস্য’, যোগী আদিত্যনাথের ‘হঠযোগ স্বরূপ ও সাধনা’! ঠিক কেন যে মুসলিম ছাত্রদের আলাদা করে চিহ্নিত করার দরকার পড়ে, এই আশ্চর্য সিলেবাস চয়নের মধ্যে দিয়েই তো সেই উদ্দেশ্য স্পষ্ট। গত বছর দুয়েকের মধ্যেই কেন্দ্রীয় বোর্ডের সিলেবাস থেকে গণতন্ত্র ও বৈচিত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, ইসলামের উত্থান, অ্যাফ্রো-এশিয়ান অঞ্চলসমূহ এবং ভারতে মুঘল আমলের ইতিহাস বাদ দেওয়ার প্রস্তাব ওঠে। এই ছাঁটতে চাওয়া অংশগুলো খেয়াল করলে বোঝা যায়, পাঠক্রমের মধ্যেই কীভাবে পোষিত হচ্ছে অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণা। পরে দশম শ্রেণির সমাজবিজ্ঞান বই থেকে বাদ পড়ল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িকতা এবং রাজনীতি’ অধ্যায়ে ফৈয়জ আহমেদ ফৈয়জের দু’টি কবিতার নির্বাচিত অংশ। অথচ সিলেবাসই তো অস্ত্র! তুলনায় এই রাজ্যের স্কুল সিলেবাস আর পাঠ্যপুস্তকের দিকে তাকালে দেখা যাবে, যেখানেই সুযোগ পাওয়া গিয়েছে, সেখানেই বুনে দেওয়া হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার বীজ। এমনকী, টেক্সটের মধ্যে একাধিক কাল্পনিক চরিত্র এলেই, প্রায় সবসময় সংখ্যাগুরু নামের পাশে এসেছে সংখ্যালঘু নাম। নিশ্চিতভাবে মনে হতে পারে এই পদ্ধতিটি অনেকটাই আরোপিত, কিন্তু সিলেবাস আর পাঠ্যপুস্তক তৈরির সময় আমাদের মনে হয়েছিল, এই পরিস্থিতিতে এর কোনও ‘বিকল্প’ নেই।
কিন্তু আগে তো ওরা বাঁচুক, তবে তো খুলবে বই, তবে তো জানবে এত কথা! তাই এসব চুলচেরা বিবরণী দেওয়ার স্থৈর্যও আর রাখা যাচ্ছে না ওই মার-খাওয়া ছোট্ট নিষ্পাপ রোগা শরীরগুলো দেখলে, কিছুতেই শান্তি দেয় না মুখগুলো। এমনকী, নিজেকে ‘শিক্ষক’ বলতেও লজ্জা করে এখন।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক স্কুলশিক্ষক
ritwickmallick@gmail.com