shono
Advertisement
Dietary Habits

আমিষ, না, নিরামিষ– জিজ্ঞাসে কোন জন!

মতের সঙ্গে না মিললে দু’-ঘা বসিয়ে দেওয়া কাজের কথা নয়।
Published By: Biswadip DeyPosted: 05:06 PM Dec 12, 2025Updated: 05:06 PM Dec 12, 2025

কী লিখবেন, কী লিখবেন না– তা যেমন বলপ্রয়োগের বিষয় নয়; তেমনই কী খাবেন আর কী খাবেন না– তাও জোরাজুরি পছন্দ করে না। ঋগ্বেদে গোমাংস ভক্ষণের কথা আছে। আবার, ঋগ্বেদেই পশুবলির বিরোধিতা করা হয়েছে। পরস্পরবিরোধী এরকম দৃষ্টান্ত মহাভারতেও ভরপুর। এত বড় দেশে খাবার থালা বৈচিত্রময় হবে না, তাই তো অস্বাভাবিক। মতের সঙ্গে না মিললে সযৌক্তিক তর্ক হোক, দু’-ঘা বসিয়ে দেওয়া কাজের কথা নয়। লিখছেন সুচেতা বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement

খাদ্যাভ্যাস নিয়ে সংশয় ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে– বলা শক্ত। তবে কী খাবে আর কী খাবে না, এই নিয়ে বিতর্ক বোধ করি মানবসভ্যতার শেষ দিন পর্যন্ত চলতেই থাকবে। বিশেষ করে ভারতের মতো বিশাল দেশে, যেখানে খাবারের থালা মানুষের ধর্ম, সংস্কৃতি, প্রাদেশিক পরিচয়, ঐতিহ্য, রাজনীতি, পুষ্টি-অপুষ্টি– সবের সাক্ষ্য বহন করে, সেখানে প্রতিদিনের খাবারও শেষ পর্যন্ত শুধুমাত্র ‘আপরুচি’ থাকে না। আর আমিষ-নিরামিষ বিতর্ক, সেও কিছু নতুন নয়।

বৈদিক যুগের কথাই ধরুন। বৈদিক সভ্যতায় মাংস, এমনকী গোমাংসও যে প্রধান খাদ্য ছিল, বহুল চর্চার ফলে তা আপনাদের জানা। রামচন্দ্র বনবাসে গিয়ে শিকার করে হরিণের মাংস পুড়িয়ে খেয়েছেন, মহাভারতের ক্ষত্রিয় রাজারাও মাংস খেতেন– কোনও সন্দেহ নেই। আপনি ভাবছেন, বাহ, এই তো প্রাচীন ভারতে মানুষজন ইচ্ছেমতো আমিষ খেত, কেউ বাধা দিত না। ব্যাপারটা অত সহজও ছিল না।

ঋগ্বেদের মন্ত্রে একদিকে ইন্দ্র যজ্ঞীয় আহুতিতে পনেরো-কুড়িটা ষঁাড়ের মাংস চাইছেন– সোমরসের সঙ্গে একাই খেয়ে নেবেন বলে। যাজ্ঞবল্ক্যর মতো ব্রহ্মবাদী ঋষি নরম তুলতুলে সুসিদ্ধ গোমাংসর প্রতি তঁার রুচি জানাচ্ছেন স্পষ্ট ভাষায়। অতিথিসেবায় গো-বধ করতেই হবে, মধুপর্কও হবে সমাংস– এই ভাবনায় একদিকে
অতিথির পর্যায়বাচক শব্দ হয়ে দঁাড়াচ্ছে ‘গোঘ্ন’। অন্যদিকে, সেই একই ঋগ্বেদে অন্যত্র গোরুকে ‘অঘ্ন্যা’ বলা হচ্ছে। অন্য পশুবলির প্রথম বিরোধিতাও বেদমন্ত্রেই উচ্চারিত হচ্ছে।
মহাভারতের ‘শান্তিপর্ব’-য় মাংস খাওয়ার ব্যাপারে ওকালতি করা হচ্ছে রীতিমতো। বলা হচ্ছে– মাংস হল সেরা পুষ্টিকর খাবার, কাজেই অন্যান্য শস্যর সঙ্গে মাংসও খেতে হবে বইকি। ছাগল, ভেড়া, গরু, নানারকম পাখি– সবরকম মাংসই খাওয়া যাবে–

অজশ্চাশ্বশ্চ মেষশ্চ গৌশ্চ পক্ষিগণাশ্চ যে।
গ্রাম্যারণ্যাশ্চৌষধয়ঃ প্রাণস্যান্নমিতিশ্রুতিঃ॥

কে বলছেন এই কথা? স্বয়ং সাংখ্যদর্শন প্রণেতা কপিল মুনি, ভগবদ্গীতায় স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণ যঁার নাম উল্লেখ করছেন নিজের স্বরূপতায়– সিদ্ধানাং কপিলো মুনিঃ। ভাবছেন তাতে আমিষ-নিরামিষ বিতর্ক শেষ হল চিরতরে? একেবারেই না। মহাভারতেরই ‘অনুশাসন পর্ব’-য় দীর্ঘ আলোচনা আছে মাংসভোজন ত্যাগ করার পক্ষে। মহর্ষি মার্কণ্ডেয়র মত– উদ্ধার করে, যুধিষ্ঠিরকে যা বোঝাচ্ছেন ভীষ্ম পিতামহ, তার সঙ্গে জৈন বা বৌদ্ধ অহিংসার ভাবনার মিল আছে অনেকখানি। বলা হচ্ছে– প্রাণীহত্যা মহাপাপ, কাজেই প্রাণীহত্যা না করাই ঠিক, মাংসভক্ষণ ত্যাগ করাই পরম ধর্ম– হত্বা জন্তুং ততো মাংসং তস্মাদ্দোষস্তু ভক্ষণে। কত পুণ্যাত্মা রাজা মাংসাহার ত্যাগ করেছিলেন, পুরোপুরি বা ব্রত উপলক্ষে– তার দীর্ঘ তালিকা দিয়ে সেসব রাজার প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছে মহাভারত। এমনকী, যজ্ঞে পশুবলি দেওয়া উচিত না উচিত নয়– তা নিয়েও লম্বা বিতর্ক চলেছে। আর সেই মতপার্থক্য দেবতার অভিশাপ, ব্রাহ্মণ-পুরোহিতের অসন্তোষ, রাজনৈতিক সংকট ডেকে এনেছে– এমন উদাহরণও পাওয়া যাবে।

তবে পুরাণের ভাবনায় বিষয়টা একটু সহজ হয়ে গিয়েছে। গল্প আছে, একবার রাজা ইক্ষ্‌বাকু, কুলপুরোহিত বশিষ্ঠ ও রাজপুত্র বিকুক্ষিকে পাঠিয়েছেন পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধের জন্য মাংস সংগ্রহ করতে। বিকুক্ষি সারাদিন ঘুরে শ্রাদ্ধের রান্নার জন্য পশুশিকার করেছেন, কিন্তু এই পরিশ্রমে তঁার নিজেরই বড় খিদে পেয়েছে। তখন তিনি ভাবলেন, এই এত মাংসের থেকে একটুখানি যদি এখন খাই, তাতে আর ক্ষতি কী? কেউ তো জানতে পারবে না! সাতপঁাচ ভেবে একটা ছোট খরগোশ কেটে পুড়িয়ে খেলেন বিকুক্ষি, আর বাকি মাংস নিয়ে এলেন রাজবাড়িতে। কিন্তু বশিষ্ঠ তপস্যার বলে জেনে গেলেন ঘটনা। ইক্ষ্‌বাকু আর বশিষ্ঠ বিকুক্ষিকে প্রচণ্ড তিরস্কার করলেন, শেষ পর্যন্ত তঁাকে ত্যাজ্যপুত্র হতে হল, আর শশ বা খরগোশ খেয়েছিলেন বলে তঁার নামই হয়ে গেল শশাদ। এই গল্পের মাধ্যমে পুরাণ সংযমের বার্তা দিচ্ছে, বোঝাচ্ছে বৃথা মাংসভোজন করা যাবে না। ইচ্ছা হল আর খানিকটা মাংস খেয়ে নিলাম, তা হবে না। শিকার করে খেতে গেলেও তা আগে নিবেদন করতে হবে দেবতা কিংবা পিতৃপুরুষকে, তারপর সেই প্রসাদ স্বচ্ছন্দে খাওয়া যাবে যেমনটা রামচন্দ্র করেছিলেন বনবাসে। কূর্মপুরাণ তো আরও একধাপ এগিয়ে বলেছে– শ্রাদ্ধে নিবেদিত মাংস না খাওয়াটাও কিছু কম অপরাধ নয়। যদি না খাও, পরের জন্মে জন্মে বারবার তুমি নিজেই পশু হয়ে জন্মাবে–

যোনাশ্নাতি দ্বিজো মাংসম্‌ নিযুক্তঃ পিতৃকর্মণি।
সপ্রেত্য পশুতাং যাতি সম্ভবানেকবিংশতিম্‌॥

অন্যদিকে, বৌদ্ধ এবং জৈনরা প্রাণীহত্যার কঠোর বিরোধিতা করেছে, নিরামিষ খাবারের পক্ষে সওয়াল করে। যেসব জনপদে বৌদ্ধ রাজারা রাজত্ব করতেন, সেখানে নিরামিষ খাবারের বাড়বাড়ন্ত রাজার আদেশেই ঘটে যেত। ফলে পরবর্তী সময় খানিক বৌদ্ধ-জৈন প্রভাবে, খানিক পুরাণ-স্মৃতির বিধান মেনে উত্তর ভারতে নিরামিষ খাওয়ার প্রবণতা শেষ পর্যন্ত বেড়েছে। ত্রেতাযুগের নল রাজার নামে চললেও ‘পাকদর্পণম্‌’ মোটামুটি দ্বাদশ শতাব্দীর গ্রন্থ। খুব যে বৃহৎ গ্রন্থ তা নয়।

তবে সেখানেও মাত্র তেইশ-চব্বিশটা শ্লোকে মাংস নিয়ে আলোচনা করেই বাকি অংশে যেভাবে শাক-সবজি, ডাল-ভাতের আলোচনা হয়েছে তাতে বোঝা যায়, সেকালের একটা বড় অংশের মানুষ ক্রমশ নিরামিষ খাবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। শ্রাদ্ধে মাংসভোজনও অনেক কাল উঠে গিয়েছে। বাঙালির ‘স্টেপ্‌ল ফুড’ মাছ-ভাত। তবু মধ্যযুগে নিরামিষের বাড়াবাড়ির একটা কারণ যেমন বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলনের প্রসার, এবং আর-একটা কারণ বোধহয় আমিষভোজী মুসলমান শাসকের থেকে খানিকটা পৃথক হয়ে ওঠার চেষ্টা। কথাটা নিঃসন্দেহে বিতর্কিত, তবু না বললেও নয়। বঙ্কিমচন্দ্র আমার অন্যতম প্রিয় ঔপন্যাসিক, খাদ্যাভ্যাসে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার একখানা মোগলাই উদাহরণ আমি বঙ্কিমের ভাষাতেই তুলে দিতে চাই– “ঔরঙ্গজেব। দিল্লীর বাদশাহর অদেয় কিছু নাই। তাহার কাছে প্রার্থনীয় তোমার কি কিছুই নাই? নির্মল।... আমরা হিন্দু, জগতে কেবল ধর্মকেই ভয় করি, ধর্মই কামনা করি।... দিল্লীর বাদশাহর সাধ্য কি যে, আমার কাম্য বস্তু দিতে পারেন কি লইতে পারেন? তখন তিনি একজন তাতারীকে আদেশ করিলেন, ‘যা! বাবুর্চিমহল হইতে কিছু গোমাংস আনিয়া, দুই তিনজনে ধরিয়া ইহার মুখে গুঁজিয়া দে।

নির্মল তাহাতেও টলিল না। বলিল, ‘জানি আপনাদিগের সে বিদ্যা আছে। সে বিদ্যার জোরেই এই সোনার হিন্দুস্থান কাড়িয়া লইয়াছেন।... শুনেন নাই কি যে, রাজপুতের মেয়ে বিষ না লইয়া এক পা চলে না?’”
খাদ্য-রাজনীতিতে এই হিন্দু-মুসলমান বিবাদের আরম্ভ। মধ্যযুগ থেকে হাল আমল– বাংলা সাহিত্যে এমন উদাহরণ অনেক। আবার আকবর বাদশাহর নিরামিষাশী হয়ে ওঠার দৃষ্টান্তও আমাদের ইতিহাসে আছে।
সব মিলিয়ে খানিক ভয়, খানিক সংস্কার বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে যে জগাখিচুড়ি তৈরি হয়েছে, সে বড় বিচিত্র। এই কিছু বছর আগে পর্যন্ত মাছ ঢুকলেও মুরগি-পেঁয়াজ-রসুন অনেক বাড়িতেই ঢুকত না। আমার ছোটবেলায় বিয়ের অনুষ্ঠানে মুরগি-পেঁয়াজের বৈপ্লবিক অনুপ্রবেশের ঘটনায় আত্মীয়দের অনুষ্ঠান বয়কটের ঘটনাও দেখেছি। তাতে যে কী পরিমাণ খাবার নষ্ট হয়েছিল, সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার পরম বৈষ্ণব কিন্তু কঠোর নিরামিষাশী নয় এমন পরিবারের বিবাহের অনুষ্ঠানে একদিকে শুদ্ধ নিরামিষের ব্যবস্থা আর অন্যদিকে অনেক রকম মাছের পদের এলাহি আপ্যায়নও দেখেছি। বৈষ্ণববাড়ির ‘মাংস খাই না’ বলা সদস্যের আড়ালে চিকেন-মাটন প্রেমও দেখেছি বইকি। নিরামিষভোজী আমি নিজে– ‘বাঙালি হয়েও মাছ খাস না’? গোছের কথাবার্তা শুনেছি বিস্তর। আবার নিরামিষ ভালবাসে না এমন মানুষকেও পুজোর দিনে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সোনামুখ করে ধোঁকার ডালনা, পনির, লুচি খেতে দেখেছি।

খাদ্যাভ্যাস নিয়ে এই বিতর্ক, রাজনীতি সবটাই অনেক পুরনো, কাজেই সহজে থামবে বলে মনে হয় না। তবু থামতে জানতে হয়। নিজের খাদ্যাভ্যাস বজায় রেখে অন্যের খাবারকে সম্মান করতেও শিখতে হয়। বঙ্কিমের ঔরঙ্গজেবও রাজনৈতিক বুদ্ধিতে থেমে যান। ‘ইমলি বেগম’ নির্মলকুমারী তঁার শেষ বয়সের অনুরাগের পাত্রী হয়ে ওঠেন। আমার কঠোর আমিষাশী বন্ধু আমাকে ‘তৃণভোজী’ বলে ঠাট্টা করেও নিরামিষ ছলে আমিষ খাওয়ানোর চেষ্টা শেষ পর্যন্ত করে না। আর সেটাই কাম্য। রেগে উঠে দু’-ঘা দিয়ে দেওয়াটা নয়। খাবারে আপত্তি থাকলে তা শান্তভাবে বর্জন করুন, এড়িয়ে যান। খাদ্যাভ্যাসে ‘আপরুচি’ থাকুক, বলপ্রয়োগ নয়।

(মতামত নিজস্ব)

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • কী লিখবেন, কী লিখবেন না– তা যেমন বলপ্রয়োগের বিষয় নয়; তেমনই কী খাবেন আর কী খাবেন না– তাও জোরাজুরি পছন্দ করে না।
  • ঋগ্বেদে গোমাংস ভক্ষণের কথা আছে।
  • আবার, ঋগ্বেদেই পশুবলির বিরোধিতা করা হয়েছে। পরস্পরবিরোধী এরকম দৃষ্টান্ত মহাভারতেও ভরপুর।
Advertisement