এর শুরু ‘স্ক্রলিং’ দিয়ে। ছোট ছোট ভিডিও, মিম, রিল্স– সবকিছুই আমাদের মস্তিষ্কে তাৎক্ষণিক আনন্দের সংকেত পাঠায়। ‘ডোপামিন’ ক্ষরণ বাড়ায়। ক্ষণিক ভালো লাগে, কিন্তু এর ফলে মনোযোগ কমে যায়, আরও একটু গভীরে গিয়ে চিন্তা করতে ইচ্ছা করে না। আমরা কি প্রতিদিন ক্ষয়ে যাওয়া মস্তিষ্ক চাই? লিখছেন সুজনকুমার দাস।
ধীরে ধীরে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছি। একটু ফঁাকা সময় পেলেই হাত চলে যায় মোবাইলে, আর আমরা ক্রমাগত স্ক্রল করতে থাকি। কয়েক সেকেন্ডের ছোট্ট বিনোদনেই মজা পাই ঠিকই, কিন্তু তার বদলে দীর্ঘক্ষণ মনোযোগ দিয়ে কোনও কিছু পড়া বা ভাবার শক্তি কমে যাচ্ছে। আমাদের মাথার এখন সবকিছুই চটজলদি চাই– তাৎক্ষণিক আনন্দ, দ্রুত তথ্য, কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও। ফলে গভীরভাবে চিন্তা করা বা সময় নিয়ে কিছু শেখার অভ্যাস হারিয়ে যাচ্ছে।
তাহলে কি আমরা এই দ্রুত স্ক্রলিংয়ের দুনিয়াতেই হারিয়ে যাব? না কি একটু থামব, একটু ধীরে শ্বাস নেব, আর বইয়ের পাতায় ডুব দিয়ে নিজের মস্তিষ্ককে আরও শক্তিশালী করব? পৃথিবীর সফল মানুষরা– এলন মাস্ক থেকে ওয়ারেন বাফেট– এখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়েন– শুধু জ্ঞান বাড়ানোর জন্য নয়। তঁারা জানেন, পড়া মস্তিষ্কের গঠনকে সত্যিই পালটে দেয়। বিজ্ঞান এখন পরিষ্কার করে বলে– আপনি যত বেশি পড়বেন, আপনার মস্তিষ্ক তত দ্রুত, তত গভীর এবং তত স্মার্টভাবে কাজ করবে। আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা শুরু হয় ‘স্ক্রলিং’ দিয়ে। ছোট ছোট ভিডিও, মিম, রিল– সবকিছুই আমাদের মস্তিষ্কে তাৎক্ষণিক আনন্দের সংকেত পাঠায়। এর ফল? মনোযোগ কমে যায়, কিছুই মনে থাকে না, আর একটু গভীর চিন্তাও করতে ইচ্ছা করে না। আমাদের মস্তিষ্কও হালে যেন খুব তাড়াহুড়োর জীবনে ঢুকে পড়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার রিল্স, শর্টস বা প্রতি মিনিটে বাজতে থাকা নোটিফিকেশন– সবই মস্তিষ্ককে দ্রুত ছোট ছোট আনন্দের অনুভূতি দেয়। এই আনন্দের উৎস হল সুখানুভূতির হরমোন ‘ডোপামিন’, যা মুহূর্তের মধ্যে একটু ভাল লাগা তৈরি করে। এবং সমস্যাটি এখানেই। যখনই আমরা এমন কিছু দেখি, যা এক সেকেন্ডেই আনন্দ দেয়, মস্তিষ্ক সেটার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। সে তখন প্রতিনিয়ত সেই ‘দ্রুত আনন্দ’ চাইতে থাকে। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে মনোযোগ দেওয়া, গভীরভাবে পড়া, বা কোনও জটিল বিষয় নিয়ে চিন্তা করা– এসব কাজ ক্রমেই বিরক্তিকর লাগতে শুরু করে। কারণ, এসবের ‘ফল’ আসে ধীরে, ধৈর্যের সঙ্গে। তাই স্ক্রলিং যত বাড়ে, মস্তিষ্ক ততই শর্টকাট চায়, এবং আমাদের মনোযোগ দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ে। দ্রুত আনন্দের এই অভ্যাসই আমাদের গভীর চিন্তার ক্ষমতাকে নিঃশব্দে ক্ষয় করে দেয়। এটি এমন এক অভ্যাস, যা ধীরে ধীরে আমাদের গভীরভাবে পড়া, ভাবা বা বোঝার ক্ষমতাকে ধ্বংস করে ফেলে। এর বিপরীতে, যখন আমরা বই পড়তে বসি– মস্তিষ্কের আচরণ পুরো উলটো হয়ে যায়। ‘প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স’– যা আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া, পরিকল্পনা করা, সমালোচনামূলক চিন্তন– এসব পরিচালনা করে– তা জেগে ওঠে। বই পড়ার ধারাবাহিকতা আমাদের মনোযোগ বাড়ায়, মস্তিষ্ককে স্থির করে, এবং চিন্তাকে ধারালো করে।
আরও আশ্চর্য বিষয় হল, গল্প বা উপন্যাস পড়লে মানুষ শুধু বুদ্ধিমানই নয়, বরং আরও মানবিক হয়ে ওঠে। নিউরোসায়েন্স বলছে, ‘ফিকশন’ পড়া আমাদের মস্তিষ্ককে অন্যের অনুভূতি বোঝার অনুশীলন করায়। গল্প পড়তে পড়তে আমরা চরিত্রের ভিতর ঢুকে যাই, একাত্ম বোধ করি, তাদের ভাবনা অনুভব করি, তাদের মতো ভয় পাই, আনন্দ পাই, তাদের মতো সিদ্ধান্ত নিই। এটাকে বলা হয় ‘থিওরি অফ মাইন্ড’– অন্যের মন বুঝতে শেখা। এবং গবেষণা দেখিয়েছে, যঁারা নিয়মিত ‘ফিকশন’ পড়েন, তঁাদের ‘আবেগিক বুদ্ধিমত্তা’ বা ‘ইমোশনাল কোশেন্ট’ (EQ) অনেক বেশি। এখনকার কর্মক্ষেত্র, সম্পর্ক, নেতৃত্ব– সবকিছুতেই ‘ইমোশনাল কোশেন্ট’-এর (IQ) গুরুত্ব বেশি ‘আইকিউ’-র থেকে। অর্থাৎ, বই পড়া আপনাকে শুধু স্মার্টই করে না, আপনাকে আরও বড় মনের ‘মানুষ’ করে।
আমরা যখন পড়ি, তখন শুধুই তথ্য জমা হয় না; মাথার ভিতর ধীরে ধীরে একটা চিন্তার নেটওয়ার্ক তৈরি হয়। ধরুন, আপনি ইতিহাস পড়লেন, আবার মনোবিজ্ঞান পড়লেন, তারপর কোনও দিন অর্থনীতি বা দর্শন পড়লেন– প্রতিটি বিষয়ে থেকে কিছু-না-কিছু ধারণা আপনার মাথায় থাকে। আপনি হয়তো সব মনে রাখেন না, কিন্তু ওই ধারণাগুলো অবচেতন মনে সংরক্ষিত হয়ে থাকে। তারপর যখন নতুন কোনও বই পড়ছেন বা নতুন কোনও সমস্যা বুঝতে চেষ্টা করছেন, তখন সেই পুরনো ধারণাসমূহ হঠাৎ কাজে লাগে।
যেন মাথার ভিতর আগে থেকে সাজানো ছোট ছোট ‘টুল’ রাখা আছে– যে পরিস্থিতিতে যা দরকার, তা বেরিয়ে আসে। এটাকেই চার্লি মাঙ্গার (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক কিংবদন্তি বিনিয়োগকারী, চিন্তাবিদ) বলেছেন ‘মেন্টাল মডেল’– অর্থাৎ চিন্তা করার প্রস্তুত কাঠামো। যেমন– দর্শন আপনাকে প্রশ্ন করতে শেখায়, মনোবিজ্ঞান আপনাকে মানুষের আচরণ বুঝতে সাহায্য করে, ইতিহাস আপনাকে কার্য ও কারণ বোঝার চোখ দেয়, বিজ্ঞান আপনাকে প্রমাণ খুঁজতে শেখায়। এসব মিলেমিশে গেলে আপনার মস্তিষ্কে একটা বড় মানচিত্র তৈরি হয়– যেখানে নতুন ‘ধারণা’ নতুন জায়গা পায়, পুরনো ধারণার সঙ্গে মিলেমিশে নতুন বোঝাপড়া তৈরি হয়। তাই অনেক সময় আপনার কোনও বিষয় সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও, আগে পড়া অন্য বিষয় আপনাকে পথ দেখিয়ে দেয়। অর্থাৎ, পড়া হচ্ছে মস্তিষ্কের জন্য সেই শক্তি, যা ধীরে ধীরে মানুষকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে চিন্তা করার সিস্টেম তৈরি করে দেয়। এই সিস্টেমই আসলে জীবনে সবচেয়ে বড় সম্পদ। ওয়ারেন বাফেট এটাকে চক্রবৃদ্ধি সুদের মতো বেড়ে চলা জ্ঞান বলেছিলেন। একটু একটু করে পড়ুন– এক সময়ে চিন্তা, সিদ্ধান্ত, বিচার সবকিছুই অন্য মাত্রায় যাবে।
বিজ্ঞানের ভাষায়, পুরো এই প্রক্রিয়া ‘নিউরোপ্লাস্টিসিটি’ বা ‘মস্তিষ্কের নমনীয়তা’ বলে চিহ্নিত– অর্থাৎ মস্তিষ্ক নিজের গঠন বদলাতে পারে। প্রতিটি নতুন পৃষ্ঠা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নিউরন পথ তৈরি হয়, চিন্তার রাস্তা বাড়ে, সংযোগ বাড়ে। এটি অনেকটা শহরে নতুন রাস্তা বানানোর মতো– রাস্তা যত বাড়বে, চলাচল তত দ্রুত ও সহজ হবে। নিয়মিত পাঠকদের মস্তিষ্ক তাই কয়েক বছর পর এমনভাবে বদলে যায়, যঁারা পড়েন না এমন মানুষের সঙ্গে তুলনাই চলে না। পার্থক্যটা জন্মগত বুদ্ধিতে নয়; পার্থক্যটা অভ্যাসে।
এখন আসল প্রশ্ন: আপনি কোন দিকটায় যেতে চান? আপনি চাইলে আপনার স্ক্রলিংয়েই পুরো দিন কেটে যাবে, আর আপনার মস্তিষ্ক শুধু তাৎক্ষণিক আনন্দ পাওয়ার রাস্তা বানিয়ে যাবে। অথবা, আপনি চাইলে প্রতিদিন ২০-৩০ মিনিট বই পড়ে নিজের জন্য এমন একটি মস্তিষ্ক তৈরি করতে পারেন, যা পঁাচ বছর পর আপনাকে সম্পূর্ণ অন্য মানুষ বানিয়ে দিতে পারে। প্রথম সপ্তাহে কঠিন লাগবে– স্বাভাবিক। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ গেলেই আপনি নিজের পরিবর্তন অনুভব করবেন। আর কয়েক মাস পরে আপনি বুঝতে পারবেন– চিন্তা, মনোযোগ, কথাবার্তা, সিদ্ধান্ত– সবই বদলে গিয়েছে। মস্তিষ্ক তার দিকটা পরিবর্তন করে ফেলেছে।
আমাদের মস্তিষ্ক নরম মোমের মতো, যা আপনার প্রতি মুহূর্তের অভ্যাসের উষ্ণতায় আকৃতি নেয়। যখন মনোযোগ স্ক্রলিংয়ের অগভীর স্রোতে যায়, তখন মনের গভীরে তৈরি হয় দুর্বলতা ও ক্ষণস্থায়ী সংযোগ। অন্যদিকে, বইয়ের গভীরে ডুব দিলে আপনার নিউরাল নেটওয়ার্ক পায় শক্তিশালী ও স্থায়ী গঠন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি আপনার: আপনি কি প্রতিদিন ক্ষয়ে যাওয়া মস্তিষ্ক চান, না কি প্রজ্ঞা ও স্থায়িত্বে ভরা এক দুর্ভেদ্য কাঠামো? আপনার মস্তিষ্কের ভবিষ্যৎ স্থপতি আপনি স্বয়ং।
(মতামত নিজস্ব)
