ন্যাড়া নয়, আপাতত ট্রাম্প। দাবি করেছেন, অন্তত পাঁচবার নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে পারেন। তাঁকে সমর্থন পাকিস্তানের, ভারত বিব্রত।
‘আমাদের জয় হয় নি, দুর্যোধনেরও জয় হয় নি; তাঁকে বধ করে আমাদের ক্রোধ দূর হয়েছে, কিন্তু আমি শোকে বিদীর্ণ হচ্ছি। ধনঞ্জয়, আমার রাজ্যে প্রয়োজন নেই, তুমিই রাজ্যশাসন কর’– এই বলে মহারাজ যুধিষ্ঠির সর্বস্ব ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন বলে জানাচ্ছে মহাভারত। রাজশেখর বসুর সারানুবাদে এরপরের অংশটি চিত্তাকর্ষক। যুধিষ্ঠির চীর ও জটা ধারণ করে বনে যাবেন ও ভিক্ষান্নে জীবন নির্বাহ করবেন শুনে অর্জুন অসহিষ্ণু না-হয়ে পারেননি। তৃতীয় পাণ্ডব বরাবর যুধিষ্ঠিরের অনুগত ও অনুসারী। কিন্তু এদিন তিনিও হেসে ফেললেন, “আপনি রাজকুলে জন্মেছেন, সমগ্র বসুন্ধরা জয় করেছেন, এখন মূঢ়তার বশে ধর্ম ও অর্থ ত্যাগ ক’রে বনে যেতে চাইছেন!”
অর্জুন আরও মনে করিয়ে দেন যে, দেবতারাও জ্ঞাতি অসুরদের বধ করেই সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। তাছাড়া, রাজা যদি অন্যের ধন হরণ না-করেন, তাহলে ধর্মকার্য করবেন কী করে? অর্থাৎ শান্তি পর্বের গোড়া থেকেই দমচাপা অশান্তির আগুনশিখা উড়তে দেখা যাচ্ছে। এবং মহাভারত যেভাবে রাজার কর্তব্য বোধ সম্বন্ধে যুধিষ্ঠিরের মোহগ্রস্ত মনের সংস্কার চাইছে, তাতে স্পষ্ট– চাইলেই রাজ সিংহাসন ত্যাগ করা যায় না। বরং সিংহাসনে আসীন হলে তার গুণ ও ধর্ম পালন করতে হবে। রাজা থাকলে, স্বমহিমায় রাজদণ্ডও থাকবে, থাকতে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট হয়তো-বা মহাভারত সম্বন্ধে অবগত নন, তবে আধুনিক কূটনীতির জটিল আবর্তের মর্মরস তিনি শোষণ করতে জানেন। তাই দ্বিমুখী চরিত্রে আবির্ভূত হয়েও বিন্দুমাত্র বিচলিত নন। একদিকে ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, অন্যদিকে অন্তত বার পাঁচেক যে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে পারেনন, তা-ও বুক ঠুকে বলেছেন! উল্লেখ করা উচিত, সফল ‘মধ্যস্থতাকারী’ রূপে শান্তি পুরস্কারের স্বপ্ন দেখছেন ট্রাম্প। “ওদের আমাকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া উচিত রাওয়ান্ডার জন্য, কিংবা যদি কঙ্গোর দিকে তাকান, বা যদি সার্বিয়া, কসোভো নিয়ে কথা ওঠে, অনেক ক’টা দৃষ্টান্ত দিতে পারবেন আপনারা। সবচেয়ে বড় হল ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ।”
অর্থাৎ, তাঁর উপস্থিতির জন্যই যে উপমহাদেশে ভারত-পাক যুদ্ধবিরতি ঘটেছে তা আরও একবার এঁচে নিলেন। কিন্তু ইজরায়েলের প্রতি আমেরিকার উদার সমর্থন, বা ইরানে আক্রমণ, বা এখনও পর্যন্ত ইউক্রেনের প্রতি ‘যুদ্ধং দেহি’ রাশিয়াকে চূড়ান্তভাবে নিরস্ত্র করতে না-পারা, এসব নিয়ে তিনি কোনও কথা বলেননি। আসলে, শান্তিরক্ষার কথা সম্ভবত তখনই বড় মুখে বলা যায়, যখন ক্ষমতার সমগ্র রাশ নিজের হাতে থাকে।
মহাভারত সক্রিয় রাজদণ্ডের পক্ষে কথা বলেছে, আবার প্রজাপালনের হিতবচনও দিচ্ছে, দুয়ের পাশাপাশি অবস্থান অসম্ভব অবশ্যই নয়, তবে কতদূর বাস্তবোচিত, সে-প্রশ্ন উঠবে। এই তালে পাকিস্তানও আনুষ্ঠানিকভাবে পরের বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ট্রাম্পের নাম প্রস্তাব করে বসেছে, ‘মধ্যস্থতাকারী’-র ভূমিকা পালনের জন্য। এতে যে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কপালের ভাঁজ চওড়া হচ্ছে, বলা বাহুল্য।
