আক্রান্ত হয়েছেন। এই ঘটনার প্রচারকে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে-পর্যায়ে নিয়ে যাবেন, তার সঙ্গে পাল্লা টানা ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে কঠিন। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো রাশিয়া আবার বলেছে– এটি ওয়াশিংটনের ঘৃণ্াার রাজনীতির ফলশ্রুতি! লিখছেন সুমন ভট্টাচার্য।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপর গুলিবর্ষণ শুধু কি আমেরিকার রাজনীতিকে টলিয়ে দিল? না কি ভূকম্পন ঘটল বিশ্ব রাজনীতিতেও? কারণ, প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপরে গুলি চালানোর ঘটনার পরেই সামনে এসেছে ইউক্রেনের গুপ্তচর বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎকার– যেখানে তিনি কবুল করছেন যে, তঁারা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে খতম করার জন্য একাধিকবার পরিকল্পনা করেছেন, কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেই চেষ্টা বার বার ব্যর্থ হয়েছে। ব্যস আর যায় কোথায়! ক্রেমলিনের মুখপাত্র সঙ্গে-সঙ্গেই নিশানা করলেন আমেরিকাকে, বা আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে জো বাইডেন প্রশাসনকে যে, তঁারা-ই এই ঘৃণার রাজনীতিকে, অর্থাৎ জেলেনস্কির বাহিনীর পুতিনকে আততায়ীর মাধ্যমে হত্যার পরিকল্পনাকে, মদত দিয়েছেন। অর্থাৎ ভ্লাদিমির পুতিনের নিয়ন্ত্রণাধীন মস্কো সরাসরি বলে দিল– ওয়াশিংটন ঘৃণার রাজনীতিতে, আততায়ী দিয়ে হত্যায় বিশ্বাস করে বলেই এখন তাদের পালেই বাঘ পড়েছে– নিজের দেশেই প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রেহাই পাচ্ছেন না!
একসময় লাতিন আমেরিকায়, বিশেষত কিউবায়, মার্কিন গুপ্তচর বাহিনীর কার্যকলাপ যঁারা মনে রেখেছেন, তঁারা হয়তো রাশিয়ার এইভাবে ওয়াশিংটনের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলাকে অস্বীকারও করতে পারবেন না। কিন্তু এক্ষেত্রে নামটি ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেই হয়তো ঘটনার অভিঘাত আরও তীব্র। কেননা, তঁার ২০১৬-য় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেতার নেপথ্যে অনেকেই পুতিনের হাত দেখতে পান, বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে, এই নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের পরাজয়ের কারণ-স্বরূপ রুশ ‘সাইবার অ্যাটাক’-এর ছায়া খুঁজে পান! এবার, সেই রাশিয়াই যে মার্কিন মুলুকে আরও একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে এভাবে ওয়াশিংটনকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেবে, কেই-বা জানত? পেনসিলভ্যানিয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের (Donald Trump) উপরে হামলা, আর রুশ প্রেসিডেন্টকে আততায়ীর মাধ্যমে নিকেশ করার জন্য ইউক্রেনীয় কৌশল– সবই ‘স্যাম চাচার অভ্যাস’ এমনতরো কটাক্ষ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ওয়াশিংটনের যথেষ্টই মুখ পোড়াবে!
[আরও পড়ুন: ওমানের মসজিদের কাছে বন্দুকবাজের তাণ্ডব! নিহত অন্তত ৪]
আমেরিকার অভ্যন্তরে জো বাইডেনের আসন টলমলে। কীভাবে এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া তিনি সামলাবেন, বা রিপাবলিকান প্রার্থী রূপে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে আবার হোয়াইট হাউসে ফেরা শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা কি না, তা নিয়ে আগামী কয়েক মাস জল্পনা থাকবেই। তবে মার্কিন বামপন্থীরা ইতোমধ্যে ২০ বছরের আততায়ীর গুলি ট্রাম্পের কান ছুঁয়ে বেরিয়ে যাওয়াকে ‘ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব’ দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় জুড়ে তঁাদের যুক্তি– মিছিলে গুলি চলল, অথচ সেখানে উপস্থিত রিপাবলিকান পার্টির সমর্থকরা কেউই আতঙ্কিত হলেন না! অথবা, মাত্র ৪০০ মিটার দূর থেকে আততায়ীর গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল, অথচ মার্কিন সিক্রেট সার্ভিসের বুলেট এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল ২০ বছরের হামলাকারীকে? সমালোচকদের যুক্তি– আইনি ধারায় নির্বাচনে লড়া বাতিল হয়ে যেতে পারে– এই আশঙ্কায় হয়তো ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই আততায়ীর হামলার মতো ‘সাজানো’ ঘটনা ঘটিয়েছেন। বিশেষ করে ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের মতো দুই শক্তিধর দেশের নির্বাচনে বামপন্থী এবং প্রগতিশীল শক্তির জয়জয়কারের পরে অতি দক্ষিণপন্থীদের ‘আইকন’ ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি আর কোনও ঝুঁকি নিতে চান না। এত দিন দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকরাই আপন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিঁধতে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব প্রয়োগ করতেন। ভারতেও অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির এই চেনা ছক আমরা অনেক সময় দেখেছি। এবার কি উলটপুরাণ ঘটল? কারণ, যাই হোক, এর ফলশ্রুতি– আপাতত ট্রাম্পের রক্তময় মুখ ও মুষ্টিবদ্ধ হাতের ছবি ‘ভাইরাল’।
ডোনাল্ড ট্রাম্প আক্রান্ত– এই ‘খবর’ ও ‘ছবি’ যে সহানুভূতির জোয়ার তুলতে পারে, আর দেশের মধ্যে ‘অ্যাপ্রুভাল রেটিং’-এ এগিয়ে থাকা রিপাবলিকান প্রার্থীকে কতটা সুবিধা করে দিতে পারে– তা-ও সকলে আন্দাজ করছেন। ন্যাটো-র সম্মেলনে গিয়ে জো বাইডেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে ‘পুতিন’ বলে সম্বোধন করে যথেষ্ট হাসির খোরাক হয়েছিলেন। এমনিতে প্রায় প্রতিদিনই কোনও-না-কোনও মহল থেকে দাবি উঠছিল, ৮০ পেরিয়ে যাওয়া ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্টের আর হোয়াইট হাউসে ফেরার জন্য দ্বিতীয়বার প্রার্থী হওয়া উচিত নয়। ঠিক সেই সময় ট্রাম্পের উপর বন্দুকবাজের হামলা জো বাইডেনের পরাজয়ের সম্ভাবনাকে কি আরও তীব্রতর করল?
[আরও পড়ুন: ‘তোলাবাজি’র প্রতিবাদ করে পুলিশের হুমকির মুখে কৌস্তভ! সোশাল মিডিয়ায় ফাঁস কথোপকথন]
প্যালেস্টাইন নিয়ে মার্কিন ভূমিকার নিন্দায় গত কয়েক মাস ধরে খোদ আমেরিকা উত্তাল। অথচ, সেই প্যালেস্টাইন নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতি দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। অতি দক্ষিণপন্থী নেতা হিসাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি হোয়াইট হাউসে ফেরেন, তাহলে যে ইজরায়েলের পৌষ মাস, অনুধাবন করতে অসুবিধা হয় না। প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ই ট্রাম্প পবিত্র শহর জেরুজালেমের উপর থেকে মুসলমানদের সমস্ত দাবিকে নস্যাৎ করে দিয়ে ওই শহরকে ইজরায়েলের ‘রাজধানী’ বলে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। আবার, প্যালেস্টাইনে ইজরায়েলের নির্বিচারে বোমাবর্ষণ এবং মৃত্যুমিছিল আমেরিকায় এমন তীব্র বিক্ষোভ ও ছাত্র আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে যে, ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসাবে জো বাইডেনের সমর্থনের ভিত্তি অনেকটাই আলগা হয়ে গিয়েছে। মার্কিন মুলুকের প্রগতিশীলরা প্রশ্ন তুলেছেন, যদি প্যালেস্টাইনে ‘গণহত্যা’ চালিয়ে যেতে পারে ইজরায়েল, এবং বাইডেন প্রশাসন তাতে মদত দেয়, তাহলে আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে ভাল কিছু কী করে হচ্ছে? এসব প্রশ্নে যখন আমেরিকা তর্কগর্ভ, ঠিক তখনই ট্রাম্পের উপর হামলার ঘটনা ঘটল। সন্দেহ নেই– ডোনাল্ড ট্রাম্প– যিনি বিভাজনের রাজনীতির জন্য সুপরিচিত, তিনি এই ঘটনাকে নিয়ে প্রচারকে যে-পর্যায়ে নিয়ে যাবেন, তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া ডেমোক্র্যাটদের জন্য কঠিন। আর ইতিহাসের অদ্ভুত সমাপতনে, এই সময় ট্রাম্পের উপর আততায়ীর গুলির ঘটনাকে ব্যবহার করে জো বাইডেন প্রশাসনকে বেঁধার জন্য হাজির রুশ একনায়ক ভ্লাদিমির পুতিনও। এই জোড়া ফলার মোকাবিলা অশীতিপর জো বাইডেন কী করে করবেন, তা সত্যিই গভীর সংশয়ের বিষয়!
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্পর্কেও এ-কথা বলা হয় যে, ‘পোলারাইজেশন’ বা মেরুকরণের রাজনীতিতে তঁার জুড়ি মেলা ভার। ট্রাম্পের উপর গুলিচালনার সমালোচনা করে টুইট করার সময়েই নরেন্দ্র মোদি কূটনৈতিক দুনিয়াকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, তঁার ও প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্টের মধ্যে কতটা গভীর বন্ধুত্ব এখনও রয়েছে!
(মতামত নিজস্ব)