নিট ও নেট কেলেঙ্কারিতে কোচিং সেন্টার ও ‘ডামি’ স্কুলগুলির বড় হাত রয়েছে বলে অভিযোগ। ‘ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’ রিপোর্ট বলছে, ২০২৮ সালের মধে্য দেশের সব কোচিং সেন্টারের সম্মিলিত ব্যবসার পরিমাণ বছরে ১ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছবে। এই বিপুল পরিমাণ ব্যবসার অংশীদার যে রাজনীতির কর্তাব্যক্তিরাও হবেন, তা বলা বাহুল্য। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
নিট ও নেট কেলেঙ্কারির প্রেক্ষিতে ফের দেশের কোচিং সেন্টার ব্যবসা ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে। গত জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় সরকার কোচিং সেন্টারগুলি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি নির্দেশিকা জারি করেছিল। গত ছ’-মাসে এই নির্দেশিকাটির প্রেক্ষিতে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারগুলি কোনও কার্যকর পদক্ষেপ করেছে বলে শোনা যায়নি। নিট ও নেট কেলেঙ্কারিতে কোচিং সেন্টারগুলির বড় হাত রয়েছে বলে অভিযোগ। যাবতীয় প্রশ্নফঁাস কেলেঙ্কারির মূলে কোচিং সেন্টারগুলির ভূমিকা এখন প্রকাশে্য। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত কয়েকটি কোচিং সেন্টার থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বলে অভিযোগ। যে কুখ্যাত ‘সলভার গ্যাং’-এর এক চক্রী ধরা পড়েছে, সে-ও কোটার কোচিং সেন্টারগুলির ‘পরিচিত মুখ’ বলে জানা গিয়েছে। কেন্দ্রের জারি করা ‘গাইডলাইনস ফর রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড রেগুলেশন অফ কোচিং সেন্টার, ২০২৪’ সামনে রেখে আদৌ কোনও ব্যবস্থা এবার নেওয়া হবে কি না, সেটাই এখন মূল প্রশ্ন।
বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে জানা গিয়েছে যে, দেশে এখন কোচিং সেন্টারগুলির ব্যবসার পরিমাণ বছরে ৫৮ হাজার কোটি টাকা। ‘ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’ পত্রিকায় (রেগুলেটিং দ্য কোচিং ইন্ডাস্ট্রি ইন ইন্ডিয়া, এভিডেন্স ফ্রম অা সার্ভে অফ স্টুডেন্টস, ২০ জুন, ২০২৪) কোচিং সেন্টারগুলির পড়ুয়াদের উপর করা একটি সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সমীক্ষাটি গত বছরের জুলাই-আগস্টে হয়েছিল। রিপোর্টে কোচিং সেন্টারগুলির ব্যবসার পরিমাণ থেকে শুরু করে তাদের পরিচালনা সংক্রান্ত কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে। বলা হচ্ছে, ২০২৮ সালের মধে্য দেশের সব কোচিং সেন্টারের সম্মিলিত ব্যবসার পরিমাণ বছরে ১ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছবে। যে-ক্ষেত্রটিতে বিপুল পরিমাণ ব্যবসা চলছে ও রোজ এই হারে ব্যবসা বাড়ছে, সেই ক্ষেত্রটির কর্তাব্যক্তিরা যে আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাবশালী হবেন, তা বলাই বাহুল্য। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব থাকলেই আইন না-মানার বিষয়টি চলে আসে। নিট ও নেট কেলেঙ্কারিকে সামনে রেখে শিক্ষাব্যবস্থার যে ভয়ানক ছবিটা ধরা পড়ছে, তাতে স্পষ্ট শিক্ষাকে ঘিরে এখন দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি দুর্নীতির চক্র সক্রিয়। এই চক্রের কেন্দ্রে অবশ্যই কোচিং সেন্টারগুলি রয়েছে। নিট কেলেঙ্কারিতে হরিয়ানার একটি কোচিং সেন্টারের নাম এসেছে, যেটির মালিক শাসক দল বিজেপির নেতা।
[আরও পড়ুন: ৫ বছরের সম্পর্কের পর বিয়েতে ‘না’, প্রেমিকের যৌনাঙ্গ কেটে টুকরো করলেন প্রেমিকা!]
প্রবেশিকা পরীক্ষার এই কোচিং সেন্টারের ব্যবসার জেরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা। যে শিক্ষাব্যবস্থা একটা সামগ্রিক শিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে একজন পড়ুয়ার ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র গঠন করে। কোচিং সেন্টার ব্যবসা জন্ম দিয়েছে ‘ডামি’ স্কুলের। কোচিং সেন্টারের পড়ুয়ারা প্রথাগত স্কুল ছেড়ে দিয়ে এই ‘ডামি’ স্কুলে নাম লেখাচ্ছে। এইসব স্কুলের মাধ্যমে তারা শুধু বোর্ডের পরীক্ষায় বসে। বছর শেষে একটা সার্টিফিকেট ও একটা মার্কশিট দেওয়া ছাড়া এইসব ‘ডামি’ স্কুলের কোনও ভূমিকা থাকে না। কোচিং সেন্টার থেকেই ‘ডামি’ স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা হয়। ২০২৪ সালে জয়েন্ট এন্ট্রান্স এগজামিনেশন মেইন্সের পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১২ লক্ষের বেশি। ডাক্তারিতে ভর্তির নিট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২৪ লক্ষ। এছাড়া ল’স্কুলে ভর্তির জন্য কমন ল’ অ্যাডমিশন টেস্টের পরীক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ। তিনটি বড় বড় ভর্তির পরীক্ষার মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা নেই-নেই করে ২৭-২৮ লক্ষ। এই বিশাল পরীক্ষার্থীর একটা বড় অংশ বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের পড়ুয়া।
এদের মধে্য অধিকাংশ ‘ডামি’ স্কুলের ছাত্র। ‘ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’-তে যে-সমীক্ষাটি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে সমীক্ষায় অংশ নেওয়া আইআইটির প্রায় ৫০০ ছাত্র, যঁারা জেইই মেইন্সের জন্য বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তঁাদের ৪১ শতাংশ উঁচু ক্লাসে উঠে প্রথাগত স্কুল ছেড়ে ‘ডামি’ স্কুল থেকে বোর্ডের পরীক্ষায় পাস করেছেন। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ন্যাশনাল ল’ কলেজগুলির যেসব পড়ুয়া ক্ল্যাট পরীক্ষার জন্য কোচিং সেন্টারের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তঁাদের ২৯.৪ শতাংশ ‘ডামি’ স্কুল থেকে বোর্ডের পরীক্ষা পাস করেছেন। এই ‘ডামি’ স্কুলের পড়ুয়াদের স্কুলে যাওয়ার বিষয় নেই। ফলে তঁারা সামগ্রিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত।
[আরও পড়ুন: ‘যা বলেছি নিখাদ সত্যি’, সংসদের রেকর্ড থেকে ‘হিন্দু’ মন্তব্য সরানোয় স্পিকারকে নালিশ রাহুলের]
কোচিং সেন্টারগুলো পড়ুয়াদের আকর্ষণ করার জন্য যেসব বিজ্ঞাপন দেয়, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুয়া তথে্য ভরা। বিজ্ঞাপনে যে-দাবি করা হয় তা বেশিরভাগই অসত্য। এইভাবে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে কোচিং সেন্টারগুলি যে প্রক্রিয়ায় তাদের ব্যবসা বাড়ায় তা আইনের চোখে বৈধ নয়। কিন্তু অাইন এদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করে না। বিজ্ঞাপনে ভুয়া তথ্য থাকলেও কোনও ব্যবস্থা হয় না। তৃতীয়ত, কোচিং সেন্টারের পড়ুয়াদের মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যস্ত হয়। কোটা-য় গত এক দশকে প্রায় শ’-দেড়েক পড়ুয়া আত্মঘাতী হয়েছেন। কোটায় এই বিশাল সংখ্যক আত্মহত্যার ঘটনা কোচিং সেন্টার ব্যবসাকে আগেই প্রশ্নের মুখে দঁাড় করিয়েছিল। বস্তুত, কোটায় বিরাট সংখ্যায় আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা কেন্দ্রকে বাধ্য করে কোচিং সেন্টারগুলির নিয়ন্ত্রণের নির্দেশিকা জারি করতে।
গত ছ’মাস আগে নির্দেশিকা জারি হলেও ‘ডামি’ স্কুল নিয়ন্ত্রণে, কোচিং সেন্টারগুলির ভুয়া তথ্য দিয়ে বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে এবং কোচিং সেন্টারের পড়ুয়াদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় সরকার কী পদক্ষেপ করেছে, তা অজানা। কোথাও কারও সাজা হয়েছে বলে জানা নেই। নিট ও নেট কেলেঙ্কারির মূলে যদি কোচিং সেন্টারের এই অবৈধ ব্যবসা ও পড়ুয়াদের যে কোনও মূল্যে সফল হওয়ার জন্য মরিয়া মনোভাব হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই দুর্নীতির পাহাড়টির বিরুদ্ধে লড়ার জন্য নির্দেশিকাটির রূপায়ণ ছিল সবার আগে জরুরি। িকন্তু, কোচিং সেন্টারের ব্যবসার যে আর্থিক বহর তাকে উপেক্ষা করে এবং কোচিং সেন্টারের মালিকদের প্রভাবকে অস্বীকার করে, সেটা কি সম্ভব? কোচিং সেন্টারগুলিকে নিয়ন্ত্রণের বেড়াজালে কে অানবে, সেই প্রশ্ন উঠেছে। শুধুমাত্র পরীক্ষাগ্রহণকারী সংস্থা ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি তথা ‘এনটিএ’-র সংস্কার করে পরীক্ষা ব্যবস্থাটিকে দুর্নীতিমুক্ত করা যাবে না। দরকার কোচিং সেন্টারগুলিকে নিয়ন্ত্রণ।
[আরও পড়ুন: রেশন দুর্নীতি মামলা: ইডিকে ৭০ লক্ষ টাকা ফেরত দিতে চান ঋতুপর্ণা!]
জানুয়ারি মাসে সংসদে নির্দেশিকাটি জারির পর সেটি রূপায়ণে কতটা অগ্রসর হওয়া গিয়েছে, সে-ব্যাপারে কি সংসদের বর্তমান অধিবেশনে আলোচনা হবে? না কি নিট ও নেট কেলেঙ্কারি নিয়ে শাসক ও বিরোধীদের রাজনৈতিক তরজার মধে্য দিয়েই গোটা ব্যাপারটার পরিসমাপ্তি ঘটবে?