অযোধ্যায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা হতে চলেছে রামলালার। প্রশ্ন হল, হিন্দি বলয়ে এই ইভেন্টকে মূলধন করে বিজেপি সম্ভাব্য জয়ের চিত্রনাট্য তৈরি করার স্বপ্ন দেখলেও, পশ্চিমবঙ্গে এর প্রতিক্রিয়া কতখানি সুদূরপ্রসারী? এই ঘটনার রাজনৈতিক ফায়দা কি বিজেপি বাংলায় পাবে? লিখলেন জয়ন্ত ঘোষাল
বাংলা ক্যালেন্ডার ‘সন’-এর কাহিনি জানা আছে? বর্তমানে যা একমাত্র চালু থাকা ক্যালেন্ডার। অমর্ত্য সেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘জগৎ কুটির’-এ বাংলায় চালু থাকা এই ক্যালেন্ডারের ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেন। বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা পাঁচের দশকের মাঝামাঝি বাংলা সনের ইতিহাসে হিন্দু ও মুসলমান সংস্কৃতির নিপুণ মিশ্রণের কথা তঁাকে প্রথম শোনান। অমর্ত্যবাবু জানান, প্রথম যখন তিনি এই গপ্প শোনেন তখন যুগপৎ মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়েছিলেন।
আমরা জানি, সম্রাট আকবর ১৫৮২ সালে ‘দীন-ই-ইলাহি’ নামের এক মতাদর্শের সূচনা করেন। পৃথক ধর্ম নয়, এ ছিল ধর্মীয় সমন্বয়ের মতাদর্শ। ‘দীন-ই-ইলাহি’ শব্দটি ফারসি থেকে আহৃত। ‘ইলাহি’ মানে ঈশ্বর, আর ‘দীন’ মানে বিশ্বাস। ১৫৭৫ থেকে আকবর এই মতাদর্শ নিয়ে চর্চা করেছিলেন। নানা পণ্ডিতদের সঙ্গে শলা-পরামর্শর পর ফতেপুর সিক্রিতে হিন্দু-মুসলিম-জৈন-পারসি প্রত্যেককে নিয়ে এক ধর্মসভা গঠন করেন। একইভাবে তিনি সর্বভারতীয় অসাম্প্রদায়িক ক্যালেন্ডার ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ তৈরির চেষ্টাও করেন। ষোড়শ শতকের শেষ দিকে, ইসলামিক চন্দ্র ক্যালেন্ডার হিজরির প্রথম সহস্রাব্দ যখন শেষ হচ্ছে, আকবর তখন ভারতের জন্য এমন এক দিনপঞ্জির পরিকল্পনা করেছিলেন যেখানে ছিল বহু সংস্কৃতির মেলবন্ধনের চিহ্ন। হিন্দু-জৈন বা পারসিদের মতো তা সৌরমাসের হিসাবে চলার কথা হয়েছিল। অমর্ত্য সেন সে-ইতিহাস জানিয়ে এ-কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, এই ক্যালেন্ডারে ইসলামিক হিজরির বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করা হয়েছিল।
[আরও পড়ুন: রামের অযোধ্যায় হোটেল পাচ্ছেন না খোদ লক্ষ্মণ, ‘ক্ষুব্ধ’ সুনীল! মন্দির উদ্বোধনের আগেই ফিরতে হচ্ছে?]
১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দকে (আকবরের সিংহাসনে আরোহণের সাল) ‘শূন্য’ বৎসর ধরা হয়েছিল, যা ১৪৭৮ হিন্দু শকাব্দ এবং ৯৬৩ ইসলামিক হিজরির সমান। আকবর তাঁর ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ দিল্লি-আগ্রায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। তিনি আশাহত হন। তবে নিজের রাজসভা ছাড়া যেখানে এটি গৃহীত হয় ভূগোলে সে-স্থানের নাম বঙ্গদেশ। আকবরের ‘তারিখ-ই-ইলাহি’-র গভীর প্রভাবে পুরনো বাংলা অব্দের সংস্কার করা হয়। তা পালটায়নি।
‘দীন-ই-ইলাহি’ মতাদর্শকেও আকবর সমগ্র দেশে সেভাবে কার্যকর করতে পারেননি, কারণ সব ধর্মের উগ্রবাদী পণ্ডিতেরা এই সমন্বয় ভাবনাকে ভাল চোখে দেখেননি। ক্যালেন্ডারও বাংলা ছাড়া অন্যত্র সফল হয়নি। এই ক্যালেন্ডারের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে অমর্ত্য সেন বলেছেন, বাংলার ইতিহাস হল ঐকে্যর ইতিহাস। ধর্মীয় বিভাজন ও সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতার নয়। অমর্ত্য বারবার আমাদের বলার চেষ্টা করেন যে, বাংলায় আছে এক বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক যৌথতা। এবার আমরা ক্যামেরাকে প্যান করে নিয়ে আসি ২০২৪-এর ২২ জানুয়ারির দিকে।
[আরও পড়ুন: রামমন্দিরে ৫০ কোটি অনুদান প্রভাসের? ‘আদিপুরুষ’ বিতর্কের ড্যামেজ কন্ট্রোল!]
অযোধ্যায় রামমন্দিরে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা হতে চলেছে। আদালতের নির্দেশেই অযোধ্যার মন্দির ট্রাস্টের সাধুরা আনুষ্ঠানিকভাবে এই উৎসব করছেন, কিন্তু প্রধান নেপথ্যশিল্পী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এটি এক জাতীয় ইভেন্ট। দেশজুড়ে এ ঘটনায় ইতিমধে্যই শোরগোল। মোদি বলেছেন, শুধু অযোধ্যায় নয়, দেশের সমস্ত রাজ্যে সেদিন রামের ‘পূজন’ হবে ঘরে ঘরে, মন্দিরে মন্দিরে। বিজেপি নেতারা বলছেন, এ হল মোদির ‘মাস্টারস্ট্রোক’। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের মুখে রামমন্দির নির্মাণের সাফল্যর দাবিদার হয়ে বিজেপি সমগ্র দেশে একক সুনির্দিষ্ট আলেখ্য রচনা করছে।
এখন প্রশ্ন, ভারতের উত্তর ভারতীয় হিন্দি বলয়ে এই ইভেন্টকে মূলধন করে বিজেপি সম্ভাব্য জয়ের একটি চিত্রনাট্য তৈরি করার স্বপ্ন যখন দেখছে, তখন পশ্চিমবঙ্গে এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া কী? এই ঘটনার রাজনৈতিক ফায়দা কি বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে পাবে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন, ২২ জানুয়ারি তিনি কলকাতায় পার্ক সার্কাসে একটি সর্বধর্ম সমন্বয়ের সভা করবেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি সকালেই কালীঘাটে মায়ের দর্শনে যাবেন। এরপর হাজরা থেকে সম্প্রীতি মিছিল আসবে পার্ক সার্কাস পর্যন্ত। বিজেপি এই মিছিল ও সম্প্রীতি সমাবেশে নিষিদ্ধ করার জন্য হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ, তৃণমূল কংগ্রেস ওই দিনেই সম্প্রীতি মিছিলের ডাক দিয়ে সাম্প্রদায়িক হিংসা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু হাই কোর্ট শুভেন্দুর অভিযোগ খারিজ করে। পাল্টা যুক্তি, বিজেপিই পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মেরুকরণ চাইছে। মমতাকে মুসলিম সমাজের সঙ্গে ‘ট্যাগ’ করে বিজেপি বাঙালি ভদ্রলোক ও নিম্নবর্গ হিন্দুভোটকে এককভাবে পেতে চাইছে। এই চেষ্টা ২০২১-এর বিধানসভা ভোটেও বিজেপি করেছিল, কিন্তু সেবার মমতার কাছে পর্যুদস্ত হয়েছিল বিজেপি।
অযোধ্যায় রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা যদি বিজেপির জন্য ‘মাস্টারস্ট্রোক’ হয় হিন্দি বলয়ে, তবে পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রীতি সর্ব ধর্ম সমন্বয় সভাও মমতার ‘মাস্টারস্ট্রোক’। প্রতিষ্ঠার জাতীয় উৎসব নিয়ে মমতা কোনও বিরূপ মন্তব্য করেননি। তিনি বলছেন, আদালতের নির্দেশের ভিত্তিতে এ অনুষ্ঠান হচ্ছে, তা নিয়ে তঁার কোনও বিরূপতা নেই, কিন্তু রাজে্য সম্প্রীতি সমাবেশও তঁার নিজস্ব দলীয় কর্মসূচি। এটা কোনও পাল্টা কর্মসূচি নয়। এখানেই তৃণমূলনেত্রীর রাজনৈতিক মুনশিয়ানা।
এখানেই রাহুল গান্ধী ও কংগ্রেসের ব্যর্থতা। রাহুল গান্ধী, সীতারাম ইয়েচুরির মতো একইভাবেই অযোধ্যার কর্মসূচির বিরোধিতা করে চলেছেন। প্রতিদিন নিত্যনতুন বিবৃতি দিয়ে, অযোধ্যাকে নির্বাচনী কর্মসূচি আখ্যা দিয়ে বিষয়টিকে হিন্দি বলয়ে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলছেন। বিজেপির রাহুল ও কংগ্রেস বিরোধিতাও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। অযোধ্যা নিয়ে এই রাজনৈতিক মেরুকরণই তো চাইছে বিজেপি!
সেখানে মমতা ওই ফঁাদে পা না দিয়ে এক সম্প্রীতি-বার্তা দিচ্ছেন। বাঙালির এই মিশ্র সংস্কৃতির কথাই তো বলেছেন অমর্ত্য সেন। হিন্দু ধর্মের মধে্যও যে ‘দীন-ই-ইলাহি’র
ভাবনা আছে তা তো অমর্ত্য সেনের দাদামশাই ক্ষিতিমোহন সেনের বিশ্বখ্যাত গ্রন্থ ‘হিন্দুধর্ম’-এ ছত্রে ছত্রে ব্যাখ্যাত। ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণর কথামৃতেও তো এই অখণ্ড দর্শন। রাজনেতার কাজ ভারতের মতো এক বহুত্ববাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের একক মুখপাত্র হয়ে ওঠা নয়। হিন্দি বলয়ে মোদি-শাহর রাজনৈতিক বিকল্প খুবই দুর্বল। রাহুল বা অখিলেশ কেউ-ই হিন্দি বলয়ে বিজেপির এই ধর্মীয় রাজনীতির মোকাবিলা করতে সক্ষম হচ্ছেন না।
দেশে খাদ্যদ্রবে্য মুদ্রাস্ফীতির রেকর্ড বৃদ্ধি। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, দেশে কর্মহীনতাও চরমে। কিন্তু এসব জ্বলন্ত ইসু্যকে ভুলিয়ে দিয়ে ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করে দেশে ‘উন্নয়ন মডেল’ খাড়া করার চেষ্টা, নিঃসন্দেহে আমজনতাকে বোকা বানানোর মাস্টারস্ট্রোক। কিন্তু হিন্দি বলয়ে সম্ভব হলেও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির পথ, ‘ক্ষুরস্য ধারা’।
২০১৯-এর লোকসভা ভোটে অবশ্য বিজেপি আসন সংখ্যা অনেকটা বাড়িয়ে নেয়। মোদির ব্র্যান্ড ইকু্যইটি– পুলওয়ামা আক্রমণ এবং সর্বোপরি ‘জয় শ্রীরাম’। সেবার কিন্তু শুধু বড়বাজার নয়, যাদবপুর-ধর্মতলাতেও ভদ্রলোক বাঙালিকে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিতে দেখেছিলাম। বিজেপি সেই একই হিন্দুত্বের আগুনে রাজনীতির রুটি সেঁকতে চাইছে।
লালকৃষ্ণ আদবানি যখন রামমন্দির আন্দোলন শুরু করেন তখন তঁার রথযাত্রার যে-প্রভাব উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে দেখেছিলাম, তা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায়নি। পরে আদবানি আমাকে বলেছিলেন, একটা সারসত্য আমি বুঝেছি– বাংলায় ‘রাম’ ইসু্য দিয়ে এগলে হবে না। সেজন্য তিনি বঙ্কিমচন্দ্র-‘আনন্দমঠ’, দেশভাগ-অনুপ্রবেশ, বিবেকানন্দ ও সুভাষচন্দ্র বসুকে ইসু্য করতে চান। রাজে্য রামমন্দির কৌশল নিয়ে বিজেপি সেদিন এগয়নি। সেই সময়ে কেন্দ্রে বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। সেজন্য কিন্তু আদবানি পশ্চিমবঙ্গের ওই রণকৌশল নির্মাণের কথা ভাবেননি। তিনি বারবার বলতেন, বাজপেয়ীজির সঙ্গে কলকাতায় মেট্রো সিনেমায় সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পঁাচালী’ দেখেই বাঙালির মনস্তত্ব বুঝেছিলাম। বাংলার জন্য তাই বিজেপির আলাদা মডেল চাই।
মোদি-শাহর বিজেপি এখন সংসদে ৩০৩টি আসন পেয়েছে। কেন্দ্রে এখন এটি কোয়ালিশন সরকার নয়, বিজেপির একার সরকার। তাই বিজেপির নিজেদের উপর আস্থা বেড়ে গিয়েছে আরও কয়েকশো গুণ। বিশেষত মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্রিশগড়েও ক্ষমতায় আসার পর এই আত্মবিশ্বাস চূড়ান্ত হয়েছে। বিজেপির মনে হচ্ছে, অসম-ত্রিপুরায় যদি তাদের প্রাণপ্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় তবে কেন পশ্চিমবঙ্গে নয়? এমনকী, এবার দক্ষিণ ভারতেও মোদি ‘রাম’ ফ্যাক্টর নিয়েই এগতে চাইছেন। কেন্দ্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য বিজেপির অসমাপ্ত কর্মসূচি সমাপ্ত করছে এক এক করে। ৩৭০ ধারা উচ্ছেদ, রামমন্দির নির্মাণ আর অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। তাদের ক্লাসিকাল তিনটি কোর-ইসু্য।
স্বীকার করতে হবে, বিজেপি এখন আর কোনওভাবেই তার ‘ট্র্যাক’ বদল করতে রাজি নয়। ‘রামনাম’ নিয়েই এগবে, অাদবানির সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের কৌশল নয়, কেননা মোদি-শাহ মনে করেন– পার্টি তার নিজস্ব চরিত্রকে বিসর্জন দিয়ে বাংলায় এগবে না, বরং ধারাবাহিকতা রক্ষা করলে আজ নয় তো আগামিকাল তারা ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বাংলায় প্রধান শক্তি হয়ে উঠবে।
তবে হিন্দি বলয়ে যা সম্ভব, মমতার বাংলায় এখনও তা সহজ নয়। বাঙালির সংস্কৃতির মধে্যই আছে, ‘দিবে আর নিবে’ সংস্কৃতি। শিকাগো বক্তৃতায় স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘হিন্দুধর্মে অন্য ধর্মাবলম্বীদের শিরচ্ছেদন হয় না।… ভারতে ধর্ম মন্দির নির্মাণের প্রয়োজন কম। কারণ ভারতবাসীর ধর্ম প্রচুর পরিমাণে আছে। ভারতবাসী শুষ্ক কণ্ঠে কেবলমাত্র অন্নের জন্য লালায়িত। ভারতবাসী অন্ন চাইছে, আমরা তাদের প্রস্তরখণ্ড দিচ্ছি।’ স্বামীজি এখনও প্রাসঙ্গিক– বাঙালি এই সহজ-সরল সতে্য বিশ্বাস করে। তাই ধর্মীয় উন্মাদনার ঝড়ের মধে্যও পশ্চিমবাংলা অনক্রম্যতার এক বিরল নিদর্শন হবে, এটি প্রত্যাশা করা অন্যায় নয়।