সামাজিক অবিচার, গণমাধ্যমের বাক্স্বাধীনতা, বৌদ্ধিক অসংবেদনশীলতার বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার হয়েছিলেন ‘রাজা’ রামমোহন রায়। বর্ণবাদী সমাজ ও ধর্মের একবগ্গা কাঠামো যেভাবে মানুষের প্রাণবায়ু শোষণ করে, তারও প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। সতীদাহ রোধ তঁার সর্বাগ্রগণ্য কৃতিত্বের একটি। জন্মদিনে বিশেষ নিবন্ধ। লিখছেন ফাদার জন ফেলিক্স রাজ ও প্রভাতকুমার দত্ত।
১৭৭২ সালে, আজকের দিনে, জন্মগ্রহণ করেন ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়, যিনি অধিক পরিচিত ভারতের নবজাগরণের পথিকৃৎ রূপে। জেরেমি বেন্থাম একবার রাজা রামমোহন রায়কে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘intensely admired and dearly loved collaborator.’ কখনও তঁাকে বলা হয়েছে ‘এরাসমাস অফ ইন্ডিয়া’, কখনও কবিগুরুর কণ্ঠে তিনি বর্ণিত হয়েছেন ‘ভারতীয় ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র’ রূপে।
বাঙালি ‘ভদ্রলোক’ সংস্কৃতির অন্যতম প্রতিনিধি রামমোহন রায় হিন্দু ধর্মীয় প্রথা এবং সামাজিক ব্যবস্থার সংস্কারসাধনকেই করে তুলেছিলেন জীবনের মূল লক্ষ্য। ১৮০৩ সালে ফারসি ভাষায় লেখেন ‘তুহফাত-উল-মুয়াহিদ্দিন’– এই গবেষণামূলক পুস্তিকায় তিনি যুগ যুগ ধরে চলে আসা হিন্দু প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছিলেন। ধর্মীয় ভ্রান্তি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যা কিছু বলে গিয়েছেন, তার প্রাসঙ্গিকতা এখনও বিস্মিত করে আমাদের। অন্ধত্ব, গোঁড়ামি, অশিক্ষা, কুপ্রথার বিরোধিতা করে তিনি অবস্থান নিয়েছিলেন যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের পক্ষে।
বৌদ্ধিক যাত্রার মাধ্যমে, তিনি যুক্তিবাদকে, উপযোগিতাবাদের সঙ্গে একীভূত করেছিলেন। তঁার স্বপ্ন ছিল এমন এক ব্রাহ্ম একেশ্বরবাদী দর্শন গড়ে তোলা– যা সামাজিক অবিচার, গণমাধ্যমের বাক্স্বাধীনতা, এবং বৌদ্ধিক অসংবেদনশীলতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে। ইউরোপীয়দের বর্ণগত শ্রেষ্ঠত্বর বিরোধিতা করেছেন বরাবর, এবং ভারতীয়দের নাগরিক অধিকারের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন।
রামমোহন রায় জন্মগ্রহণ করেন বিত্তবান ব্রাহ্মণ পরিবারে। ছেলেবেলা থেকেই হিন্দি ও বাংলা ছাড়া বেশ কয়েকটি প্রাচ্যভাষা– যেমন সংস্কৃত, আরবি ও ফারসিতে হয়ে ওঠেন দক্ষ। পরবর্তীতে পশ্চিমের নানা পণ্ডিত ও দার্শনিকদের লেখা– যেমন: ফ্রান্সিস বেকন, জন লক, ডেভিড হিউম, ভলতেয়ার, নিউটন প্রমুখ– তঁার জ্ঞানের ব্যাপ্তি ঘটিয়েছিল বহুগুণ।
১৮০৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে জন ডিগবির সহায়তায় তঁার নিয়োগ ঘটেছিল– যা তঁার জীবনের একটি মোড় ফেরানো ঘটনা। এর সুবাদে তিনি পাশ্চাত্যের শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে আরও সম্পৃক্ত হয়ে ওঠেন। পরে, তঁার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলেই গণিত, দর্শন, রসায়ন এবং শারীরবিদ্যার মতো ব্যবহারিক বিষয়– নতুন শিক্ষা কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত হয়। (উইলিয়ামস, ২০১৬)।
সংস্কারের মুখ
ধর্মীয় সংস্কারক রূপে, রামমোহন রায়, হিন্দুদের মূর্তিপূজা প্রথার সমালোচক ছিলেন। বর্ণপ্রথা ও সতীদাহ প্রথার তীব্র নিন্দা করে ১৮২৯ সালে সতীদাহ ‘নিষিদ্ধ’ করেন। তঁার ক্ষুরধার কলমের জোরেই তৎকালীন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া গভর্নিং কাউন্সিলের উদে্যাগে রদ করা হয় এই ভয়াবহ কুপ্রথা। কিছু পুজোপাসনা পদ্ধতিতে ‘অশ্লীল ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ যৌন মিলন’-এর উল্লেখের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। কান্টীয় জ্ঞানচর্চায় বলা হয়েছে– প্রকৃত নীতিপরায়ণতা কোনও ব্যক্তিক ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা বা চাহিদার উপর নির্ভরশীল নয়। তঁার এমন ‘বিরল’ ভাবনা ও যুক্তির সঙ্গে স্বভাবতই সহমত হয়েছিলেন ইউরোপীয় বন্ধুরা। তবে তঁার হিন্দু সমসাময়িকরা এই দৃষ্টিকোণের তুমুল সমালোচনা করেন। তবে শত বিরোধিতা সত্ত্বেও, তঁার অদম্য প্রচেষ্টার ফলে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে, আধুনিক ও প্রগতিশীল ভারতীয় সমাজের ভিত্তি স্থাপিত হয়। যে-মূল্যবোধের উত্তরাধিকার এখনও সংস্কারমূলক উদ্যোগকে প্রাণিত এবং প্রভাবিত করে চলেছে।
সংস্কার: সমাজ ও শিক্ষা
সমাজ ও শিক্ষার সংস্কারক রূপে রামমোহন রায়ের দৃষ্টিভঙ্গি আকবর, সুফি সাধক এবং রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ঐতিহ্য থেকে অনুপ্রাণিত ছিল। ধর্মনিরপেক্ষ ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষানীতির প্রতি তঁার সমর্থন বর্তমান প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে নতুন শিক্ষানীতি ঘিরে তৈরি বিতর্কের আবহে– প্রাসঙ্গিক।
১৮২০ সালে নির্মাণ করেছিলেন ‘অ্যাংলো হিন্দু স্কুল’। চার বছর পর হিন্দু একেশ্বরবাদী মতবাদ প্রবর্তনের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘বেদান্ত কলেজ’। চেষ্টা করেন বেদান্ত স্কুলের নীতির প্রতি আগ্রহ পুনরুজ্জীবিত করার। আপন ধর্মীয় বিশ্বাসের দার্শনিক ভিত্তি খুঁজে পেয়েছিলেন বেদ ও উপনিষদে– সেই পরমেশ্বরের উপাসনাতেই মন নিবিষ্ট করার উপদেশ দেন।
এরপর তঁার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে খ্রিস্টান ধর্ম। ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ ও ‘নিউ টেস্টামেন্ট’ পড়ার জন্য শুরু করেন গ্রিক ও হিব্রু ভাষা শেখা। গসপেলের পাঠ শেষ করে সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখেন– ‘প্রিসেপ্টস অফ জিসাস: আ গাইড টু পিস অ্যান্ড হ্যাপিনেস’। ফরাসি ও আমেরিকান বিপ্লব থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন মৌলিক সামাজিক ও রাজনৈতিক ধারণাকে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করার সময়– বাংলা ভাষার প্রচারও করেন তিনি।
তৎকালীন সরকার যখন অাদে্যাপান্ত দেশীয় ধঁাচে ‘সংস্কৃত কলেজ’ গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু তা খারিজ করে রামমোহন রায় একটি আধুনিক ও পাশ্চাত্যানুসারী পাঠ্যক্রমের পক্ষে সওয়াল করেন। জোর দেন বিজ্ঞানশিক্ষার গুরুত্বর উপর, কারণ বিজ্ঞান ছাড়া কোনও দেশের অগ্রগতি অসম্ভব। পরবর্তীতে ‘হিন্দু কলেজ’ ও ‘বেদান্ত কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করে, পূর্ব ও পাশ্চাত্য শিক্ষার সমন্বয়সাধন করেন তিনি।
১৮২২ সালে নির্মাণ করেন ‘অ্যাংলো বৈদিক স্কুল’। যেখানে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান, দর্শন এবং সাহিত্য সমস্ত কিছু সমান্তরালভাবে গুরুত্ব সহকারে পড়ানো হত। বিভিন্ন ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণে সহযোগিতার পাশাপাশি হিন্দুদের মধ্যে নারীশিক্ষার প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তঁার ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ একটি শক্তিশালী ও প্রগতিশীল গোষ্ঠীতে পরিণত হয়, যার লক্ষ্য ছিল মেয়েদের আত্মনির্ভর করা। মেয়েরা যাতে উচ্চশিক্ষিত হতে পারে, এবং জাতিব্যবস্থা ও সতীদাহ-সহ অন্যান্য অপচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দঁাড়াতে পারে।
আর্থিক সংস্কারক
জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও চিরকাল শোষিত, দরিদ্র প্রজাদের স্বার্থে সওয়াল করেছেন রামমোহন রায়। নিরলস লড়াই চালিয়েছিলেন বাংলায় কৃষকদের জন্য নির্ধারিত রাজস্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। ভারতীয় পণ্যর উপর আরোপিত ভারী রফতানি শুল্কর বিরোধিতা করেও সোচ্চার হন। উল্লেখ্য যে, তিনিই প্রথম ভারত থেকে ইংল্যান্ডে সম্পদের গোপন পাচার (drain of wealth) ঘিরে দু’-দেশের আর্থিক বৈষমে্যর দিকটি তুলে ধরেন। বলেন যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারত থেকে ইংল্যান্ডে প্রতি বছরে ৩০ লক্ষ পাউন্ড সম্পদ স্থানান্তরিত করে ভারতের অর্থনীতির মাজা ভেঙে দিচ্ছে। তঁার লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান ও আমূল সংস্কার।
আইন সংস্কার
আইন সংস্কারক রূপে, রামমোহন রায়, তৎকালীন ভারতে প্রশাসনের থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করার দাবি রাখেন। ১৮২৩ সালে প্রেস নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানান ও গণমাধ্যমের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণের অপসারণ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বৃদ্ধির জন্য কণ্ঠ ছাড়েন। ১৮২৭ সালের বৈষম্যমূলক জুরি আইনের বিরুদ্ধেও দীর্ঘস্থায়ী লড়াই শুরু করেছিলেন। এর পাশাপাশি কৃষকদের উপর করের বোঝা কমানোর পক্ষেও মত দেন তিনি।
‘নতুন ভারত’-এর প্রতি রামমোহন রায়ের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অনন্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তঁাকে যথাযথভাবেই ‘ভারতপথিক’ হিসাবে বর্ণনা করেন। রামমোহন রায়ের সম্বন্ধে চমৎকার মূল্যায়ন করেছেন রামচন্দ্র গুহ– ‘সাবেক সমাজব্যবস্থার সঙ্গে আধুনিকতার ঠোকাঠুকির ফলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবেই। রামমোহন রায় এই উপমহাদেশের প্রথম ব্যক্তি, যিনি সেসব গুরুত্ব সহকারে সেসব চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছিলেন।’ বর্ণবাদী সমাজ এবং ধর্মের পিছুটান অগ্রাহ্য করে রামমোহন রায় আস্থা রেখেছিলেন নিবিড় যুক্তিবাদে– এ কারণেই তিনি অনন্য।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক: ভাইস চ্যান্সেলর, সেন্ট জেভিয়ার্স ইউনিভার্সিটি