সুহৃদ দাস: আরও একটা ৫ জুলাই। আর পাঁচটা বর্ষার দিনের মতোই। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে আলাদা। ফিরে আসে স্কুলের স্মৃতি। মনে পড়ে স্যরের ক্লাস নেওয়া। একাধিক বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে পরামর্শ দেওয়া। জীবনবোধ তৈরি করার কথা। আর মনে পড়ে স্যরের রক্তমাখা চেহারা। স্যর বরুণ বিশ্বাস। উত্তর ২৪ পরগনার সুটিয়া গণধর্ষণ কাণ্ডে গুলিতে খুন হওয়া আমার মাস্টারমশাই। প্রতিবাদী শিক্ষক হিসেবে যাকে এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলার মানুষ চেনেন। সেই বরুণ বিশ্বাস।
মধ্য কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশন (মেন) স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। আর সৌভাগ্যক্রমে আমি নিজেও ওই স্কুলের ছাত্র। ছাত্র হিসেবে স্যরের ক্লাস করা, সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ এসেছিল।২০১২ সালের ৫ জুলাই খুন হয়েছিলেন তিনি। স্কুল থেকে ফেরার পথে। গোবরডাঙা স্টেশনের বাইরে গুলিতে ঝাঁজরা করে দিয়েছিল আততায়ী। এরপর কেটে গিয়েছে এতগুলো বছর! এখনও বিশ্বাস হয় না। এখনও ওঁর ছবি দেখলে মনে হয় জীবন্ত! ওই তো হাসছেন আমার দিকে তাকিয়ে।
মনে পড়ে। তখন ক্লাস এইটের ছাত্র। নতুন কয়েকজন স্যর স্কুলে কর্মসূত্রে যোগ দিয়েছেন কিছুদিন আগেই। নামকরা মাস্টারমশাইরা তখন সেই স্কুলে পড়াতেন। কয়েকজন স্যর ছিলেন অত্যন্ত রাগী। যাঁদের দেখলে স্কুলের উঠোন টিফিনবেলাতেও কার্যত নিমেষে ফাঁকা হয়ে যেত। আর সেই স্যররা যদি ক্লাস নিতেন, তাহলে তো তটস্থ থাকাই ছাত্রজীবনে বাধ্যতামূলক। যদিও বড় বয়সে সেই স্যরদের সঙ্গে দূরত্ব কমে যায়। স্যরদের স্নেহ পেয়েছি, সেকথা বলতেও দ্বিধা নেই। কিন্তু বরুণ বিশ্বাস কেমন? সে কথা তখনও জানা নেই। একসময় ক্লাসের নতুন রুটিনে দেখা গেল বরুণবাবু পড়াবেন। নির্দিষ্ট দিনের ক্লাসে স্যর পড়াতে এলেন ক্লাসে।
মুখে চাপ দাড়ি। জামা গুঁজে পরা। দুরুদুরু বুকে প্রথমদিনের অপেক্ষা। না, স্যর জোরে কথা বলেন না। মিতভাষী, লাজুক। মুখে সবসময়ই হাসি লেগে রয়েছে। বাংলার ক্লাস কয়েকদিনের মধ্যেই হইহই করে চলতে শুরু করল। পাঠ্য বইয়ের গল্প, কবিতার মানে বিশদে বোঝানো শুরু হয়। না, এতটুকু উৎসাহের ঘাটতি ছিল না আমাদের মধ্যে। অত্যন্ত দস্যি ছেলেরাও শান্ত মনে ক্লাস করত। ক্লাস করতে ইচ্ছে না হলে স্যরকে কখনও বলতেও দ্বিধা করিনি আমরা। সেসব ক্লাসে স্যর বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছেন। আবার কখনও নিজে কোনও কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছেন। কখনও উঁচু গলায় কাউকে বকেননি। গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা।
স্কুলে কোনও অনুষ্ঠান হলে স্যর গান গাইতেন। দরাজ গলায় স্যারের গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে মুগ্ধ হয়েছি, সেকথা বলাই যায়। স্যার মাঝেমধ্যেই গুনগুন করে গাইতেন, 'বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন কভু করি ভয়।' তখন বুঝিনি কোন মানসিক চাপের মধ্যে স্যার এই গান গুনগুন করতেন। স্যার চলে যাওয়ার পর জানতে পেরেছিলাম, সুটিয়া গণধর্ষণ কাণ্ডের তিনিই ছিলেন অন্যতম প্রধান প্রতিবাদী মুখ। খুনের হুমকি বহু দিন থেকেই তিনি পেয়ে এসেছিলেন। অপরিসীম মানসিক চাপের কোনও প্রতিক্রিয়া স্কুলের স্যরের মধ্যে আমরা ছাত্ররা দেখতে পাইনি। যদিও পরে জানতাম, অন্য স্যররা সব ঘটনাই জানতেন। মানসিকভাবে তাঁর পাশে থেকেছেন সবসময়।
পরীক্ষা হলে স্যরের সামনে নকল করা সম্ভব ছিল না। না, কড়া গার্ড দেওয়া, খাতা কেড়ে নেওয়ার মতো কিছু কোনওদিন করতে দেখিনি। বরং কেউ নকল করতে গিয়ে স্যরের হাতে ধরা পড়লে সেই ছাত্রের খাতা কেড়ে নেওয়া নয়, সেই প্রশ্নটা ভালো করে বুঝিয়ে দিতেন বরুণবাবু। এই ভাবেই মানুষটা যেন ক্রমে হয়ে গিয়েছিলেন আমাদের অনেক ছাত্রের কাছের মানুষ। আমার বাড়ি বনগাঁ শাখার নিউ ব্যারাকপুর শাখায়। স্যর নামতেন অনেক দূরের গোবরডাঙা স্টেশনে। স্যরের সঙ্গে আমাদের আরও একজন বাংলার মাস্টারমশাই দেবব্রতবাবু বাড়ি ফিরতেন। স্যররা শিয়ালদহ স্টেশন থেকে বিকেলের বনগাঁ লোকালে উঠতেন। সপ্তাহের অনেক দিনই স্যরদের সঙ্গে একই কামরায় বাড়ি ফেরার সুযোগ হত। স্যর তাঁর নিজের বসার জায়গা আমার জন্য ছেড়ে দিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে যেতেন। ভিড়ের চাপে কখনও তাঁর হাত আমার কাঁধে থাকত। আমি নেমে গেলে তিনি সেই জায়গায় বসতেন।
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ জীবন। মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়ছি শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন। নির্ভীক সাংবাদিকতা করতে হবে, বলতেন তিনি। ক্রমে সাংবাদিক জীবনে এসে পড়লাম। সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেছি শুনে অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু কখনও তাঁর নিজের জীবনে বইতে থাকা ঝড় নিয়ে কিছু বলেননি। ধীরে ধীরে স্যরের সঙ্গে যোগাযোগও কমতে থাকে। বছরে কয়েকটা দিন দেখা হত। স্নেহের হাত বরাবর রেখেছেন মাথায়। সাধারণ জীবন আর বড় মনের মানুষ হওয়ার কথা সবসময় বলতেন।
আচমকাই এসে পড়ল সেই অভিশপ্ত ২০১২ সালের ৫ জুলাই। স্যার চলে গেলেন। মরদেহ আনা হয়েছিল স্কুলে। হাজার হাজার মানুষের ভিড় সেদিন। সকলের চোখে জল। অঝোরে কেঁদে চলেছেন অনেক স্যর। চোখের জল বাঁধ মানেনি আমার, আমাদেরও। পরে ধীরে ধীরে জানতে পারি স্যরের জীবন সংগ্রামের কথা। নিজের মাইনের বেশিরভাগ টাকাই বিলিয়ে দিতেন সাধারণ মানুষের মধ্যে। শীতের রাতে এক বৃদ্ধার বিছানা ছিল না। স্যর নিজের ঘরের খাট, বিছানা, লেপ, তোষক সেই বৃদ্ধার বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। নিজে কীভাবে শীতের রাতে থাকবেন, পরোয়া করেননি। বিলাসিতা তো দূর, নিজের জন্য বেশি দামের জামাকাপড়ও কিনতেন না কখনও। স্কুলের অন্যান্য স্যারদের মুখে শুনেনি, বরুণবাবু জানতেন তাঁর জীবন যে কোনও চলে যেতে পারে। তাই বিবাহবন্ধনে জড়ানোর কথাও মনে আনেনি।
স্যর চলে গিয়েছেন। কিন্তু এখনও টাটকা অনেক স্মৃতি। সদাহাস্যমুখ চোখে ভাসে আজও। ভারাক্রান্ত হই। জীবনের পাঠ সংকলনের শিক্ষা দিতেন তিনি। আজও সেই সহজ জীবনের শিক্ষা নিয়ে চলার চেষ্টায় পথ হাঁটা। এতদিন হয়ে গেল, তবু স্যরকে ভুলিনি। ভোলা যায় না।
