shono
Advertisement

খাদ্য রপ্তানি ও মৈত্রী

‘নিষেধাজ্ঞা’ সরাতে মোদি সরকার দ্বিধাগ্রস্ত কেন?
Posted: 04:51 PM May 26, 2023Updated: 04:51 PM May 26, 2023

দানাশস‌্য উৎপাদনের অনুকূল অবস্থা সত্ত্বেও ভারত গম  রপ্তানির উপর ‘নিষেধাজ্ঞা’ জারি রেখেছে। তা মকুব হলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে বাংলাদেশ। কলমে অমিতাভ সেন

Advertisement

 

ই মুহূর্তে, বিশ্বের যে-কয়েকটি দেশ খাদ্য সুরক্ষায় শুধু সুনিশ্চিত নয়, প্রতিবেশী দেশ-সহ অভাবী দেশসমূহের পাশে সাধ্যমতো দাঁড়ানোর ক্ষমতা রাখে, ভারত তাদের মধ্যে অন্যতম। গম উৎপাদনে নতুন রেকর্ড করেছে ভারত। বছরের শুরুতে গুদামজাত এই দানা-শস্যর পরিমাণকে যুক্ত করলে মোট অঙ্ক দাঁড়াবে ১১৯.৫ মিলিয়ন টনেরও বেশি। আমেরিকার কৃষি দপ্তরের অধীন ‘গ্লোবাল এগ্রিকালচারাল ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক’-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ-বছর ভারতে গম উৎপাদনের সম্ভাবনা ১১০ মিলিয়ন টন। বছরের গোড়ায় গুদামজাত দানা-শস্যর পরিমাণ ছিল ৯.৫ মিলিয়ন টন। চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রেও চিন্তার কারণ নেই। চলতি বছরের (২০২৩-’২৪) মিল-উৎপাদিত ১২৭ মিলিয়ন টন এবং বছরের শুরুতে গুদামজাত ২৯ মিলিয়ন টন যোগ করলে মোট সরবরাহের পরিমাণ ১৫৬ মিলিয়ন টন। দেশের খাদ্য সুরক্ষা আইনের অধীন ও সরকারের জাতীয় খাদ্য-সংক্রান্ত অন্যান‌্য যে-প্রকল্প আছে, সব মিলিয়ে ২৫-২৬ মিলিয়ন টন গমের প্রয়োজন। বাকিটা দেশের অভ‌্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা মেটানোর জন্য।

এই অনুকূল অবস্থা সত্ত্বেও ভারত এখনও গম রপ্তানির উপর ‘নিষেধাজ্ঞা’ জারি রেখেছে। এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে প্রতিবেশী বাংলাদেশ। দেশের অভ‌্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে এবং বাজারদর নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রতি বছর বাংলাদেশকে গড়ে প্রায় ৭ মিলিয়ন টন গম আমদানি করতে হয় আর এর ৭০-৭৫ শতাংশ যায় ভারত থেকে। মূলত দু’টি কারণে অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতে গমের দাম কম আর নিকটতম প্রতিবেশী হওয়ায় পণ্য পরিবহণের খরচও অনেক কম।

রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা চালু থাকায় বাংলাদেশকে কানাডা, রাশিয়া, ইউক্রেন ও অস্ট্রেলিয়া থেকে গম আমদানি করতে হচ্ছে, তবে চড়া দাম ও পরিবহণ ব‌্যয় অনেক বেশি পড়ে বলেই গম আমদানির ক্ষেত্রে ভারতের উপর বাংলাদেশের নির্ভরতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে যে-পরিমাণ গম উৎপন্ন হয়, তাতে মোট চাহিদার ১৫ শতাংশ মেটানো সম্ভব। বাকিটা, প্রায় ৭ মিলিয়ন টনের মতো, আমদানি করে মেটাতে হয়। বছরের শুরুতে গুদামজাত অনুমিত প্রায় ৮.৬৩ লক্ষ টন ও আনুমানিক ১ মিলিয়ন টন উৎপাদন ছাড়াও ২০২৩-’২৪ বিপণন বছরে বাংলাদেশকে ৬ মিলিয়ন টনের মতো গম আমদানি করতে হবে।

[আরও পড়ুন: নজরুলের ছবি রাখা যাবে না হিন্দু নাটমন্দিরে! আমাদের প্রগতিই রুদ্ধ হয়ে রয়েছে?]

স্বাচ্ছন্দ‌্যম‌ূলক উদ্বৃত্ত থাকা সত্ত্বেও রপ্তানির উপর থেকে ‘নিষেধাজ্ঞা’ সরাতে মোদি সরকার দ্বিধাগ্রস্ত কেন? রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি লোকসভার নির্বাচন। তারও আগে এই বছর পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন। রাজনৈতিক দিক থেকে এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে অভ‌্যন্তরীণ বাজারে গমের মতো অপরিহার্য জিনিসপত্রের দাম যাতে না বাড়ে, মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকার রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে চাইছে না বলে মনে করা হচ্ছে।

এই ধরনের রপ্তানিমূলক নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল থেকে মুক্ত থাকার জন্য বাংলাদেশ সরকার কয়েক মাস আগেই মোদি সরকারের কাছে কিছু অপরিহার্য পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ‘নিরাপদ সরবরাহ’ বা ‘কোটা’ পদ্ধতি চালু করার প্রস্তাব দিয়েছে। এর ফলে ভবিষ্যতে কোনও ধরনের বাণিজ্যগত নিষেধাজ্ঞা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। যে যে পণ্যসামগ্রীকে এই তালিকাভুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে- সেগুলি হল ৪.৫ মিলিয়ন টন গম, ২ মিলিয়ন টন চাল, ১.৫ মিলিয়ন টন চিনি, ১.২৫ লক্ষ টন আদা, ৭ লক্ষ টন পেঁয়াজ, ৩০ হাজার টন মসুর ডাল, ১০ হাজার টন রসুন। যদিও ভারত সরকার এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি, তবে শোনা যাচ্ছে- প্রস্তাবে উল্লিখিত পণ্যসামগ্রীর পরিমাণ কমানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারকে বিবেচনা করতে বলা হয়েছে।

আলোচনা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমানের মত হল- ভারত থেকে গম, চিনি, ডাল, পেঁয়াজ প্রভৃতি অত্যাবশ্যক খাদ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা বা ‘কোটা পদ্ধতি’ চালু করার যে প্রস্তাব বাংলাদেশ সরকার দিয়েছে- তা বাংলাদেশের পক্ষে যথেষ্ট সুবিধাজনক হবে, কেননা আমদানির উপর হঠাৎ করে কোনও বিধিনিষেধ আরোপ করলেও ‘কোটা’ পদ্ধতি সেখানে ঢালের মতো কাজ করবে। তাছাড়াও গত কয়েক বছরে দুই দেশের মধ্যে সংযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধির সুযোগও অনেক বেড়ে গিয়েছে। অপরিহার্য পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এই বিশেষ সুবিধা চালু হলে দু’-দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতা আরও শক্তিশালী হবে। তাছাড়া এই ধরনের বোঝাপড়ার একটা মানবিক দিকও রয়েছে।

‘কোভিড ১৯’ অতিমারীর বিপর্যয় কাটিয়ে ‘শক্তিশালী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার’-এর পর আরও বড় ধাক্কার মুখে উন্নতিকামী অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ। একদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ডলারের ক্রমবর্ধমান সুদের হারের সঙ্গে সংগতি রেখে টাকার ক্রম-অবমূল্যায়ন, অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক লেনদেন। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ২৭টি দেশের সম্মিলন ইউরোপীয় ইউনিয়ন-সহ অন্যান্য প্রভাবশালী দেশগুলি রাশিয়ার আমদানি-রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করায় আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, সার, খাদ্যশস্যের মতো অপরিহার্য পণ্যর আকাশচুম্বী দাম বাংলাদেশকে এক গভীর বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে উন্নয়নমূলক কাজ আবার শুরু করার জন্য জন্য ‘আইএমএফ’ ৪.৪ বিলিয়ন ডলার দীর্ঘমেয়াদি (৪২ মাস) ঋণ মঞ্জুর করেছে। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা তহবিলের পরিস্থিতির ক্রমাবনতির প্রেক্ষিতে ‘আইএমএফ’ এর মধ্যেই প্রথম কিস্তিতে ৪৭৬ মিলিয়ন ডলার দিয়ে দিয়েছে। ‘আইএমএফ’-এর শর্তাবলি মেনে দেশের আর্থিক অবস্থাকে চাঙ্গা করার জন্য হাসিনা সরকারের এই ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্তকে এক ‘বুদ্ধিমান পদক্ষেপ’ বলে মনে করেন ড. রহমান। তিনি বলেন, ‘এর ফলে রাজস্ব এবং আর্থিক সংস্কার সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত, যে ব্যাপারে বহু বছর ধরে দেশের অর্থনীতিবিদরা বলে আসছিলেন, তা কার্যকর করতে সুবিধা হবে। আশা করা যায়, ‘আইএমএফ’-এর কর্মসূচি এবার প্রয়োজনীয় আর্থিক সংস্কারে কিছু গতি আনতে সাহায্য করবে।’ যদিও জ্বালানি ও বিদ্যুতের মাশুল বৃদ্ধির ফলে ভোক্তাদের আর্থিক চাপ বাড়তে পারে, কিন্তু আখেরে সামগ্রিকভাবে দেশ উপকৃত হবে। কিন্তু এই সঙ্গে ‘আইএমএফ’-এর নির্ধারিত কর্মসূচির বাইরে দেশের কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সরকারি সহায়তা চালিয়ে যেতে হবে। দু’টি প্রস্তাবই বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যসংকট মোচনের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
asamitabha@gmail.com

[আরও পড়ুন: জেলে আত্মহত্যাার চেষ্টা, নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে কে বাঁচিয়েছিল কুণাল ঘোষকে?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement