গাজার আল শিফা হাসপাতালকে সামরিক ঘাঁটি বানানো অবশ্যই যুদ্ধাপরাধের মধ্যে পড়ে। ইজরায়েলের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় আমেরিকা এবং ব্রিটেনেও। কিন্তু বিশ্বমঞ্চে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সাধারণ মানুষ যতই গর্জে উঠুক, ইজরায়েল কিন্তু তার লক্ষ্যে অবিচল। কলমে সুতীর্থ চক্রবর্তী
বিশ্বকাপের ফাইনালে প্যালেস্টাইনের সমর্থনে লেখা স্লোগান বুকে নিয়ে একেবারে মাঠের মধ্যে বিরাট কোহলির কাছে একজন দর্শকের পৌঁছে যাওয়া চমকে দিয়েছে দেশকে। মোতেরার স্টেডিয়ামের নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করতে ১০-১২ হাজার পুলিশ ও নিরাপত্তারক্ষীর নামার কথা আমরা কয়েক দিন ধরেই শুনে আসছিলাম। ওইরকম নিরাপত্তা বেষ্টনীর বলয়ে থাকা একটি মাঠে দর্শকের একেবারে বাইশ গজে পৌঁছে যাওয়া সত্যিই বিস্ময়কর। যে-দর্শকটি প্যালেস্টাইনকে মুক্ত এবং যুদ্ধ বন্ধ করার দাবি নিয়ে মাঠের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলেন, তিনি ভারতীয় নন।
চিনা বাবা ও ফিলিপিনো মায়ের সন্তান ওই দর্শক অস্ট্রেলীয় নাগরিক। বিশ্বমঞ্চে প্যালেস্টাইনের দাবিকে জোরালোভাবে পৌঁছে দিতে ওই অস্ট্রেলীয় সমর্থক যে জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন, তা বলা বাহুল্য।
এবারের ক্রিকেট বিশ্বকাপে প্যালেস্টাইনের দাবিকে তুলে ধরার ঘটনা অবশ্য ফাইনালেই প্রথম ঘটেনি। ইডেনে বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচে স্টেডিয়ামে দু’-একজন দর্শককে প্যালেস্টাইনের পতাকা হাতে দেখা গিয়েছে। কয়েক দিন আগে আমেরিকার বিখ্যাত হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে একজন ছাত্র ক্লাসের মধ্যে প্যালেস্টাইনের দাবিতে সরব হয়েছিল। সেই ভিডিও ভাইরাল সোশাল মিডিয়ায়। লন্ডনের রাজপথে প্যালেস্টাইন সমর্থকদের বিধ্বংসী মেজাজ সম্প্রতি দেখা গিয়েছে। যার জেরে নিজের পদ খোয়াতে হয়েছে ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। গত একমাসের যুদ্ধে দুনিয়াজুড়ে সমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রে যে হামাস ইজরায়েলকে পিছনে ফেলেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
[আরও পড়ুনা: ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধে কি গদি টলমল বাইডেনের?]
কয়েক দিন ধরে গাজার বৃহত্তম আল শিফা হাসপাতালে যা ঘটে চলেছে, তাতে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় আমেরিকা ও ব্রিটেনেও। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আমেরিকা ও ব্রিটেনের সরকার ইজরালের পাশে সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে রয়েছে। কিন্তু আল শিফার ঘটনাকে যুদ্ধাপরাধ বলতে তারাও পিছপা হচ্ছে না। হাসপাতালকে সামরিক ঘাঁটি বানানো অবশ্যই যুদ্ধাপরাধের মধ্যে পড়ে। ইজরায়েলের তরফে বারবার বলা হচ্ছিল, আল শিফা হাসপাতালের নিচে সুড়ঙ্গের মধ্যে রয়েছে হামাসের মূল সামরিক ঘাঁটি। সেখানে আশ্রয় নিয়ে রয়েছে হামাসের সমস্ত জঙ্গি নেতারা। হাসপাতালের নিচে সুড়ঙ্গে জড়ো করা হয়েছে বিপুল অস্ত্রশস্ত্রও। ইজরায়েল এ ব্যাপারে ২০১৪ সালে দেওয়া আমেরিকার একটি গোয়েন্দা তথ্যকেও হাতিয়ার করেছে। ওই গোয়েন্দা তথ্যে দাবি করা হয়েছিল, আল শিফা হাসপাতালকে হামাস সামরিক ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করছে। আল শিফা হাসপাতালের নিচের সুড়ঙ্গে হামাসের যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণকক্ষও রয়েছে।
হাসপাতালকে সামরিক ঘাঁটি বানানো হলে সেটা অবশ্যই যুদ্ধাপরাধ। সেক্ষেত্রে বিরোধী পক্ষেরও অধিকার থাকে হাসপাতালে বিপক্ষের ঘাঁটিতে হামলা চালানোর। কিন্তু যুদ্ধের আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে হাসপাতালে হামলা চালালেও তা অতি সতর্কতার সঙ্গে চালাতে হবে। এক্ষেত্রে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইরাকের মসুলে আইএস জঙ্গির গাঁটিতে হামলার প্রসঙ্গ উল্লেখ করছে। মসুলের একটি বড় হাসপাতালে ইসলামিক জঙ্গি সংগঠন আইএস তাদের সামরিক ঘাঁটি বানিয়েছিল। সেই ঘাঁটিতে হামলা চালানোর আগে মার্কিন বাহিনী হাসপাতালটিকে সম্পূর্ণ রোগী ও চিকিৎসক মুক্ত করে। দীর্ঘ সময় ধরে রোগীদের, চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের হাসপাতাল ছাড়ার রাস্তা তৈরির পরে মার্কিন বাহিনী জঙ্গিদের খোঁজে হাসপাতালে ঢুকেছিল। কিন্তু ইজরায়েল আল শিফা হাসপাতালে হামলা চালানোর জন্য যথেষ্ট সতর্কতা গ্রহণ করেনি বলেই সর্বত্র অভিযোগ। গাজার বৃহত্তম হাসপাতাল আল শিফায় ইজরায়েলি হামলার সময় হাজার-হাজার রোগী ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল। হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের দাবি ছিল, সেখানে কোনও হামাস জঙ্গি নেই। কিন্তু ইজরায়েল জেদ ধরে থাকে যে, রোগী ও সাধারণ মানুষকে মানব ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছে হামাসের সমস্ত জঙ্গি নেতারা। আল শিফায় ইজরায়েলি বাহিনীর হামলার পর সেখানে সদ্যোজাতদের মৃতদেহের ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে অসংখ্য রোগীর। হাসপাতাল ছেড়ে পালাতে হয়েছে বহু মানুষকে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ইজরায়েল প্রমাণ করতে পারেনি যে, আল শিফায় হামাসের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। সামান্য কয়েকটি অস্ত্র হাসপাতাল চত্বরে পড়ে থাকার ছবি প্রকাশ্যে আনা হলেও, হাসপাতালের সুড়ঙ্গে অস্ত্রভাণ্ডারের হদিশ মেলেনি। বরং আল শিফা হাসপাতালে মৃত শিশু ও অসহায় রোগীদের ছবি বিশ্বজুড়ে তোলপাড় ফেলেছে। এই ঘটনাকে যুদ্ধাপরাধ বলে চিহ্নিত করছে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ।
যুদ্ধে যবে থেকে বিমানবাহিনীর ব্যবহার শুরু হয়েছে, তবে থেকেই নিরীহ মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। একদা যুদ্ধ হত দু’-পক্ষের সেনার মধ্যে। ফাঁকা মাঠে বা মরুভূমির মধ্যে দু’-পক্ষের বাহিনী যুদ্ধ করত। তাতে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হত না। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর সময় থেকে যখন বিমানবাহিনীর ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হল, তখন থেকেই সাধারণ মানুষও পৌঁছে গেল যুদ্ধের ফ্রন্টে। ইদানীং যুদ্ধে সাধারণ মানুষের জীবন থেকে শুরু করে ঘর, বাড়ি, সম্পত্তি সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে। ইজরায়েল বারবার দাবি করছে যে, তাদের যুদ্ধ হামাসের সঙ্গে, প্যালেস্টাইনের সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ নয়। সাধারণ প্যালেস্তিনীয়দের যে ক্ষতি হচ্ছে, তা ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’। কিন্তু সেটা কি বাস্তব? পুরো উত্তর গাজা ইজরায়েলি বিমান হানায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে অসংখ্য বহুতল। ধুলোয় মিশে গিয়েছে একটার-পর-একটা জনপদ। উত্তর গাজা থেকে প্যালেস্তিনীয়দের দক্ষিণ গাজায় সরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। দক্ষিণ গাজায় অল্প একটু ভূখণ্ডে ২০ লক্ষ মানুষের ভিড় তৈরি হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমে জানা গিয়েছে, দক্ষিণ গাজাতেও ইজরায়েলি বাহিনী আকাশ থেকে লিফলেট ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে সরে যেতে বলছে। অর্থাৎ, পুরো গাজা ভূখণ্ডটি ইজরায়েল জনমানব শূন্য করে দিতে চাইছে।
গাজা ভূখণ্ডের ২৩ লক্ষ বাসিন্দা এখন কোথায় যাবে, প্রশ্ন সেইখানে। ২৩ লক্ষ প্যালেস্তিনীয় শরণার্থীর দায়িত্ব প্রতিবেশী মিশর বা জর্ডন, কেউ নিতে রাজি নয়। সব মিলিয়ে এক অসহনীয় অবস্থা। আল শিফা হাসপাতালের পর ইজরায়েল হামলা করেছে রাষ্ট্রসংঘ পরিচালিত একটি স্কুলবাড়ির মধ্যে চলতে থাকা শরণার্থী শিবিরে। যেখানে নিহত হয়েছেন একাধিক সাংবাদিক।
বিশ্বমঞ্চে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সাধারণ মানুষ যতই গর্জে উঠুক, আমেরিকা প্রকাশ্য বিবৃতিতে যতই যুদ্ধাপরাধের নিন্দা করুক, ইজরায়েল কিন্তু তার লক্ষ্যেই কাজ করে চলেছে। হামাসের হামলার পর ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ‘পশ্চিম এশিয়ার মানচিত্র বদলে দেব।’ অল্প কিছু দিনের মধ্যে যদি গাজা ভূখণ্ড সম্পূর্ণ জনমানবহীন হয়ে যায়, তাহলে দেখা যাবে নেতানিয়াহুর দাবি সত্য হয়েছে। প্যালেস্তিনীয়দের দুর্গতির কিন্তু কোনও সমাধান হবে না। বিশ্বমঞ্চে যাবতীয় হইচই ও প্রতিবাদ সার!