shono
Advertisement

মুঘল থেকে মোদি সাম্রাজ্য, দিল্লির ভুল ধরিয়ে দিয়েছে দাক্ষিণাত্যে

’২৪-এ মোদি সাম্রাজ্যের পতনের পটভূমি প্রস্তুত।
Posted: 11:54 AM May 18, 2023Updated: 11:55 AM May 18, 2023

কর্ণাটকে বিজেপির পরাজয়ের পর রাহুল গান্ধী মন্তব্য করেন, ‘ঘৃণার বাজারে ভালবাসার জয়।’ খুব তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য। তিনি বলতে চেযেছেন, বিজেপি ‘হেট স্পিচ’ রাজনীতি করেছে, কর্নাটকের মানুষ তার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। হিন্দুত্বের প্রচার মানে মুসলমানদের আক্রমণ, এই তত্ত্ব কর্ণাটকিরা খারিজ করে দিয়েছে। শুধু মুসলমান নয়, হিন্দুরাও বিজেপিকে ভোট দেয়নি। মুঘল আমলেও হিন্দু বিদ্বেষ বিপক্ষে গিয়েছিল ঔরঙ্গজেবের। কলমে কিংশুক প্রামাণিক

Advertisement

মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ কী? মনে পড়ছে ইতিহাস পরীক্ষার প্রশ্নটা?
কাবুল, কান্দাহার থেকে লাহোর, দিল্লি, কন্নড়, তেলেঙ্গানা, বাংলা- সুবিশাল সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল একদিন। দীর্ঘ সময় রাজত্ব করার পর কেন প্রবল পরাক্রমী মুঘলরা দিল্লির ক্ষমতাচ্যুত হল, তার কারণ অনেক।

ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট আর্থার স্মিথ অবশ্য বিস্ময় প্রকাশ করে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘সুবিশাল এই সাম্রাজ্য এতদিন টিকে ছিল কী করে?’ অর্থাৎ, একটি বড় সাম্রাজ্য টিকতে গেলে যে যে উপাদান থাকা উচিত, তা যে বাবর থেকে ঔরঙ্গজেব, দীর্ঘ অধ্যায়ে ছিল না, তা তিনি বলতে চেয়েছিলেন।
সেই ব্যাখ্যা অন্য। এখানে নয়। বরং মুঘলদের পতনের মূল তিনটি কারণ তুলে ধরা যেতে পারে-
এক, সাম্রাজ্যের বিশালতা।
দুই, হিন্দুবিদ্বেষ। দেশীয় রাজাদের সরিয়ে ক্ষমতা দখল।
তিন, দাক্ষিণাত্য দখলের চেষ্টা।

ইতিহাসবিদরা মনে করেন, বিন্ধ‌্য পর্বত পার করে দক্ষিণ ভারতের দিকে মুঘলদের অগ্রসর হওয়াটা ছিল ভুল। তেলেঙ্গানার গোলকুন্ডা ও কর্ণাটকের বিজাপুর রাজ্য দখল করতে গিয়ে অনেকটাই শক্তিক্ষয় হয়। মুঘল বাহিনীর স্ট্র্যাটেজি ছিল রাজ্য বিস্তার করে ক্ষমতা প্রদর্শন, স্থানীয় ধনসম্পদ লুঠ, কর আদায় মারফত কোষাগার ভরা ও বিদ্রোহী মারাঠাদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলা। কার্যক্ষেত্রে এই নীতিতেই ডুবতে হয় ঔরঙ্গজেবকে। শাসকের অত্যাচার যদি সীমা ছাড়ায়, তখন শোষিত শ্রেণি একজোট হয়ে ওঠে। শত্রুর শত্রু হয় মিত্র। যুগে যুগে তেমনই হয়েছে। রাশিয়ার জার থেকে জার্মানির হিটলার, ইতালির মুসোলিনি থেকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম- এক ইতিহাস কথা।

[আরও পড়ুন: এই অভিমন্যু শত্রুদের চক্রব্যূহ ভাঙতে শিখে গিয়েছে ]

শুধু সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রে নয়, রাজনীতিতেও এ কথা দস্তুর। ইন্দিরা গান্ধী দেশকে অনেক কিছু দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর জমানার জরুরি অবস্থার অত্যাচারের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ এক হয়েছিল। সমস্ত বিরোধীরা জোট গড়ে ১৯৭৭ সালে দিল্লিতে পরিবর্তন এনে দেয়। রাজীব গান্ধীও প্রচুর ভুল করেন। একের পর এক রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে চেয়েছিলেন। ৪০৩ আসন নিয়েও তাঁকে পাঁচ বছর পর ক্ষমতা হারাতে হয়েছিল।

ইতিহাসের পাতা উলটে দেখলাম, মুঘল আগ্রাসনে অতিষ্ঠ বিজাপুর, গোলকুন্ডা ও মারাঠা রাজ্যেও সেদিন মুঘল-বিরোধী ‘জোট’ গড়ে ওঠে। দিল্লির অহংকার তারা চূর্ণ করে। প্রবল লড়াই করে বিজাপুর, গোলকুন্ডার শাসকরা হয়তো পরাজিত হয়েছিল, কিন্তু তাদের সৈন্যরা যোগ দেয় মারাঠা শিবিরে। সেই ‘জোট’ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই শামিল হয়েছিল। সবার লক্ষ‌্য ছিল ‘মুঘল হঠাও’।এই অবধি লিখে থামতে হল।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কি শোনা যায় পানিপথের প্রান্তরে? মুঘলদের মতো নরেন্দ্র মোদিরও কি ভুল হল বিন্ধ‌্য পর্বত পেরিয়ে মারাঠা তথা দাক্ষিণাত্যের দিকে অগ্রসর হওয়ায়? কর্ণাটক বিধানসভারও ভোটে দিল্লির শাসকের পর্যুদস্ত হওয়ার পর একথা সামনে এসে গিয়েছে। যেভাবে কর্ণাটকের সাধারণ মানুষ শাসক বিজেপিকে হারাল, তা এক কথায় ‘বিদ্রোহ’। কোন দল জিতল, সে বড় কথা নয়, বিজেপির বিরুদ্ধে ‘জোট’ গড়ে ভোট দিল ৬৭ শতাংশ মানুষ।

বিজেপির এই পরাজয়ের কারণ নিয়ে দেশে হাজার হাজার প্রতিবেদন লেখা হয়েছে। আরও হবে। আশ্চর্য হল, মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলির সঙ্গে কেমন মিল। মূলত উত্তর ও মধ্য ভারতের দল বিজেপির ২০১৮ সালে সহযোগীদের সাহায্যে প্রায় গোটা দেশ দখল করে নিয়েছিল। উত্তরে পাঞ্জাব, পূর্বে বাংলা ও দক্ষিণে কেরল, তামিলনাড়ু ছাড়া সব রাজ্যই তাদের হাতে এসে গিয়েছিল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। এমনকী, ভূস্বর্গ কাশ্মীরেও তৈরি হয়েছিল মোদির পছন্দের সরকার। সময়ের কারণেই বিশাল সেই সাজানো বাগান শুকিয়ে যাচ্ছে। আজ দক্ষিণ ভারতে বিজেপি শূন্য। বাংলা, বিহার, ওড়িশা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, এমনকী, দিল্লিতেও পদ্মফুল নেই! মোদ্দাকথা, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট ও বিধায়ক ভাঙিয়ে দখল করা মধ্যপ্রদেশ ছাড়া কোনও বড় রাজ্য বিজেপির হাতে নেই। অসম, হরিয়ানা, ত্রিপুরার মতো কিছু ছোট রাজ্যে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী রয়েছে।

রাজনীতির পাশা খেলার চাল খানিকটা ওস্তাদের শেষ রাতের মারের মতো। তাই ২০১৯ সালের পুলওয়ামা ওয়েভের মতো কোনও সহানুভূতির ঝড় ২০২৪ বিজেপি বৈতরণি পার করে দেবে কি না কেউ জানে না, কিন্তু বাস্তব বলছে, কর্ণাটকের ধাক্কায় ভয় ধরেছে গেরুয়া শিবিরে। এই প্রথম তারা ভাবতে শুরু করেছে, দিল্লির আসন টলমল। দিল্লির চারপাশ দিয়ে একে একে নানা রাজ্য বিরোধীদের হাতে চলে গিয়েছে। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়েও কি তাহলে একই হাওয়া বইছে? সেখানে যে বিধানসভা ভোট আসন্ন।

কর্ণাটকে বিজেপির পরাজয়ের পর রাহুল গান্ধী মন্তব্য করেন, ‘ঘৃণার বাজারে ভালবাসার জয়।’ খুব তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য। তিনি বলতে চেয়েছেন, বিজেপি ‘হেট স্পিচ’ রাজনীতি করেছে, কর্নাটকের মানুষ তার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। হিন্দুত্বের প্রচার মানে মুসলমানদের আক্রমণ, এই তত্ত্ব কর্নাটকিরা খারিজ করে দিয়েছে। শুধু মুসলমান নয়, হিন্দুরাও বিজেপিকে ভোট দেয়নি। মুঘল আমলেও হিন্দু বিদ্বেষ বিপক্ষে গিয়েছিল ঔরঙ্গজেবের।

মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের আর একটি কারণ উত্তরাধিকার সমস্যা। ঔরঙ্গজেবের পুত্রদের সিংহাসন নিয়ে লড়াই। বিজেপিতে এখনও সেই সমস্যা নেই। কারণ, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্ব অবিসংবাদিত। তাঁকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ নেই। তাঁর ফেলে যাওয়া পাদুকা পায়ে গলাবে কে? অমিত শাহকে বাকিরা মানবে, না কি যোগী অাদিত্যনাথের উত্থান মেনে নেবেন শাহরা? এই প্রশ্নও আগামী দিনে থাকবে।

স্বভাবতই কর্ণাটক পর্বের পর ফের একবার জাতীয় রাজনীতিতে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের পটভূমি প্রস্তুত বলে মনে করছে সবাই। বিজেপির প্রচারের ট্রাম্প কার্ড প্রধানমন্ত্রীই। কর্নাটকে তিনিই ছিলেন প্রচারের ত্রাতা। ৪৬টি সমাবেশ, ২৫ কিলোমিটার রোড শো করেন মোদি। ছ’মাসে ১১ বার ওই রাজ্য সফর করেন। কোনও লাভ হয়নি। তথাকথিত ‘মোদি ম্যাজিক’ কাজ করেনি। বিজেপি গোহারা হেরে গিয়েছে। একটা রাজ্য হাতছাড়া হওয়া বড় কথা নয়। গণতন্ত্রে এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু চিন্তা অন্য জায়গায়। বিজেপির প্রচারের প্রধান মুখ প্রধানমন্ত্রীর ইমেজ কাজ করেনি কর্ণাটকে। লোকসভা ভোটের আগে এই চিত্র ভয়ের তো বটেই।

মুঘলরা জোর করে একের-পর-এক রাজত্ব দখল করত। পাঁচ বছর আগে এই কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশেও জোর করে দখল করে বিজেপি। সেখানে বিধানসভা নির্বাচনে গরিষ্ঠতা মেলেনি। কিন্তু বিধায়ক কিনে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল বিরোধীদের সরকার। দখলের চেষ্টা হয়েছিল বিহার, ঝাড়খণ্ড, বাংলা, দিল্লি, রাজস্থানেও। জোর করে রাজ্য দখলের রোগ যেমন পতন ঘটিয়েছিল মুঘলদের, আজ তেমনই প্রতিশোধ নিল কর্ণাটকের মানুষ। পরিশেষে বলা যায়, রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের পরিবেশ পরিস্থিতি এক নয়। যে ক্ষতে মুঘলরা প্রলেপ দিতে পারেনি, সেটা গণতন্ত্রে মোদি পারবেন না, এমন মনে করার কারণ নেই।

এক সিদ্ধান্তে হাওয়া ঘুরতেও পারে। কিন্তু পরিস্থিতি বড় জটিল। দিল্লিকে ভুল ধরিয়ে দিয়েছে কর্ণাটক। সেই আবহে রাজনীতির পাটিগণিত বলছে, ’২৪-এ মোদি সাম্রাজ্যের পতনের পটভূমি প্রস্তুত। তদুপরি বিরোধীদের মনে রাখতে হবে, কুলোর বাতাস দিয়ে বিজেপিকে হারানো যাবে না। কারও একার পক্ষেও সম্ভব নয়। দরকার বিজাপুর, গোলকুন্ডা, মারাঠা সৈন‌্যদের মতো দেশজুড়ে ‘জোট’।

[আরও পড়ুন: আমেরিকায় ডারউইন কোণঠাসা, আর ভারতে? ]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement