পুরুষ সম্পর্কিত ঔদার্যটি আমাদের সমাজের বড়ই বেশি। আমরা ‘দুষ্টু’ ছেলেপিলেদের করা কুকর্ম বড্ড সহজে ক্ষমা করি। আর, যেসব মেয়ের সঙ্গে ওসব যন্ত্রণাকর ব্যাপার ঘটে যায়, সেই মেয়েদের হৃদয়ে, মনে, মননে দগদগে ক্ষত থেকে যায়– কে ভাবে তাদের কথা? লিখছেন যশোধরা রায়চৌধুরী।
ভোটের মরশুম এলে পুরুষ-দৃষ্টিতে নারীর উপস্থাপনা সংক্রান্ত প্রশ্নগুলো আবার নতুন করে জেগে ওঠে।
এই কথোপকথনের যেন অন্ত নেই। বহু দিন ধরে চলেছে, আর বহু দিন চলবেও। নারীবিরোধী এবং অসাংবিধানিক ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক রাজনৈতিক দল থেকে অন্য রাজনৈতিক দলে চাপানউতোর চলবে। যেন ‘এ বলে আমায় দেখ ও বলে আমায় দেখ’ পরিস্থিতি। বিজেপি প্রার্থী হেমা মালিনীকে নিয়ে হরিয়ানার এক র্যালিতে কংগ্রেস নেতা রণদীপ সূর্যেওয়ালার করা কুৎসিত মন্তব্যের জেরে (একজন ফিলিম স্টারকে নিয়ে একটু-আধটু ‘অবজেক্টিফিকেশন’ তো জায়েজ, তাই না?) ‘জাতীয় নারী কমিশন’ নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হল। এই অপবাদের প্রেক্ষিতে সূর্যেওয়ালা ক্ষমাযাচনা করে যে-উত্তরটা দিলেন, সেটাও চমৎকার! বললেন, উনি ধর্মেন্দ্রজির পত্নী বলে ওঁকে সম্মান করি, আমাদের সবার ঘরের বউ উনি। মানে, হয় মা, নয়তো বউমার সেই পুরনো কসরতে আটকে যাওয়া। পুরনো ঘটনা মনে আসে, লালুজির সেই কথা, বিহারের রাস্তাগুলিকে সব হেমা মালিনীর গালের মতো মসৃণ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি।
নিম্নমানের নতুন-নতুন সব ‘বেঞ্চমার্ক’ তৈরি হচ্ছে রোজকার রাজনৈতিক সভায়। নারীবাদী অ্যাক্টিভিস্ট রঞ্জনা কুমারীর মন্তব্য, একই রাজনৈতিক মঞ্চেই মেয়ে রাজনীতিকদের রোজ কী ধরনের মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হয় তাদের পুরুষ সহযোদ্ধাদের থেকে, সেটা লক্ষ করলেই বোঝা যাবে ব্যাপারটা। উল্টোদিকের বিরোধী পার্টির মুখের আগল তো পরের কথা। কর্নাটকের কংগ্রেস বিধায়ক শামানুর শিবশঙ্করাপ্পা যেমন বিজেপির গায়ত্রী সিদ্ধেশ্বরা সম্পর্কে বলে বসলেন ‘ওঁকে রান্নাঘরেই মানায়।’ দিলীপ ঘোষ অনুরূপ আরেক কাণ্ডে বিপাকে পড়লেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর পারিবারিক ইতিহাস তুলে।
[আরও পড়ুন: ‘আনুগত্যের নিরিখে নিয়োগ’, রাহুলের মন্তব্যের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের দাবি ২০০ উপাচার্যের]
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা সুশীলা রামস্বামী এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন, এখনও রাজনীতিতে মেয়েদের পদচারণা অনেকটা কম, তাই নারী পুরুষের সমকক্ষ হয়ে ওঠার ঢের দেরি। ‘মেয়ে’ বলে আলাদা করে তাকে ‘টার্গেট’ করা, খুবই সহজ। এখনও রাজনীতি ক্ষেত্রের মেয়েদের ‘জঁাহাবাজ মেয়ে’ হিসাবে দেখাই দস্তুর। সেই যে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির মেয়েটি, সুচিত্রা সেনের অভিনীত, যে পুরুষদের গিয়ে হম্বিতম্বি করে এসেছিল? ‘প্রতিবাদী মেয়ে’ বড়ই জঁাহাবাজ।
রাজনীতি কেন, অন্যান্য ক্ষেত্র-ই বা কম কীসে যায়? পারিবারিক বলয় থেকে রাজনীতির মঞ্চ– সর্বত্র ছবি এক। নাটকের ক্ষেত্রে তো বহু দিন মেয়েরা স্টেজ ভাগ করে নিচ্ছেন পুরুষ অভিনেতাদের সঙ্গে। হ্যঁা, তবে তঁারাও তো কম ‘জঁাহাবাজ’ নন। নাটক এক ‘শরীরী ক্ষেত্র’। শরীরের সব বাধা ভেঙে নাটকে নেমেছ। ‘নামা’ এই ক্রিয়াপদ এখনও অভিনয় করতে আসা মেয়েদের সঙ্গী। সিনেমা-থিয়েটারে নামা। মানে, সমাজমান্য আচরণ যেন নয়। কাজেই তাকে তো ‘অভিনয় শিখিয়ে দিচ্ছি’-র নামে একটু-আধটু ‘গায়ে অবাঞ্ছিত হাত দেওয়া’ জায়েজ, তাই না?
তবু, সুরাহা হল না যে-প্রশ্নের, তা হল, এই যে পুলিশের হেফাজতে গিয়েছেন যিনি, মেয়েদের অভিযোগের ভিত্তিতে, তিনি যত গুণী-ই হোন, পুরোদস্তুর শাস্তি ভোগ করার আগে কীভাবে ক্ষমাশীল ও ‘ইনক্লুসিভ’ হয়ে যায় তঁার প্রতি তঁার পুরুষ সহকর্মীরা? পুরুষ বলেই কি? এখনও তাই ঘুরে-ঘুরে উঠে আসবে নতুন বিতর্ক। নারী নিগ্রহে অভিযুক্ত একজনকে নাটকের মঞ্চে নিয়ে আসা নিয়ে কয়েকটি মেয়ে সোচ্চার। বাকিদের, উঁচু পীঠে আসীন নাট্যগুরুদের, আশ্চর্য নীরবতার রাজনীতি। প্রতিবাদ যখন অনেক বেড়ে ওঠে, জল ঘুলিয়ে ওঠে, তখন আবার ঘটা করে ক্ষমা চেয়ে ‘ভুল’ স্বীকার করে ঘটনার গুরুত্ব কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা। এর মধ্যে হয়তো লুকিয়ে আছে সেই পুরনো ভাবনা, সোনার আংটি বঁাকা হলেই বা কী, সোজা হলেই বা কী!
[আরও পড়ুন: ভোটের আগে তপ্ত আমেঠি! কংগ্রেস কার্যালয়ে দুষ্কৃতী হামলা, চলল ভাঙচুর]
পুরুষ-সম্পর্কিত ঔদার্যটি আমাদের সমাজের বড়ই বেশি। আমরা ‘দুষ্টু’ ছেলেপিলেদের করা কুকর্ম বড্ড সহজে ক্ষমা করি। আর, পাশাপাশি যে মেয়েদের সঙ্গে ওসব যন্ত্রণাকর ব্যাপার ঘটে যায়, সেই মেয়েদের হৃদয়ে, মনে, মননে দগদগে ক্ষত থেকে যায়... কে ভাবে তাদের কথা। তারা নিজেরা চিৎকার করে উঠে ‘আমার লাগছে’ বলাটাই একমাত্র উপায়। তাও, ক্রমাগত। থামলে চলবে না। থামলেই, অদৃশ্য, প্রান্তিক মেয়েদের যন্ত্রণা ও মুখ ফুটে বলার পরিসর চলে যাবে আড়ালে। কারণ, এই সমাজে পুরুষের খুঁত, বিশেষত গুণী পুরুষের খুঁত ধামাচাপা দেওয়ার দস্তুর এখনও দস্তুরমতো বলবৎ।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাহিতি্যক
yashodhara1965@gmail.com