প্রথম পর্বের ভোটের হার ও গো-বলয়ের ভোটারদের মতিগতি দেখে বিরোধীরা উৎফুল্ল। তবে কি টানা দশ বছরের রাজত্বে ‘মোদি ম্যাজিক’ ভ্যানিশ? প্রধানমন্ত্রীর আবেদন আর দোলা দিচ্ছে না? একঘেয়েমি এসে গিয়েছে? হ্যাটট্রিকের তাগিদের এখানেই ইতি? লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
দিনের শুরু দেখে বাকি সময় কেমন যাবে হয়তো বলা যায়। কিন্তু সবক্ষেত্রে ওই ফরমুলা কাজ দেয় না। যেমন, প্রথম দফার ভোট দেখে বলা কঠিন বাকি ছ’দফার চরিত্র কেমন হবে। যদিও এবারের ভোটপর্বের প্রথম দফার পর সেই চর্চা দারুণভাবে শুরু হয়েছে। বিজেপি-বিরোধী শক্তি তো আশায় বুক বেঁধে বলাবলি শুরু করেছে, নরেন্দ্র মোদির জুমলাবাজির দিন শেষ।
প্রথম পর্বের ভোটের হার ও গো-বলয়ের ভোটারদের মতিগতি দেখে বিরোধীরা সত্যিই উৎফুল্ল। রাহুল গান্ধী বুক ঠুকে বলে দিয়েছেন, বিজেপি ১৫০ আসন পেরবে কি না সন্দেহ। ৪০০ পার বহু দূরের তারা, ১৫০-র গণ্ডি পার হতেই তারা হিমশিম খাবে। এই চর্চার কারণ অনেক। ২১টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের যে ১০২টি কেন্দ্রে ভোট ১৯ এপ্রিল হয়ে গেল, ২০১৪ ও ’১৯ সালে সেই কেন্দ্রগুলিতে মানুষ হইহই করে ভোট দিয়েছিল। মনে রাখতে হবে, তখনও ভোট হয়েছিল গ্রীষ্মকালে। তা সত্ত্বেও মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও বিহারে প্রথম থেকেই বিপুল উদ্দীপনা ছিল। এবারে তা চোখে পড়েনি। বিজেপির ‘গড়’ এসব রাজ্যে গতবারের তুলনায় এবার ভোট কম পড়েছে। কোথাও কোথাও তো আট শতাংশ পর্যন্ত কম! এবার ভোটের গড় হার ৬৩ শতাংশে তুলতে নির্বাচন কমিশনকে মাঝরাত পর্যন্ত হিমশিম খেতে হয়েছে। তবুও গতবারের তুলনায় গড় সমান সমান করা যায়নি। তবুও যে তা ৬৩ শতাংশ ছুঁয়েছে তার কৃতিত্ব পশ্চিমবঙ্গের তিন ও ত্রিপুরার একটি আসনের ভোটারদের।নাহলে গড় কোথায় দঁাড়াত কে জানে?
[আরও পড়ুন: ইলেক্টোরাল বন্ড ‘কেলেঙ্কারি’র তদন্তে SIT গঠনের দাবি, মামলা সুপ্রিম কোর্টে]
ভোটের হার ও উদ্দীপনাহীনতা নিয়েই গত ক’দিন ধরে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিরোধীরা যতখানি উৎফুল্ল, বিজেপি কতটা নিরাশ, নিশ্চিত নয়। কিন্তু তারাও বুঝতে পারছে, আগের দু’বার মানুষ যে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে বুথে বুথে হাজির ছিল, এবার প্রথম দফায় তা দেখা যায়নি। পশ্চিম মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, বিহার বা মধ্যপ্রদেশে ভোটের লাইনে মুসলমানদের যত দেখা গিয়েছে, হিন্দুদের ততটা দেখা যায়নি। কেন এমন আচরণ! বিজেপিকে তা ভাবাচ্ছে। অনুমান, সেজন্যই হয়তো হিন্দুমনে হিন্দুত্ববাদ জাগাতে নরেন্দ্র মোদি কংগ্রেসের ইস্তাহার ও মনমোহন সিংয়ের বক্তব্য বিকৃত করেছেন।
সে যাই হোক, প্রশ্ন উঠছে ‘মোদি ম্যাজিক’ নিয়ে। তবে কি টানা দশ বছরের রাজত্বে ম্যাজিক ভ্যানিশ? তবে কি মোদির আবেদন আর দোলা দিচ্ছে না? একঘেয়েমি এসে গিয়েছে? সেজন্য হ্যাটট্রিকের তাগিদ জাগছে না?
এই প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর এখনও নেই। একদফা ভোট দেখে সেই উত্তর পাওয়ার কথাও নয়। তাই বিরোধীরা এখনই যে উপসংহারে যেতে চাইছে, তা অতি সরলীকৃত। তারা মনে করছে, মোদির জুমলাবাজি ধরা পড়ে গিয়েছে। কোনও প্রতিশ্রুতিই যে তিনি রাখেননি, মানুষ তা বুঝেছে। বিরোধীরা মনে করছে, রোটি-কপড়া-মকান ও সড়ক-বিজলি-পানির জোগানের পাশাপাশি চাকরি, রোজগারের নিশ্চয়তা এবং মূল্যবৃদ্ধির হঁাসফঁাস হাল থেকে মুক্তি পাওয়া যে ২০৪৭ সালে ‘বিকশিত ভারত’ দেখার চেয়ে জরুরি, সাধারণ মানুষ তা উপলব্ধি করেছে। এটাও বুঝতে পেরেছে, সেই চাহিদা পূর্ণ করার রাস্তায় গত দশ বছরে মোদি হঁাটেননি। সেই কারণে মানুষের ঢল বুথমুখো হয়নি। এটা হতে চলেছে মোদির প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপনের ভোট।
বিজেপি কিছুটা চিন্তিত, কিন্তু হাল তারা মোটেই ছাড়েনি। দলের একাংশর ব্যাখ্যা, ভোট শুরুর আগেই জয় নিশ্চিত হওয়ায় সমর্থক ভোটারদের মধ্যে একটা গা-ছাড়া ভাব হয়তো দেখা গিয়েছে। তাতে বিরোধীদের উৎফুল্ল হওয়ার কোনও কারণ নেই। কেননা, মোদিভক্তদের সংখ্যা সবসময় বেশি। তঁার বিপরীতে এবারেও কোনও ‘মুখ’ নেই। ফলে কোনও প্রতিযোগিতা নেই। সেটা বিজেপির ভোটারদের অনুৎসাহের কারণ হতে পারে। এতে জয়ের ব্যবধান কমলেও হারার শঙ্কা কষ্টকল্পিত।
এই বিতর্কে আমি ঢুকতে চাই না। কারণ, আগেই বলেছি, প্রথম দফার ভোট দেখে পরবর্তী ছয় দফার ভবিষ্যদ্বাণী করা বাতুলতা। তবে শুক্রবারের পর থেকে কয়েকটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে যেগুলো দেখে মনে হচ্ছে ভোটে জয় নিয়ে বিজেপির আস্থা হয়তো কিছুটা টাল খেয়েছে। জেতার ব্যাপারে যে নিশ্চয়তা কাজ করছিল, হয়তো তা কিছুটা হোঁচট খেয়েছে। তারা বোধহয় একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। শুক্রবারেই মোদিকে প্রথম বলতে শোনা যায়, তঁাকে হারাতে এ-দেশের ‘প্রভাবশালী’ মহলের সঙ্গে চক্রান্ত করছে পশ্চিমি গণমাধ্যম। মধ্যপ্রদেশে এক জনসভায় আচমকাই তিনি এই কথাটা বললেন যা এত দিনের প্রচারে একবারও শোনা যায়নি। আরও আশ্চর্যের, তঁারই দলের সদস্য-সাংবাদিকদের কেউ কেউ খবরের কাগজে এই নিয়ে চর্চাও করলেন। স্পষ্টতই, ভাবনাচিন্তা
[আরও পড়ুন: ‘একসঙ্গে বাঁচতে চেয়েছিলাম, একসঙ্গে মরলাম’, দুর্ঘটনায় স্ত্রীর মৃত্যুর পরদিনই আত্মঘাতী স্বামী]
করেই ‘মোদি অ্যান্ড কোং’ এই চক্রান্ত-তত্ত্ব খাড়া করেছে যাতে সরকার ফেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র হাতিয়ার করে ভক্তদের স্বদেশপ্রেমের জোয়ারে ভাসানো যায়। মোদির সমালোচনায় পশ্চিমি গণমাধ্যম যে সরব, তা আর গোপন নয়। ব্রিটেনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ লিখেছে, ‘ক্ষোভ দমিয়ে জয়ী হওয়া গণতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকর।’ ‘দ্য ফিনানশিয়াল টাইমস’-এর প্রশ্ন, ‘ভারতের বিজেপিই কি পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম-দক্ষ রাজনৈতিক দল?’ তারা লিখেছে, ‘গণতন্ত্রের মা মোটেই ভাল নেই।’ ‘রয়টার্স’ আবার মোদি-মিথ নস্যাৎ করে প্রতিবেদনে লিখেছে, ‘মোদি থাকুন না থাকুন, ভারতের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।’ ‘ব্লুমবার্গ’-এর প্রতিবেদন, ‘ক্রোড়পতি-রাজ ভারতকে কর্তৃত্ববাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ক্রোড়পতি মালিকেরা প্রেসের স্বাধীনতার গলা টিপে ধরেছে।’ তাদেরই আরেকটা প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ‘ভারতের ভোটিং মেশিন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।’ ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ এক-এক করে দেখিয়েছে মোদির ‘মিথ্যার বেসাতি’-র রূপ। ফ্রান্সের ‘লে মঁদ’ বলেছে, ‘আজকের ভারত নামেই গণতন্ত্র।’ ‘টাইমস’ প্রশ্ন রেখেছে, ‘ভারত মাথা তুলেছে, পশ্চিমি শক্তি কি মোদিকে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা থেকে ঠেকাতে পারবে?’ ‘ভারতে আইনের শাসনের কী হল’ এই প্রশ্ন তুলেছে ‘দ্য অ্যাটলান্টিক ম্যাগাজিন।’ ব্রিটেনের ‘চ্যাথাম হাউস’ তো আগেই বলে দিয়েছে, ‘মোদির ভারত উদারত্ব হারাচ্ছে।’
সুইডেনের ‘ভি-ডেম ইনস্টিটিউট’-ও বলেছে, গণতন্ত্র নয়, ভারতে যা চলছে তা ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’। একের পর এক পশ্চিমি মাধ্যমে এমন সমালোচনায় মোদি অস্বস্তিবোধ করছেন। ক্ষুব্ধও। কারণ, এই সমালোচনা তঁার ‘বিশ্বগুরু’ ভাবমূর্তিকে কলুষিত করছে। মোদিভক্ত সাংবাদিকেরা তাই পশ্চিমি গণমাধ্যমের সমালোচনা করে লিখছেন, ভারতের উদয় বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা নড়বড়ে করে দেবে। তাই মোদির বৈধতা ঘিরে এত প্রশ্ন। এটাই ‘টুলকিট পলিটিক্স’। মোদির কথা অনুযায়ী এটাই এদেশের প্রভাবশালীদের সঙ্গে পশ্চিমি চক্রান্ত! এই চক্রান্ত তত্ত্বে চিঁড়ে না ভিজলে হাতে রয়েছে পরিচিত ও পরীক্ষিত অস্ত্র– ধর্মীয় মেরুকরণ ও সাম্প্রদায়িকতার ধোঁয়ায় ধুনো দেওয়া। রবি ও সোমবার সেই হাতিয়ার ধরেছেন মোদি, যাতে বারবার বিজেপির মুশকিল আসান হয়েছে। রবিবার রাজস্থানের বঁাশওয়ারা ও সোমবারে উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ে কংগ্রেস ও মুসলমানদের একাসনে বসিয়ে যা বললেন, তা বিস্ময়কর মিথ্যে হলেও লোক খ্যাপানোর জন্য যথেষ্ট। এমন এক অলীক ভারতের ছবি তিনি এঁকে দিলেন যেখানে কংগ্রেস নাকি ক্ষমতায় এলে সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত সম্পদ কেড়ে, মা-বোনদের মঙ্গলসূত্র খুলে মুসলমানদের মধ্যে বাটোয়ারা করে দেবে! বললেন, ওসব তাদেরই দেবে যারা শুধু গন্ডা-গন্ডা বাচ্চার জন্ম দেয়!
যারা অনুপ্রবেশকারী! প্রকৃত গণতন্ত্রে এভাবে লোক খ্যাপানোর অপরাধের শাস্তি জেলযাত্রা। ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’-য় তা দেশপ্রেম। প্রথম দফার ভোট দেখে উৎফুল্ল বিরোধীদের আশার ফানুস নির্বাচন শেষে চুপসে গেলে গণতন্ত্রের অন্তর্জলি যাত্রায় শোকপ্রকাশের জন্য লোক পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।