প্রত্যাশা মতোই জয়ী শেখ হাসিনা। তবে নির্বাচনী বৈতরণি পেরিয়েই জড়িয়ে পড়েছেন কূটনৈতিক টানাপোড়েনে। তার কেন্দ্র ভারত-চিন। কীভাবে দু’পক্ষকে সন্তুষ্ট রেখে দক্ষিণ এশীয় ভূরাজনীতির ভারসাম্য বজায় রাখবেন, সেটাই দেখার। কলমে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
বাংলাদেশে ভোট শেষ হলেই গণনা শুরু হয়ে যায়। আমাদের মতো তারা দু’-তিনদিন অপেক্ষা করে না। উৎকণ্ঠা নিয়ে বিনিদ্র রজনি যাপন করে না। রবিবার তাদের জাতীয় সংসদের ভোট হল। সন্ধে থেকেই শুরু হয়ে গেল গণনা। ভোট ঘিরে কিছু দিন যাবৎ ‘কী হয়-কী হয়’ ভাব থাকলেও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি-র হঠকারিতা ও পলায়নবৃত্তি মনোভাব বুঝিয়ে দিয়েছিল, শেখ হাসিনার চতুর্থবারের মতো ক্ষমতাসীন হওয়া স্রেফ ঘোষণার অপেক্ষা।
রবিবার রাত আটটার আগেই তা স্পষ্ট হল। লন্ডন প্রবাসী বিএনপি নেতা তারেক জিয়া-র বোঝা উচিত, জয়ী হতে গেলে ময়দানে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে হয়। যে পালায় সে কখনও জয়ী হয় না। জয়ীরা ময়দান ছেড়ে কখনও পালায় না। এটা তাঁর প্রথম শিক্ষা। তবে এবারের ভোটের চমক একটাই।
আওয়ামি লিগের পরেই বেশি আসনে জয়ীরা ‘স্বতন্ত্র’। আমাদের দেশে যাদের ‘নির্দল’ প্রার্থী বলা হয়, বাংলাদেশে তারা ‘স্বতন্ত্র’। জাতীয় সংসদের মোট ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামি লিগ জিতেছে ২২২টি। স্বতন্ত্ররা পেয়েছে ৬২টি আসন। জাতীয় পার্টি ১১। বাকিরা ‘অন্যান্য’ খাতে।
এই ফল অনেকটা ক্রিকেটের স্কোরবোর্ডের মতো লাগছে। সেই স্কোরবোর্ড, যেখানে ওপেনিং ব্যাটারের মারকাটারি রানের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংগ্রহকারী ‘অতিরিক্ত’ বা ‘এক্সট্রা’। আওয়ামি লিগের সংগ্রহের পরই ‘স্বতন্ত্র’দের অবস্থান অনেকটা সেইরকম। মনে রাখতে হবে, এবার এই ‘স্বতন্ত্র’দের ভূমিকা বহু ক্ষেত্রে রহস্যজনক। ‘স্বতন্ত্র’ হিসাবে যাঁরা জিতেছেন, তাঁদের অনেকেই ছিলেন আওয়ামি লিগেরই ‘ডামি’ ক্যান্ডিডেট। রটনা এরকম, দলীয় নেতৃত্বই নাকি অনেককে সরকারি প্রার্থীর বিরুদ্ধে ‘স্বতন্ত্র’ হয়ে দঁাড়াতে উৎসাহ দিয়েছে। অনেকে অবশ্য দলের টিকিট না পেয়ে ‘বিদ্রোহী’ হয়েছেন। এঁরা আবার ভোটে লড়েছেন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সুযোগ্য কন্যা হাসিনার ছবি সামনে রেখে। প্রতীক হিসাবে ‘নৌকা’-র বদলে ছিল ‘ঈগল’ বা অন্য কিছু। প্রধানত এঁদের কারণেই এই ভোট খানিকটা ‘অংশগ্রহণমূলক’ হতে পেরেছে। সংসদে এই ৬২ জনের ভূমিকা কীরকম হবে, আপাতত তা নিয়ে জল্পনা চলছে। জনপ্রিয় ধারণা, অধিকাংশকেই আওয়ামি লিগ দলে ফিরিয়ে নেবে। দেখা যাক।
[আরও পড়ুন: দেশ জর্জরিত হাজারো সমস্যায়, বাস্তব আড়াল করতেই মন্দির গিমিক?]
ঝাঁকের কই হয়ে কতজন স্বঘরে প্রত্যাবর্তন করেন, কতজন ‘গঠনমূলক’ বিরোধীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। খালেদা জিয়া-র বিএনপি ২০১৪ সালেও ভোট বয়কট করেছিল। ২০১৮-এ তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও ‘ডাব্ল ডিজিট’ ছুঁতে পারেনি। না পারার একমাত্র কারণ ভোট না হওয়া। পুনরাবৃত্তি রুখতে এবার নিরপেক্ষ সরকারের তত্ত্বাবধানে ভোটের দাবিতে সরব হওয়ার পাশাপাশি বিএনপি অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল পশ্চিমি দুনিয়ার উপর। ভেবেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের তরিয়ে দেবে। পশ্চিমি দুনিয়া ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষা’-র প্রশ্ন তুলে তাদের মতো করে প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছিল ঠিকই, কিন্তু হাসিনা মচকাননি। নিজের শর্তে ভোট করিয়ে তিনি টানা চারবার প্রধানমন্ত্রিত্বের জয়টিকা কপালে আঁকলেন।
খালেদা-তনয় তারেক জিয়া-র দ্বিতীয় শিক্ষা, স্রেফ অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণি পেরনো যায় না। সমর্থন বা সহযোগিতা যতই থাকুক, লড়তে হয় নিজের দমে। হাসিনা ও আওয়ামি লিগ তাই জয়ী, তারেক ও বিএনপি হেরো। রবিবার রাতভর গণনার পর সোমবার দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ভোটচিত্র যখন ফরসা, তখনই শুরু হয় এক চমকপ্রদ প্রতিযোগিতা। চান, না-চান সেই প্রতিযোগিতা ও তার অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েনের মধ্যে হাসিনা জড়িয়ে পড়েছেন। কীভাবে তার সামাল আগামী দিনে তিনি দেবেন, তা হতে চলেছে এই আঞ্চলিক ভূরাজনীতির অন্যতম আকর্ষণ।
প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে রয়েছে ভারত ও চিন। সোমবারের সেই নিরুচ্চার প্রতিযোগিতার দুই কুশীলব ছিলেন ঢাকায় চিনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন ও ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা। কে আগে গণভবনে গিয়ে হাসিনাকে অভিনন্দন জানাবেন, সোমবার সকালে শুরু হয় সেই রেষারেষি। গণভবনে যিনিই আগে পৌঁছে থাকুন, বাংলাদেশের হৃদয়ে কে কার চেয়ে দ্রুত ‘পার্মানেন্ট সেট্লমেন্ট’-এর বন্দোবস্ত পাকা করবে, সেই প্রতিযোগিতা আগামী দিনে নিশ্চিতভাবেই আরও আকর্ষণীয় হতে চলেছে।
ভূরাজনীতিতে ভারত ও চিনের অবস্থান বিপরীত মেরুতে। কিন্তু কী আশ্চর্য, বাংলাদেশ অদ্ভুতভাবে দুই প্রতিপক্ষকে এক ঘাটে টেনে এনেছে!
এবারের ভোট ঘিরে আমেরিকার বিরোধিতা ভারত যেমন করেছে, তেমন চিনও করেছে। ভারত ও চিন দু’জনেই চোখ বুজে হাসিনার নেতৃত্বাধীন ‘স্থিতিশীল বাংলাদেশ’ দেখতে চেয়েছে। সেজন্য ভোট আবহে যা ‘দেখা দরকার’, তারা তা দেখেছে, যা ‘দেখার প্রয়োজন নেই’ তা দেখেনি। দুই পরাশক্তির পারস্পরিক রেষারেষি ও সহযোগিতার বহরের সামাল হাসিনা কীভাবে দেন আগামী দিনে তা আগ্রহের সঞ্চার অবশ্যই করবে। হাসিনার পক্ষে এ এক ট্রাপিজের খেলা। শ্যাম ও কূল দুই-ই রাখা তঁার পক্ষে খুবই জরুরি।
ভোট-পর্ব মোটামুটি নির্বিঘ্নে কাটায় ভারত স্বস্তি পেলেও অস্বস্তি পুরোপুরি অন্তর্হিত নয়। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারতের কপালে নতুন ভাঁজ ফেলেছে মালদ্বীপ। প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জু ক্ষমতাসীন হওয়ায় ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপমালা-রাষ্ট্রে চিনের প্রভাব বাড়তে চলেছে। এরই মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর লাক্ষাদ্বীপ সফরকে কেন্দ্র করে দুই দেশের সম্পর্ক হুট করে আরও খারাপ হয়েছে। শ্রীলঙ্কা দুই নৌকায় পা দিয়ে ভারত-চিনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার খেলা খেলে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কত দিন পারবে বলা কঠিন। এই দেশটি সম্পর্কে ভারত ষোলো আনা নিশ্চিন্ত নয়। যেমন নয় নেপাল নিয়েও। চিন এই দেশটির উপরও তার প্রভাব নানাভাবে বাড়িয়ে চলেছে।
মঙ্গলবার এই নিবন্ধ লেখার সময় ভুটানের পার্লামেন্টের ভোটগ্রহণ চলছে। শেষ রাউন্ডের এই ভোটের ফল ঘোষিত হবে আগামী শুক্রবার। ভারত ও চিন দুই দেশেরই তীক্ষ্ণ নজর এই ভোটের দিকে। এতকাল যে দেশটিকে ভারত ‘বাফার স্টেট’ হিসাবে দেখে এসেছে, যার সঙ্গে এখনও চিনের কোনও কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই, ডোকলাম উত্তেজনার পর সেই দেশটির প্রতিই চিন অতিমাত্রায় আগ্রহী। গত অক্টোবরে সীমান্ত সমস্যার সমাধানে চিন ও ভুটান একটা ‘সহযোগিতা চুক্তি’ সই করেছে। ভারতের নতুন মাথাব্যথা সেখান থেকেই শুরু। চিনের খপ্পরে পড়তে ভুটান শেষমেশ বাধ্য হলে ভারতের দুশ্চিন্তা দ্বিগুণ হবে।
চিন ছাড়া নতুন বছরে ভারতের অপর চিন্তা কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে। পান্নুন হত্যা ষড়যন্ত্র মামলা কোন দিকে বাঁক নেবে, যুক্তরাষ্ট্র তার মুঠো কতটা শক্ত করবে, নিজ্জর হত্যা মামলাতেই বা কানাডা কোন ‘তথ্যপ্রমাণ’ উপস্থাপন করবে এখনও অজানা। নির্বাচনের বছরে খলিস্তানি প্রশ্নে ভারতকে অপদস্থ হতে হবে কি না কেউ অনুমান করতে পারছে না। নিজ্জর হত্যা ও পান্নুন হত্যা চক্রান্ত নিয়ে কানাডা ও আমেরিকা দুই দেশের অভিযোগই কতকটা একধরনের। কানাডার অভিযোগ উড়িয়ে ও যুক্তরাষ্ট্রকে আমল দিয়ে ভারত দুটি বিষয় আলাদা করতে চাইছে। ব্যর্থ হলে ভারতের ভাবমূর্তি অন্য ক্যানভাসে চিত্রিত হবে।
হাসিনার চতুর্থ জয় ভারতকে অবশ্যই খুশি করেছে। স্বস্তিও দিয়েছে। কিন্তু হাসিনা স্বস্তিতে থাকবেন তো? একবছর আগে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রাভাণ্ডার ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার, এখন কম-বেশি ২০ বিলিয়ন। ডলার সংকটের দরুন আমদানিকারকরা ‘এলসি’ খুলতে পারছে না। হরতাল, অবরোধ, আন্দোলনে জেরবার পরিবহণ ব্যবসা। মূল্যবৃদ্ধির ছোবল কমছে না। তৈরি পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধি কমছে তো কমছেই। এই অবস্থায় বেড়ে চলেছে পশ্চিমি দুনিয়ার রফতানি নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা। হাসিনার চ্যালেঞ্জগুলো শিকারি নেকড়ের মতো ওত পেতে আছে। তিনি বিপর্যস্ত হলে স্বস্তি ঘুচবে ভারতেরও।