ভোট হল। তবে ‘ম্যাজিক অঙ্ক’ ১৩৪টি সিট পেয়ে কোনও দলই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার নাগাল পেল না পাকিস্তানে। ইমরান খান কারাবন্দি, দণ্ডিত। তা-ও তাঁর দলের সমর্থিত নির্দল প্রার্থীরা সর্বোচ্চ আসন পেয়েছেন। নওয়াজ শরিফ কি পারবেন সরকার গড়তে? বিলাওয়াল ভুট্টোর ‘উজির-এ-আজম’হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তিনি কি জোট বাঁধছেন নওয়াজের সঙ্গে? অধরা গণতন্ত্রের মাঝে যে টানাপোড়েন চলছে গদি ঘিরে, তা-ও কি সেনাবাহিনীর চিত্রনাট্য মেনেই অনুসৃত? কলমে কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়
পাকিস্তানের নির্বাচনের পিছনের নীল নকশা কি ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে? পুতুলনাচের আসল কুশীলবরা কি ধীরে ধীরে প্রতীয়মান? পাক নির্বাচনোত্তর পর্বে এই যেকোনও দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না-পাওয়া (বা, নিন্দুকদের মতে, না-পেতে দেওয়া), এই যে বালুচিস্তান থেকে খাইবার পাখতুনখোয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে– তা কি সবটাই রাওয়ালপিন্ডির সেনা ছাউনির অঙ্গুলিহেলনে? যাতে জেনারেলরা দেশের ‘উজির-এ-আজম’-এর তখ্তে কে বসবেন, তা ঠিক করা শুধু নয়, কতদিন বসে থাকতে পারবেন, তা-ও নির্ধারণ করতে পারেন? কারণ, একমাত্র রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলেই রাজনৈতিক দলগুলো তখ্ত পাওয়ার উদগ্র বাসনায় সেনার শরণাপন্ন হবে, আর পিছন থেকে কলকাঠি নেড়ে জেনারেলরা তাঁদের হুকুমত বজায় রাখতে পারবেন। সুষ্ঠুভাবে ভোটের মাধ্যমে গণতন্ত্র শিকড় গাড়লে তো জেনারেলদের ফের ছাউনিতেই ফিরতে হবে।
পাক রাজনীতির হালচাল যারা চেনে, তাদের ঘোরতর সন্দেহ এটাই। তাদের মতে, ভোটের ফল আসলে এই পুতুলনাচের কথাই বলছে। ২৬৬ নির্বাচিত পাক সংসদের নিম্নকক্ষ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে ১৩৪ হল ‘ম্যাজিক নাম্বার’ যা পেলে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা মেলে। ৮ ফেব্রুয়ারির ভোটে যেটা কোনও দল পায়নি। রাওয়ালপিন্ডির সেন্ট্রাল জেলে অন্তরিন পাকিস্তান ‘তেহরিখ-ই-ইনসাফ’ বা ‘পিটিআই’-এর কর্ণধার তো এই নির্বাচনকে ‘মাদার অফ অল ফ্রড’ অভিহিত করে বলেছেন– তাঁর দল আসলে ১৭০টিরও বেশি আসনে জিতেছে, কিন্তু জোচ্চুরি করে বহু জেতা আসনে ফল ঘোষণার সময় হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইতিহাসের পরিহাস হল– ২০১৮ সালের নির্বাচনে ঠিক একই ধরনের রিগিংয়ের অভিযোগ পাকিস্তানের অন্য দুই প্রধান রাজনৈতিক দল নওয়াজ শরিফের ‘পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ’ ওরফে ‘পিএমএল-এন’ আর বেনজির ভুট্টোর তনয় বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির নেতৃত্বাধীন ‘পাকিস্তান পিপল্স পার্টি’ বা ‘পিপিপি’ করেছিল।
অভিযোগ উঠেছিল, বহু আসনে কাপ্তান সাহেবের প্রার্থীকে জোর করে জিতিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৫৬ আসন পেয়ে বিজয়োৎসবে ব্যস্ত পিটিআইয়ের ছোট-বড় মাঝারি কোনও নেতাই অবশ্য এসব ‘ফালতু’ অভিযোগে আমল দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে তখন মনেই করেননি। ৮ ফেব্রুয়ারির ভোটের ফলাফল বলছে, পাক সংসদের নিম্নকক্ষের নির্বাচন হওয়া ২৬৬ আসনের মধ্যে পিটিআই সমর্থিত নির্দলরা যেখানে ৯৩টি আসন পেয়েছে, সেখানে নওয়াজ শরিফের দল ‘পিএমএল-এন’ পেয়েছে ৭৫। পিপিপি জয়ী হয়েছে ৫৪টি আসনে। সিন্ধুপ্রদেশের ‘মুত্তাহিদা কুয়ামি মুভমেন্ট’ (এমকিউএম) পেয়েছে ১৭টি আসন। শেষের তিনটি দল-ই ইমরান-বিরোধী বলে পরিচিত। ফলে কাপ্তান সাহেবের সঙ্গে এরা কেউ-ই সহজে সমঝোতায় আসতে চাইবে না।
আর কাপ্তান সাহেবের আবার অন্য সমস্যা। এই ভোটে পিটিআই-এর যে রাজনৈতিক চিহ্ন ‘ব্যাট’, তা পর্যন্ত ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি। যাতে নিরক্ষর ভোটাররা (মোট ভোটারের প্রায় ৪০ ভাগ, যারা মূলত চিহ্ন দেখে ভোট দেয়) ইমরানের দলের প্রার্থীদের চিনতেই না-পারেন। পিটিআই-এর সভাসমিতিতে ছিল অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। সোশাল মিডিয়া ও ঘরে-ঘরে গিয়ে প্রচারের উপরই পিটিআই-কে জোর দিতে হয়েছিল। এর উপর ছিল যথেচ্ছ ধড়পাকড়। পিটিআইয়ের দলের বড় আর মাঝারি প্রায় সব নেতাই নজরবন্দি। বাকিরা গা-ঢাকা দিয়েছিলেন। ফলে ইমরানকে বাধ্য হয়ে নির্দল হিসাবে দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচনী ময়দানে নামাতে হয়। এখন তাঁদের মধ্যে শত বাধা সত্ত্বেও ৯৩ জন জিতেছেন। কিন্তু এঁরা নির্দল। অর্থাৎ, বৃহত্তম দল হলেও পাক রাষ্ট্রপতি আইনের মারপ্যঁাচে এঁদের একক রাজনৈতিক দল হিসাবে মান্যতা দেননি। দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হয়েও নওয়াজ শরিফ সরকার গড়ার ডাক পেয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঠিক এটাই তো জেনারেলরা চেয়েছেন। একদিকে ইমরানকে ফের তখ্তে বসার রাস্তা বন্ধ করে ‘সাপ মারা হল’,অন্যদিকে ‘লাঠি অটুট রাখার জন্য’ এক নড়বড়ে জোট সরকার গড়তে দেওয়ার রাস্তা খোলা হচ্ছে– যাতে জেনারেলদের কথার অমান্য করতে সাহস কেউ না পায়। মানে, এত যে কাঠখড় পুড়িয়ে ইমরানকে ২০২৩-এর এপ্রিল মাসে ক্ষমতাচ্যুত করে পরের মাসে তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি গোপন তথ্য ফাঁস থেকে চুরি করার মতো হাজারও অভিযোগের দায়ে জেলে ভরা হল, কারাদণ্ড দেওয়া হল; অন্যদিকে সাত কাণ্ড করে নির্বাসনে থাকা বৃদ্ধ নওয়াজ শরিফকে লন্ডন থেকে উড়িয়ে আনা হল, তাঁর বিরুদ্ধে থাকা দুর্নীতির শতেক অভিযোগ কর্পূরের মতো উবে গেল– এসব তো সেই চিত্রনাট্যেরই অংশমাত্র। সেভাবে দেখলে সেনার প্রাথমিকভাবে চাল সফল হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নীল নকশার দ্বিতীয় ভাগ হল ক্ষমতায় যেই আসুক, রাওয়ালপিন্ডির অঙ্গুলিহেলনে যেন সে চলে। এখানেই ত্রিশঙ্কু আইনসভা সেনার কাজে আসবে।
চিত্রটা তাই জলের মতো পরিষ্কার। বিলাওয়াল-নওয়াজ হাত মেলালেও ১৩৪-এর ম্যাজিক অঙ্ক ছুঁতে পারছে না তাঁদের এই জোট। নিজেদের মধ্যে দর কষাকষি চললেও খুব বেশি দূর কেউই এগতে পারছেন না। তাই বাধ্য হয়েই ‘এমকিউএম’-কে জোটে শামিল হতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। শুধু এতেই ব্যাপারটা থেমে থাকেনি। এখন দেখা যাচ্ছে– ভোটে ইমরানের দলের সাফল্য জেনারেলদের চিত্রনাট্যের অদলবদল করতে বাধ্য করেছে। শত হলেও পাকিস্তানের মতো কপালপোড়া দেশে তিন দশক আগে একটা সবে ধন নীলমণি বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলেন ইমরান। ফলে যতই রাজনীতির কুটিল আবর্তে তাঁকে টেনে নামানোর চেষ্টা করা হোক না কেন, দেশের মানুষ তাঁকে আর পাচজন রাজনীতিকের থেকে একটু আলাদা চোখেই দেখেন। তাই তখ্তে আসার জন্য বাঁকা পথ নিলেও ক্ষমতায় থাকার চার বছরে ব্যক্তি ইমরানের জনপ্রিয়তা খুব একটা টাল খায়নি। আর জেনারেলরা সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন কাপ্তান সাহেবকে ক্ষমতাচ্যুত করে অন্তরিন করার পর। সারা দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আর গত ৭৫ বছরে সেনারা কোনও দিনও যা কল্পনাও করেনি, তা-ও ঘটে গেল। উন্মত্ত জনতা সেনা কমান্ডরের বাংলো ভাঙচুর করে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যুদ্ধের পাক সেনানায়ক এ. এ. কে. নিয়াজি-র আত্মীয় ইমরান খান নিয়াজি। ফলে সেনাবাহিনীর উপরতলা তাঁরাও চেনা। নিন্দুকেরা বলে, খান সাহেব উপরে ওঠার জন্য সেই সিঁড়িও ব্যবহার করতে কসুর করেননি। ফলে সেনার অন্দরে কাপ্তান সাহেবের কোনও সমর্থক নেই, এ-কথা ভাবা-ই ভুল। এর উপর ইমরান অন্তরিন হ লেও রাজনৈতিকভাবে তিনি যে এখন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা, তাতেও সন্দেহ নেই। ভোটের ফল সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। নিন্দুকেরা বলে, ঠিক এখানেই তীরে এসে নওয়াজের তরি ডুবেছে। পাঞ্জাব বিধানসভা পিএমএল-এন পেলেও সারা দেশে নওয়াজ ও শাহবাজের গ্রহণযোগ্যতা যে তলানিতে, তা সেনার বুঝতে অসুবিধা হয়নি। উল্টে, নওয়াজের স্বাধীনভাবে কাজ করার প্রবণতা সেনার না-পসন্দ। তাই শোনা যাচ্ছে, নওয়াজ-তনয়া মারিয়মকে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী করে শাহবাজকেই ফের প্রধানমন্ত্রী করতে চায় সেনা।
কারণ, শাহবাজের সঙ্গে নাকি কাজ করা সহজ। অন্যদিকে, মারিয়মকে ইসলামাবাদ থেকে সরিয়ে শাহবাজের পথও কিছুটা হলেও কণ্টকমুক্ত করা হচ্ছে। কারণ মারিয়ম বিদ্রোহ করলে শাহবাজ কতদূর টিকবেন, তা নিয়ে ঘোর সন্দেহ আছে। রাজনৈতিক মহলে যে-প্রশ্নটা এখন ঘুরপাক খাচ্ছে, অতঃপর নওয়াজ কী করবেন? প্রধানমন্ত্রিত্বের আশা আপাতত সিন্ধু নদে নিমজ্জিত। তিনি তো আসলে চলবেন সেনার অঙ্গুলিহেলনে, মুখে যতই তাঁকে ‘দলের সর্বময় নেতা’বলা হোক। শেষমেশ কি মারিয়মকে ইসলামাবাদের গদিতে বসানোর চেষ্টা করবেন তিনবারের এই উজির-এ-আজম?
পিপিপি-র দশা আরও খারাপ। ৫৪টি আসন পেয়ে না সরাসরি ক্ষমতা পাওয়া যাচ্ছে, না, প্রধান বিরোধী দলের তকমা। বিলাওয়াল তাই আপাতত শাহবাজ সরকারকে বাইরে থেকেই সমর্থনের কথা ভেবেছেন। তাতে দেশের ভয়াবহ আর্থিক পরিস্থিতির সরাসরি কোনও দায় নিতে হবে না। আর শাহবাজকে কতদিন মারিয়ম টিকতে দেবেন, তা নিয়েও ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। তাই আপাতত শুধু বাবাকে রাষ্ট্রপতি পদে দেখতে চান বিলাওয়াল। নিন্দুকরা বলছে, আসলে সবই চলছে চিত্রনাট্য মেনে। কে বলতে পারে, অদূরভবিষ্যতে দরকার পড়লে মুক্ত ইমরানকে আসতে দেওয়া হবে না জনসমক্ষে? নওয়াজের মতোই তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোও তখন সিন্ধুর জলে ভেসে যাবে। চুম্বকে, ভোট হলেও গণতন্ত্র সেই অধরা রয়ে গেল পাকিস্তানে।