‘বিরোধী’ দলনেতা রাহুল গান্ধীর সংসদে বিজেপির উগ্র-হিন্দুত্ববাদের সমালোচনাকে নরেন্দ্র মোদি শুধু তাঁর নয়, সমগ্র ‘হিন্দু সমাজের অপমান’ বলে তুলে ধরতে চাইছেন। এদিকে, ক্রমশ রাহুল যে সবার নেতা হয়ে উঠছেন, তা-ও দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। লিখলেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
২ জুলাই, ২০২৪। সংসদীয় ভারতের ইতিহাসে এই তারিখটি বহু দিন জ্বলজ্বল করবে। ওই দিন লোকসভায় এমন একটা ঘটনা ঘটেছে, যা গত দশ বছরে ক্ষণিকের জন্যও দেখা যায়নি। সেই দিন নতুন সংসদ ভবনে ‘বিরোধী নেতা’ হিসাবে জীবনের প্রথম ভাষণে রাহুল গান্ধী বিজেপি-আরএসএসের নীতি, তাদের আদর্শ ও হিন্দুত্ববাদী চেতনার তুলোধোনা করেন। দেড় ঘণ্টা ধরে তিনি নানাভাবে প্রমাণ করলেন, কেন হিন্দুত্বের বড়াই করা সমকালীন বিজেপি নেতৃত্ব প্রকৃত অর্থে ‘হিন্দু’ হতে পারে না। তারা সমগ্র হিন্দু সমাজের প্রতিনিধিত্বও করে না।
রাহুলের (Rahul Gandhi) বয়ানে, হিন্দু ধর্ম কখনও হিংসার কথা বলে না। ঘৃণার প্রচার চায় না। বরং সম্প্রীতির বাণী প্রচার করে। প্রেম, ভালবাসা, সদ্ভাবের কথা বলে। সত্যভাষী হওয়ার পরামর্শ দেয়। মানুষকে অভয় দেয়। হিন্দু দেবদেবীদের হাতে বরাভয় মুদ্রা তাই সদা দৃশ্যমান। অথচ, সেই সনাতনি আদর্শ ছেড়ে বিজেপি ক্রমাগত হিংসা ও ঘৃণা উগরে চলেছে। হানাহানি করছে। ভূরি ভূরি অসত্য বলে চলেছে। সবাইকে ভয় দেখিয়ে তটস্থ করে রেখেছে।
[আরও পড়ুন: ‘তৃণমূলে কিলবিল করছে CPM, গায়ের নোংরা ঝাড়ার চেষ্টা’, গণপিটুনি নিয়ে ‘সাফাই’ মদনের]
শুধু বিরোধীদেরই নয়, নিজের দলের অন্যদেরও। রাহুল বলেছিলেন, হিন্দুত্বের বড়াই করা বিজেপি তাই প্রকৃত অর্থে হিন্দু হতে পারে না। তারা সমগ্র হিন্দুজাতির প্রতিনিধি নয়। বিরোধীদের সবার দিকে হাত ঘুরিয়ে রাহুল বলেছিলেন, ‘আমরাও হিন্দু’। রাহুল সেদিন শিব ঠাকুরের ছবি নিয়ে লোকসভায় গিয়েছিলেন। নিয়েছিলেন গুরু নানক, গৌতম বুদ্ধ, যিশু খ্রিস্ট ও মুসলমানদের প্রার্থনার ছবিও। সব ধর্মই যে শান্তির কথা বলে, সম্প্রীতির কথা বলে, ছবিগুলো দেখিয়ে তা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। সেই সঙ্গে বলেছিলেন, দেশের এই সর্বধর্ম সমভাব নষ্ট করে দিচ্ছে বিজেপি।
ভারতের জনগণ, সংবিধান ও গণতন্ত্রের উপর বারবার আঘাত হেনে দুর্বল করে দিচ্ছে। ভয়ের পরিমণ্ডল সৃষ্টি করেছে। এখানেই শেষ নয়, সেই সঙ্গে দেশের যাবতীয় সম্পদ তারা তুলে দিচ্ছে এক ক্ষুদ্র শ্রেণির হাতে। বঞ্চিত করছে বাকিদের। গত কয়েক বছর ধরে রাহুল শাসক-বিরোধী দ্বন্দ্বকে দুই বিপরীতধর্মী ‘বিচারধারার লড়াই’ বলে প্রচার চালাচ্ছেন। খানিকটা সফলও যে হয়েছেন– এবারের ভোট তার প্রমাণ। লোকসভাতেও তিনি সেই সুর বজায় রেখে বলেছেন, বিজেপি যে হিন্দুত্বের ধ্বজা উড়িয়ে রেখেছে, তা মানুষকে ভুল বুঝিয়ে বিভাজিত করার রাজনীতি। তাদের লড়াই এর বিরুদ্ধেই।
[আরও পড়ুন: নজির গড়া পারফরম্যান্সে দুরন্ত ইয়ামাল, ফ্রান্সকে ছিটকে ইউরো ফাইনালে স্পেন]
রাহুলের এই ভাষণ বিস্ময়কর ঘটনা নয়। বিস্ময়কর হল, সেই ভাষণ চলাকালীন সরকারপক্ষের আচরণ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেদিন শুরু থেকে সভায় হাজির। গমগম করছে সভা। নতুন শক্তি সঞ্চয় করে বিরোধীরাও চনমনে। রাহুলের ভাষণ থামিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি সেদিন দু’বার উঠে দঁাড়ালেন। তঁার চোখে-মুখে ক্রোধ, ক্ষোভ, বিরক্তি। কঠিন চোখে স্পিকারের দিকে তাকিয়ে প্রথমবার তিনি বললেন, ‘এটা খুবই গুরুতর একটি বিষয়। সমগ্র হিন্দু সমাজকে হিংস্র বলা হচ্ছে!’
বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদের সমালোচনাকে প্রধানমন্ত্রী মোদি সমগ্র ‘হিন্দু সমাজের অপমান’ বলে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। বিজেপি-নীতির বিরুদ্ধে রাহুলের আক্রমণকে হিন্দু জাতির বিরুদ্ধাচারণ বলে দাগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। রাহুল তা ধরে ফেলে সঙ্গে-সঙ্গেই বলেন, ‘নরেন্দ্র মোদি পুরো হিন্দু সমাজ নন। বিজেপি ও আরএসএসও গোটা হিন্দু সমাজ নয়।’ আক্রান্ত হলে মোদি ক্রুদ্ধ হন। চোখে-মুখে তার প্রতিফলন ঘটে। তা দেখে মোদির দিকে তাকিয়ে পরিহাসচ্ছলে রাহুল জানতে চেয়েছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে কেন এত সিরিয়াস দেখাচ্ছে?’ মোদি সে-সময় দ্বিতীয়বার দঁাড়িয়ে উঠে বলেন, ‘গণতন্ত্র ও সংবিধান তঁাকে শিখিয়েছে বিরোধী নেতাকে সিরিয়াসলি নিতে।’
গত দশ বছরে নরেন্দ্র মোদিকে কোনও বিরোধী নেতা এমন উত্তেজিত করতে পারেননি। বিরোধী নেতার ভাষণ থামিয়ে মোদিও কখনও এভাবে ক্ষোভ ও বিরক্তি প্রকাশ করেননি। রিয়্যাক্ট করেননি। এর কৃতিত্ব পুরোপুরি রাহুলের। মোদির আচরণ বুঝিয়েছে, রাহুলের এই উত্থান তাদের কাছে অশনিসংকেত। স্রেফ মোদি-ই নন। সেদিন রাহুলকে মন্ত্রিসভার দু’বারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং দু’বার বাধা দিয়েছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ থামানোর চেষ্টা করেছেন চারবার, কৃষিমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান একবার, পরিবেশমন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদব তিনবার এবং সংসদীয়মন্ত্রী কিরেণ রিজিজু– বহুবার। এই সম্মিলিত প্রতিরোধ এবং অমিত শাহর হুংকার থেকে স্পষ্ট, রাহুল পর্ব তঁারা এখানেই শেষ করে দিতে চান না। বরং এই ভাষণ হাতিয়ার করে অন্যভাবে আক্রমণাত্মক হতে চান। অমিত শাহর হুংকার, জবাবি ভাষণে প্রধানমন্ত্রীর হুমকি এবং সংসদীয় মন্ত্রী কিরেণ রিজিজুর মন্তব্য তার স্পষ্ট ইঙ্গিত।
অমিত শাহ একবার স্পিকার ওম বিড়লাকে বলেন, ‘এভাবে সভার নিয়মবিধির তোয়াক্কা না-করে কেউ কথা বলে যাবে তা আপনি হতে দিতে পারেন না। আপনাকে সক্রিয় হতে হবে।’ আর-একবার বলেন, “একজন বারবার আপত্তিজনক কথা বলছেন ও আপনি তা বলতে দিচ্ছেন কী করে? এটা চলতে পারে না। এসব আপত্তিজনক কথা, অসত্য অভিযোগ প্রমাণ করতে বাধ্য করা হোক। রাহুলের ভাষণের ‘অসত্য ও আপত্তিকর’ অংশ কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়া হোক।” স্পিকার দায়িত্বের সঙ্গে সেই ‘হুকুম’ মেনেছেন। সেদিনই রাহুলের ভাষণ থেকে বাদ দেওয়া হয় একের-পর-এক অংশ। ঠিক এভাবে বাদ দেওয়া হয়েছিল নির্বাচনের আগে রাহুলের ভাষণের ‘আদানি-আম্বানি’ প্রসঙ্গগুলো।
রাহুলের ওই আক্রমণাত্মক ভাষণের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট– ‘বিরোধী নেতা’ হওয়ার চ্যালেঞ্জ তিনি গ্রহণ করেছেন। দ্বিতীয়ত, সংসদে বিরোধীপক্ষকে জোটবদ্ধ করিয়েছেন। ক্রমশ তিনি সবার নেতা হয়ে উঠছেন। তৃতীয়ত, কথায়-কথায় তিনি ‘ইন্ডিয়া’ জোটের প্রসঙ্গ টেনেছেন, যা বোঝাচ্ছে বিরোধিতার মাত্রা তীব্রতর হবে। জোট সক্রিয় হবে। চতুর্থত, প্রধানমন্ত্রী যতই তঁাকে ‘বালকবুদ্ধি’ হিসাবে কটাক্ষ করুন, যতই অপদস্থ করুন, সিরিয়াস রাজনীতিক হিসাবে রাহুল নিজেকে গড়ে তুলেছেন। কিছু খামতি কিছু ক্ষেত্রে যে নেই, তা নয়, তা সত্ত্বেও তিনিই হয়ে উঠছেন মোদির প্রধান প্রতিপক্ষ।
এই বদলে যাওয়া রাহুল-ই মোদির মাথাব্যথা। তঁাকে থামাতে বিজেপির নতুন করে কোমর কষা শুরু ওই ভাষণের পর থেকেই। প্রধানমন্ত্রী-সহ এতজন মন্ত্রীর এতবার প্রতিবাদী হওয়া ও স্পিকারের উপর চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি মোদির জবাবি ভাষণেও রয়েছে সেই ইঙ্গিত। স্পিকারের দিকে তাকিয়ে কঠিনভাবে সেদিনই তিনি বলেছিলেন, রাহুল যে-ভাষায় কথা বলেছেন, তঁাকে ঠিক সেই ভাষাতেই জবাব দেওয়া হবে।
সংসদে এই বিধ্বংসী ও পরিণত রাহুলের উপস্থিতি কি মোদি-শাহরা চাইবেন? অবশ্যই নয়। রাহুলের নেতৃত্বে কংগ্রেস শক্তিশালী হোক, দলের বিস্তার ঘটুক এবং তিনিই হয়ে উঠুন বিরোধী মুখ, মোদি নিশ্চিতই তা চান না। ২ জুলাইয়ের ওই ভাষণের পর থেকেই তাই তঁাকে আটকানোর চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে। রাহুলের বিরুদ্ধে অধিকারভঙ্গের নানা অভিযোগ আনার তোড়জোড় চলছে। সংসদীয় মন্ত্রী কিরেণ রিজিজু নিজেই সেই আভাস দিয়েছেন। আশ্চর্য হব না– যদি দেখি রাহুল যা বলেননি, সেই অপরাধে যদি তঁাকে শাস্তি দেওয়া হয়। ‘হিন্দু ধর্মের অপমান’ নিয়ে বিজেপির শাণিত আক্রমণ বোঝাচ্ছে, বুকে বেঁধা তিরের অভিমুখ তারা রাহুলের দিকে ঘোরাতে চাইছে। কোনও বিরোধী নেতাকে এখনও পর্যন্ত লোকসভা থেকে বহিষ্কার করা হয়নি। রাহুলকে করা হলে সেটাও হবে আরও-এক নজির। এমন কত কিছুই তো গত দশ বছর ধরে হয়ে আসছে! ভারতবাসী দেখে আসছে। সেই তালিকায় আরও একটা যোগ হলে বিস্ময়ের কী?