প্রকৃতি যে কতখানি বদলেছে, তা সম্ভবত বাঙালি সবচেয়ে ভাল বুঝবে। ঋতু অনুসারে গীতবিতানে যেভাবে সাজানো আছে গান, সেসব এখন কই?
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা’ উপন্যাসে ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাওয়া ঋতুর বর্ণনায় আসন্ন ব্যাধি ও সর্বনাশের ইশারা আছে। ওরহান পামুকের ‘নাইটস অফ প্লেগ’ উপন্যাসেও একটি ঋতু যেন অন্য ঋতুর গায়ে জড়িয়ে আছে একাকার আসঙ্গতায়। প্রসঙ্গত মনে এল, সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ ছবিটি। ছবির শুরুতেই প্রকৃতি যেন তার সমস্ত স্বাভাবিক মাধুর্য ও পর্যাপ্তি নিয়ে উপচে পড়ছে। সেখানে আসন্ন মন্বন্তরের কোনও সংকেত নেই। কারণ সত্যজিৎ রায় বোঝাতে চেয়েছেন, আসন্ন দুর্ভিক্ষ মানুষের তৈরি, তার কারণ নয় ফসলের অভাব।
আসন্ন বর্ষার প্রেক্ষিতে প্রকৃতির বদলে যাওয়া স্বভাব-চরিত্র নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন তর্কাতীত। প্রকৃতির বিভিন্ন ঋতুর প্রকাশ-চিহ্নগুলি যে খুব তাড়াতাড়ি বদলাচ্ছে, অশক্ত হাতের লেখার মতো গায়ে-গায়ে ঢলে পড়ে মিশে যাচ্ছে, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। এবং প্রকৃতির স্বভাবচরিত্রে এই গূঢ় পরিবর্তনের জন্য দায়ী আমাদের যান্ত্রিক সভ্যতার ধোঁয়া, গ্যাস, ব্যাপ্ত বিষোদগার, অপরিমেয় কলুষ। প্রকৃতি যে কতখানি বদলেছে, তা সম্ভবত বাঙালির পক্ষে বোঝা সবথেকে সহজ। ‘গীতবিতান’ খুললে আমাদের চোখের সামনে রবীন্দ্রনাথের গানগুলিকে ঋতুর গুণবত্তা অনুসারে যেভাবে সাজানো দেখি, একটু ভাবলে আমাদের কি ফ্যালফেলে বিহ্বল হতে হয় না?
[আরও পড়ুন: বুথফেরত সমীক্ষায় অনেক এগিয়ে এনডিএ, ২০১৯-এর এক্সিট পোলকেও ছাপিয়ে গেল?]
সত্যিই কি শরৎ এলে বাঙালি আর শুনতে পায় বনদেবীর দ্বারে দ্বারে গভীর শঙ্খধ্বনি? আর হেমন্ত ঋতু অধুনা লুপ্ত। হেমন্তর প্রথম হিমের রাত, তার কুয়াশা-ঢাকা গগনের তারা, তার ঝরা-কাশ আর দীপালিকার আলোর ডাক শুধু বেঁচে আছে রবীন্দ্রনাথের হেমন্তবন্দনার গানে। আর, উত্তুরে বাতাস কী করে লুঠ করে কুন্দকলির কুঞ্জ আর জায়গা করে দেয় বসন্তের ফুলকে, তাও কি জানে এ-যুগের বাঙালি? জানে কি বাঙালি সেই বর্ষা, যে-বর্ষা মেঘমল্লারে সারা দিনমান গেয়ে চলে মন হারানোর গান? আমরা এখন শুধু ভয় পেতে জানি। শীত এলেই আতঙ্কে ভুগি ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশি-জ্বরের। বর্ষার প্যাচপ্যাচানি, পথঘাটের ডুবে যাওয়া, মেঘের অন্ধকার, ঝড়জল, সবেতেই আমাদের আশঙ্কা ও অনীহা। আর গ্রীষ্ম? প্রতিটি বাঙালির অসহনীয় ঋতু।
[আরও পড়ুন: দক্ষিণে বিজেপির সূর্যোদয়, বুথ ফেরত সমীক্ষায় প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে কি?]
এখনকার কোনও বাঙালির রোদে-পোড়া দুপুরবেলায় কি একবারও মনে হবে, ‘মধ্যদিনের বিজন বাতায়নে ক্লান্তিভরা কোন বেদনার মায়া স্বপ্নাভাসে ভাসে মনে-মনে’? যে-বাঙালি বহু যুগ আগে ভাবতে পেরেছিলেন এক গ্রীষ্মর দুপুরে মায়াময় গ্রীষ্মগানের এই দু’টি প্রথম পঙ্ক্তি, তিনি তাঁর শান্তিনিকেতনের বাড়ির জানলায় দুপুরবেলা একা দাঁড়াতেন জোব্বা পরে ভুবনডাঙার মাঠ দিয়ে হু-হু করে আসা বীরভূমের গ্রীষ্মর ‘লু’ উপভোগ করতে! ঝলসে রাঙা হয়ে উঠত তাঁর মুখ। তাঁর হৃদয় বলত, ‘আমি বৃষ্টিহীন বৈশাখী দিন, সন্তাপে প্রাণ যায় যে পুড়ে’। তাঁর কোনও এসি ছিল না। বর্ষায় তাঁর মাটির বর্ম ‘শ্যামলী’-র ছাদ গলে ঘরে প্লাবন নামত! তাঁর লেখা যে ঋতুমুখর হবে, স্বাভাবিক।