shono
Advertisement

তিরাশি থেকে তেইশ

কারা ভিড়ের ভিতর থেকে রাজনৈতিক স্লোগানের সুরে ‘ভারতমাতা কি জয়’ বলছিল?
Posted: 02:37 PM Nov 08, 2023Updated: 02:37 PM Nov 08, 2023

এই খেলা দেখতেই তো ক্রিকেটকে ভালবাসা। গাভাসকর, শচীন, সৌরভ, রাহুল, ধোনি, যুবরাজদের ভক্ত হয়ে ওঠা। বিরাট তো সেই ঘরানার জাদুকর যিনি বিপক্ষের আস্ত একটা স্বপ্ন ভ্যানিশ করতে পারেন। ১০১ করে দেশকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে মিশে গেলেন ইডেনের ভিড়ে। সবার জার্সির রঙ নীল। আশ্চর্য, সবার পিছনে লেখা ১৮। কলমে কিংশুক প্রামাণিক

Advertisement

অনেক দিন পর ইডেনে ওয়ান-ডে ম্যাচ প্রায় পুরোটা ধৈর্য ধরে দেখলাম। বিরাট কোহলির ‘শচীনত্ব প্রাপ্তি’ ছাড়া এ ম্যাচে বলার মতো কিছু নেই। ছেলেটাকে প্রথমবার এত কাছ থেকে দেখতে দেখতে হারিয়ে যাই চল্লিশ বছর আগে।

সে-ও ছিল ওয়ান ডে-র রাত। ১৯৮৩ সালে ২৫ জুন পাড়ায় পাড়ায় আষাঢ়েই নেমে এসেছিল দিওয়ালির আলো। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে ঢাক-ঢোল, খোল-করতাল-খঞ্জনি, হাতা-খুন্তি, বাজি-আবির নিয়ে যাচ্ছিল আবালবৃদ্ধবণিতার বিজয় মিছিল। অতীব সংবেদনশীল, রক্ষণশীল পিতৃদেবের শিশুর মতো ছুটোছুটি দেখে খানিক হতবাক হই। মনে প্রশ্ন এসেছিল, ক্রিকেটে কী এমন জাদু আছে যে পর্বতকে নড়িয়ে দেয়?

নেহাতই নাবালক আমি ক’দিন ধরে জানতে পারছিলাম একদিনের ক্রিকেটে বিশ্বজয়ের দিকে একটু-একটু করে নাকি এগিয়ে যাচ্ছে ভারত। ব্রিটিশদের সেমিফাইনালে গুঁড়িয়ে যখন মহিন্দর অমরনাথরা ফাইনালে গেলেন তখন থেকে বাড়িতে উৎসবের মেজাজ।

টেলিভিশন আসেনি। একটি মাত্র রেডিওর ঘাড়ের উপর উপচে পড়েছিল ৫১টি রেশন কার্ডের মালিকরা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে, অতিরিক্ত ব্যাটারি কিনে এনে সেটিকে যত্ন করে রাখা হল বিশাল লাল বারান্দার মাঝে গোল টেবিলে। যেন ওটি লর্ডস, চারপাশে স্টেডিয়ামে বসবে দর্শকরা।

একান্নবর্তী পরিবারে এই প্রথম একটি ইসু্যতে সবাই একমত, সবাই একজোট। যারা বিবিধ ভারতীতে ছায়াছবির গান ভালবাসে, যারা রবিবার দুপুরের ‘অাকাশবাণী’-র নাটক শুনতে শুনতে মাংস-ভাতের ঢেকুর তোলে, তাদেরও গায়ে ১০৪ ক্রিকেট জ্বর। জাতীয়তাবোধের অাবেগে ফুটন্ত একটি পরিবারে সেদিন জামবাটির দখল নিয়ে ঝগড়া নেই। হৃদয়ে শুধু বিশ্বকাপ!

অবশেষে সেই অতিমানবীয় কাণ্ড। প্রবল পরাক্রমী ওয়েস্ট ইন্ডিজের দর্পচূর্ণ। হরিয়ানা হ্যারিকেন কপিল দেবের হাতে বিশ্বকাপ। অবিশ্বাস্য জয়ে আবেগে ডুবে গেল সমাজ। জাত-কুল-মান বাইশ গজে একাকার। ভোর হল, সূর্য উঠব-উঠব করছে। বিজয় মিছিল আর শেষ হয় না।

না না, বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলা এখনকার ওয়েস্ট ইন্ডিজের কথা বলছি না। সেদিনের ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে ছিলেন ছ’-সাত ফুট লম্বা কৃষ্ণকায় বিশালাকায় কিছু পুরুষ- যাঁদের নাম ক্লাইভ লয়েড, ভিভিয়ান রিচার্ড, মাইকেল হোল্ডিং, ম্যালকম মার্শাল। ব্যাটে নির্দয় ঔদ্ধত‌্য। বলে গনগনে আগুনের তেজ। ভারতীয় দল দশভুজার শক্তি ধারণ না-করলে সেদিনের সেই ‘মহিষাসুর’ বধ হয় না।

সেই শুরু ক্রিকেটপ্রেম। গাভাসকার থেকে শচীন তেন্ডুলকর: প্রায় পঁচিশ বছর আমার নাওয়া-খাওয়া, পড়াশোনা-প্রফেশনে ‘এক্সট্রা এনার্জি’ হয়ে ঢুকে ছিল ক্রিকেট। ওয়ান ডে মানে একটি গোটা দিন নষ্ট করেও তৃপ্তি। টেস্ট ম্যাচে প্রিয় নায়ক ৯৯-এ এসে দাঁড়ালে বুক দুরুদুরু করত।

একদিন সেই আবেগকে আরও সাতশো গুণ বাড়িয়ে দিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নামে এক যুবক। রে-রে করে উঠেছিল দিল্লি-মুম্বইয়ের ক্রিকেট পণ্ডিতরা। আক্রোশ ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলত। কিন্তু স্টেপ আউট করে সেসব মাঠের বাইরে ফেললেন রণচণ্ডী ‘চণ্ডীর ছেলে’। ছেলেটার ব্যাটে আমফানের রোষ, মাঠের ভিতর পৌরুষত্বের জোশ। দুইয়ে মিলে একদিন ‘প্রিন্স অফ ক্যালকাটা’ অধিনায়কের আর্ম ব্যান্ড পরলেন। কপিল-উত্তর ভারতীয় ক্রিকেটকে শেয়াল থেকে সিংহের রূপ দিলেন।

আমি এই ‘পলিট্রিক্স’ কলামে ক্রিকেটীয় সমর্থনকে দূরে সরিয়ে একাধিকবার রাজনৈতিক ইস্যুতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেছি। যুক্তি দিয়ে প্রশ্ন রেখেছি, কেন তিনি সাপ এবং ব্যাঙ দুইয়ের গালে চুমু খাবেন? তাঁকে এসব মানায় না। কিন্তু বিশ্বাস করুন, যেদিন ভারতীয় দল থেকে এই সৌরভকেই বাদ দিয়ে দেওয়া হল, সেদিন বড় ব্যথা লেগেছিল বুকে। অভিমানে ক্রিকেট খেলা দেখাটাই বন্ধ করে দিই। বঙ্গসন্তানের পক্ষে তখন এতটাই একরোখা যে বিসর্জন দিলাম আমার প্যাশন। মন থেকে হারিয়ে গেল ক্রিকেট।

ভারতীয় ক্রিকেটকে বিশ্বজয়ের স্বাদ দিয়েছিলেন কপিল দেব, ধ্রপদী ছন্দের ব্যাটে দুনিয়াকে মাত করেছিলেন সুনীল গাভাসকার। এবং ১০০ সেঞ্চুরির মালিক শচীন তেন্ডুলকরের বিক্রমকে সম্মান জানিয়ে বলছি, সৌরভের অবিচার এখনও ভুলতে পারিনি। এই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যেমন নেতাজির নামটা সবার আগে থাকবে, তেমনই অস্বীকার করা যাবে না সৌরভই ভারতীয় দলে এনেছিলেন ‘গ্লাসনস্ত-পেরেস্ত্রৈকা’। বদলে দিয়েছিলেন ক্রিকেটারদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। তদুপরি লবির খেলায় অবিচার দেখে নিজেকে সরিয়ে নিলাম। একান্ত ব্যক্তিগত আবেগপ্রবণ প্রতিবাদ। হয়তো ভুল ছিল। কিন্তু যা ঠিক মনে হয়েছে, তাই করেছি। সৌরভের এই অপমান প্রাপ্য ছিল না।

স্বভাবতই প্রায় পনেরো-ষোলো বছর ভারতের খেলা আর মন দিয়ে দেখা হয়নি। আইপিএল ধামাকা নিতে ইডেনে গিয়েছি ঠিকই, কিন্তু সেই উত্তেজনা স্টেডিয়ামের বাইরে পা ফেলতেই মিলিয়ে গিয়েছে। রবিবার যখন ইডেনে গেলাম তখন আমার পরিচিত একজনই, তিনি বিরাট কোহলি। নানা সমীকরণে তাঁকে নজরে রাখতেই হয়। বাকিদের নাম শুনি, কাগজে ছবি থাকে। কিন্তু কে যে কী করে তা মন দিয়ে দেখিই না। দেখতে ইচ্ছাও করে না।

তাহলে কেন সেদিন ইডেনে গেলাম?
এক, কলকাতার বুকে বিশ্বকাপের খেলা হচ্ছে, যাব না! দুই, বিরাট কোহলির সেদিন জন্মদিন। ৩৫ শেষ, ৩৬ শুরু। সেঞ্চুরি করলে ধরে ফেলবেন শচীনকে। দেখব না? তিন, একটি টিকিটের জন্য যে হাহাকার গত ক’দিন হল, বন্ধু, শুভানুধ্যায়ীদের চাপে স্যান্ডউইচ হলাম, সেই মহানাটে্যর রঙ্গমঞ্চের সাক্ষী না হলে স্রোতের বিপক্ষে হাঁটা হয়ে যাবে! তাই চলে গেলাম। আর ভাগি্যস গেলাম!

[আরও পড়ুন: ছেলে বিক্রি! দেশের ঘুণ ধরা অর্থনীতির দুঃসহ ছবি?]

প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে বিরাট নামক ছেলেটির উপন্যাস রচনা দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, মেসির মতোই কোহলির বয়স সংখ্যামাত্র। ও কবে পঞ্চাশের কাছাকাছি ওয়ান ডে সেঞ্চুরি করে ফেলল? চোখ মেলে তো দেখিইনি! দেখিনি বলে পৃথিবী থেমে থাকেনি।

বিরাটের ব্যাটে হেমন্তের স্নিগ্ধতা। পিছনের পায়ে ভর দিয়ে উইকেটের চারপাশে মণিমুক্তোর ছড়িয়ে তাজমহল গড়ে দিলেন। কখন একশোয় পৌঁছে গেলেন কে জানে! সাড়ে তিন ঘণ্টা কেটে গেল। এই খেলা দেখতেই তো ক্রিকেটকে ভালবাসা। গাভাসকার, শচীন, সৌরভ, রাহুল, ধোনি, যুবরাজদের ভক্ত হয়ে ওঠা। বিরাট তো সেই ঘরানার জাদুকর যিনি বিপক্ষের অাস্ত একটা স্বপ্ন ভ্যানিশ করতে পারেন।

১০১ করে দেশকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে মিশে গেলেন ইডেনের ভিড়ে। সবার জার্সির রং নীল। আশ্চর্য, সবার পিছনে লেখা ১৮। ওটি কোহলির জার্সি নম্বর। একেবারে যথার্থ। এই বিরাটের ক্রিকেট মনে করাল কবি সুকান্তের ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতাকে–
আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
স্পর্ধায় নেই মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।

এখানেই এই লেখার শেষ হতে পারত।কিন্তু ইডেনে পর্ব শুধু বিরাটময় নয়। মাঠে যা ঘটল তা লজ্জাজনক। একটু লিখতেই হয়। গ্যালারি দখল ভিনরাজ্যের। কেন টিকিট অমিল বোঝা গেল। বাংলার ক্রিকেটপ্রেমীদের বঞ্চিত করে হাজার-হাজার টিকিট বাইরে চলে গিয়েছে। ভাবছিলাম গুজরাট-দিল্লি-মুম্বইয়ে খেলা হলে বাংলা এত টিকিট পাবে কি?

ভারতমাতার নামে ‘জয়’ বলতেই মাঠে আসা। কিন্তু কারা ভিড়ের ভিতর থেকে রাজনৈতিক স্লোগানের সুরে ‘ভারতমাতা কি জয়’ বলছিল? কেন-ই বা ভারতীয় ক্রিকেট দলের জার্সিতে গেরুয়াকরণ? কারা তেরঙ্গা ঝান্ডার ভিতর নানা কথা লিখে অপমান করল? ক্রিকেট বোর্ডে রাজনীতি অনেক আগেই ঢুকেছিল, এবার বাইশ গজেও। কই, ’৮৩-র রাত তো এমন ছিল না!

[আরও পড়ুন: ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধে কি গদি টলমল বাইডেনের?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement