shono
Advertisement

‘হাত’ ধরল কর্ণাটক

বিজেপি ধরেই নিয়েছিল হাহাকারক্লিষ্ট মানুষের একমাত্র প্রলেপ ‘ধর্ম’।
Posted: 03:18 PM May 17, 2023Updated: 03:18 PM May 17, 2023

বিজেপি ধরেই নিয়েছিল মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, অভাব-অনটন, যাতনা ও হাহাকারক্লিষ্ট মানুষের একমাত্র প্রলেপ ‘ধর্ম’। কর্নাটক বোঝাল, ক্ষুধার বিকল্প ধর্ম নয়। কলমে সৌম্য বন্দ্যাোপাধ্যায়

Advertisement

ত সপ্তাহে এই দিন ছিল কর্ণাটকের ভোট। সেদিন এই স্তম্ভে বিজেপির ‘কংগ্রেসায়ন’-এর বিপদ নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করেছিলাম। লিখেছিলাম, ইন্দিরা গান্ধীর তৈরি ‘হাইকমান্ড’ কালচার বিজেপিকে গ্রাস করেছে। ক্ষমতার অতিকেন্দ্রিকতা কংগ্রেসকে বিপজ্জনক গাড্ডায় ফেলেছে, নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সেই মডেল আঁকড়ে সেই রাস্তাতেই হাঁটছে। ফল কতটা বিধ্বংসী, কংগ্রেস তার প্রমাণ। কর্ণাটকের জনতার রায়ও বিজেপিকে ক্ষমতার অতিকেন্দ্রিকতার বিপদ দেখিয়ে দিল। রাজ্য নেতৃত্বকে নগণ্য করে কর্নাটকের দায়ভার প্রধানমন্ত্রী নিজেই বৃষস্কন্ধে তুলে নিয়েছিলেন। এই বিপর্যয়ের দায় তাঁরই। কর্ণাটকের রায় রাজনীতির কারবারি ও ছাত্রদের নানাভাবে শিক্ষিত করবে। কেউ শিক্ষিত হতে চাইবে কি না অন্য কথা। বিজেপির বিষয়টাই দেখা যাক।

ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে রিমোট কন্ট্রোলে রাজ্য চালানো গুজরাট বা উত্তরাখণ্ডে সফল হয়েছে বলে কর্ণাটকেও হবে- এমন ভাবনাটাই ছিল ভুল। নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ জুটি কিন্তু তা মানতে চাননি। তাই ইয়েদুরাপ্পাকে ‘মার্গদর্শক’ করে দেওয়া। পালকের মতো হালকা বোম্মাইকে দিয়ে রাজপাট নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। এতে হলটা কী? কর্ণাটকে বিজেপির জন্মদাতা ও প্রতিপালক ইয়েদুরাপ্পা বসে গেলেন। লিঙ্গায়েত সমাজের ভ্রু কুঞ্চিত হল। যে-সমাজ ছিল বিজেপির অভিন্ন মিত্র, ১৯৮৯ সালের পর থেকে যাঁর হাত ধরে লিঙ্গায়েত ভোট বিজেপি ঝুলিতে ভরে এসেছে, সেই ইয়েদুরাপ্পার সঙ্গে লিঙ্গায়েত ভোটও অস্ত গেল। কার লাভ হল তাতে? সংখ্যা বলছে, কংগ্রেস ৪৬ জন লিঙ্গায়েতকে প্রার্থী করেছিল, ৩৭ জন জয়ী হয়েছেন।

বাস্তব অস্বীকার করে উটপাখি হলে কী হয়, সেই শিক্ষাও কর্ণাটক প্রধানমন্ত্রীকে দিল। বোম্মাই মন্ত্রিসভার নির্লজ্জ দুর্নীতির কাহিনি যখন সারা দেশে পল্লবিত, ‘পেসিএম’ ও ‘৪০ পার্সেন্ট সরকার’ স্লোগান নিয়ে কংগ্রেস যখন রাজ্য দাপাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী তখন প্রতিটি জনসভায় ৪০ বছর আগে রাজীব গান্ধীর মন্তব্য টেনে প্রমাণ করতে চাইলেন, কংগ্রেস আরও দুর্নীতিগ্রস্ত। বুঝলেন না, বোম্মাই সরকারের দুর্নীতি ও অপদার্থতা ঢাকতে গিয়ে তিনি নিজেকেই ছোট করছেন। ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’ আওয়াজ তুলে তিনিই তো দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘ক্রুসেডর’ হয়েছিলেন!

বোম্মাই সরকারের অপকর্ম চাপা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী এটাও প্রমাণ করলেন, জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিকের অভিযোগ ফেলে দেওয়ার মতো নয়। দুর্নীতি মোটেই তাঁর অপছন্দের কিছু নয়।

সব পায়ের জুতোর মাপ এক হয় না। এই সাধারণ জ্ঞানটুকুও কর্ণাটক এবার দিয়ে গেল। বিজেপি ধরে নিয়েছিল মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, অভাব-অনটন, যাতনা ও হাহাকারক্লিষ্ট মানুষের একমাত্র প্রলেপ ‘ধর্ম’। ভেবেছিল, আর্যাবর্তের টোটকা বিন্ধ্য পর্বতমালার দক্ষিণেও কাজে দেবে। উত্তর ভারতের ফর্মুলা কর্নাটকে প্রয়োগের জন্য গত দেড়-দু’বছর ধরে বিজেপি শুধু হিজাব-হালাল-আজান করে গিয়েছে। টিপু-সাভারকরে মন বিভাজনের চেষ্টা করেছে। শেষবেলায় বজরংবলীর শরণাগত হয়েছে। ভেবেছে, উগ্র-হিন্দুত্বই সর্বরোগহর বটিকা। অথচ উপকূলবর্তী কর্নাটক ছাড়া আর কোথাও ‘ঘৃণার দোকান’-এ বিজেপি কেনাকাটা সারতে পারেনি। কর্ণাটকে বোঝাল, ক্ষুধার বিকল্প ধর্ম নয়।

সবচেয়ে বড় কথা, তাদের এই ক্ষীণদর্শী রণনীতি রাজ্যের ১৩ শতাংশ মুসলমান ভোটারকে কংগ্রেসের কোলে টেনে এনেছে। দক্ষিণ কর্ণাটকের মুসলমান যেখানে জেডিএস ও কংগ্রেসের মধ্যে এতদিন সমর্থন বাঁটোয়ারা করে এসেছে, সেখানে এবার তারা জেডিএস-কে
ত্যাগ করে কংগ্রেসকে কাছে টেনেছে। নইলে তল্লাটের ৬৪ আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৪৪টি
জিততে পারে না।

বিজেপির কর্ণাটক নীতি যেখানে ক্ষমতার অতিকেন্দ্রিকতা থেকে উৎসারিত, কংগ্রেস সেখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে সম্মান জানিয়েছে। মোদি কর্ণাটককে ‘গ্লোবাল প্লেয়ার’ হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, কংগ্রেস ফেরি করেছে অভাব ও যাতনা ঘোচানোর ছোট ছোট স্বপ্ন। শেষ বিচারে লড়াইটা তাই হয়ে দাঁড়ায় বৈভব বনাম দারিদ্রে‌র। মোদি হয়ে ওঠেন সম্পদ ও বৈভবের প্রতিভূ, কংগ্রেস প্রান্তেবাসীর সাহারা। দলিত, অনগ্রসর, মুসলমান, তফসিল জাতি-উপজাতি কীভাবে তাদের আঁকড়ে ধরেছে, তার ছোট্ট নমুনা প্রায় অর্ধেক আসনে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে কংগ্রেসের জয়। কর্ণাটক কংগ্রেসকে বানভাসি করেছে।

একতা কী অসাধ্য সাধন করে, দিল্লির অযথা দাদাগিরি কীভাবে রাজ্যের সম্মানে ঘা দেয়, সেটাও কর্ণাটকের বড় শিক্ষা। কংগ্রেসের এবারের কর্ণাটক অভিযান কপিবুক ক্রিকেটের মতো রাজনীতির ‘রেডবুক’। সিদ্দারামাইয়া ও শিবকুমার সব বিভেদ শিকেয় তুলে হাতে-হাত ও কাঁধে-কাঁধে মিলিয়ে ময়দানে নেমেছেন। এতখানি ঐক্যবদ্ধ কংগ্রেস শেষ কবে দেখা গিয়েছে গবেষণার বিষয়। জানা নেই, শেষ কবে ‘হাইকমান্ড’ এমন পিছন থেকে নিরীক্ষকের ভূমিকায় নেমেছিল। মোদির ‘ভোকাল ফর লোকাল’ স্লোগান পরিমার্জন করে কংগ্রেস কর্নাটকের নির্বাচনকে ‘হাইপার লোকাল’ করে তোলে। অথচ মোদি শুনিয়ে গেলেন কর্ণাটকের ‘গ্লোবাল ইমেজ’ বাড়ানোর কথা। সাইবার বেঙ্গালুরু তাতে মোহিত হলেও দরিদ্র-অবহেলিত কর্নাটক তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ভূমিপুত্র ইয়েদুরাপ্পার অসম্মানও তারা মেনে নেয়নি।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অসম্মানের মাশুল পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসকে আজও গুনতে হচ্ছে। ইয়েদুরাপ্পাকে অসম্মানের খেসারত বিজেপিকে কতদিন দিতে হবে?

কংগ্রেসের আগামী দিনের রাজনীতি কোন খাতে বইতে পারে সম্ভবত তার একটা ইঙ্গিত এবার কর্নাটকী প্রচার পর্ব থেকে মিলেছে। নির্বাচনী ইস্তাহারে ‘নিষিদ্ধ’ পিএফআই-এর সঙ্গে বজরং দলের মতো উগ্র-হিন্দুত্ববাদী সংগঠনকে একাসনে বসিয়ে উভয়ক্ষেত্রেই কঠোর হওয়ার বার্তা দিয়েছে কংগ্রেস। এ নিয়ে ব্যাপক শোরগোল ও চর্চাও হয়েছে। অনেকেই তা কংগ্রেসের আত্মঘাতী গোল মনে করেছে। বিজেপিও বিস্তর জলঘোলা করেছে। কিন্তু অন্যান্য অকিঞ্চিৎকর বিষয়ের মতো এটির দশাও বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া। যদিও বার্তাটি অর্থবহ।

বিজেপির কট্টর হিন্দুত্ববাদের মোকাবিলা কীভাবে করা উচিত সে নিয়ে কংগ্রেস বরাবরই দ্বিধান্বিত। ভোট-রাজনীতির স্বার্থে কখনও তারা নরম হিন্দুত্বকে আঁকড়ে ধরেছে। কখনও ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা আওড়েছে। কখনও উগ্র-হিন্দুত্বর সমালোচনা করেছে। কখনও বা সংখ্যাগরিষ্ঠর সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে সরব হয়েছে। এই প্রথম বহুত্ববাদী ভারতের স্বার্থে কংগ্রেস এক ‘বিকল্প’ রাজনৈতিক আখ্যান উপস্থাপন করল। পিএফআই-এর মতো ‘নিষিদ্ধ’ সংখ্যালঘু সংগঠনের সঙ্গে বজরং দলের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ জঙ্গি সংগঠনকে একাসনে বসিয়ে তারা বলেছে, আইনের চোখে অপরাধীদের নিষিদ্ধ করতে কংগ্রেস পিছপা হবে না। আইনের চোখ দিয়ে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতার বিচার, ভেদাভেদ না করা, দুই মানসিকতাকে এক দৃষ্টিতে বিচার করে প্রকৃত বহুত্ববাদের বিকাশ ঘটানো রাজনীতির নতুন আখ্যান হয়ে উঠলে তা হবে যুগান্তকারী। বিজেপির প্রবল বিরোধিতার মুখে প্রচারের শেষ পর্বে কংগ্রেস রক্ষণাত্মক হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ভাবনা থেকে সরে আসেনি। আগামী দিনে অটল থাকতে পারলে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃত সংজ্ঞা নির্ধারিত হতে পারবে।

কর্ণাটকের রায় নরেন্দ্র মোদির বিদায় ঘণ্টা, এমন ধারণা কষ্টকল্পিত। কারণ প্রধানত দু’টি। প্রথমত, বিজেপির ভোট-শেয়ার অপরিবর্তিত। দ্বিতীয়ত, কিছুকাল ধরে বহু রাজ্য বিধানসভা ও লোকসভা ভোটের তারতম্য অনুধাবন করতে শিখেছে। কর্নাটক তার বড় উদাহরণ। একইরকম আচরণ পরিলক্ষিত ওড়িশা, গুজরাত, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, দিল্লি, উত্তরাখণ্ড ও হিমাচল প্রদেশেও। গত কয়েক বছর ধরে এই রাজ্যগুলির বিধানসভা ও লোকসভা ভোটের ফল দেখলে তা স্পষ্ট হয়। ক্রমশই এটা ‘ট্রেন্ড’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রাজ্যে যে-ই হোক, কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদি। যারা মনে করে শক্ত হাতে দেশ-শাসনের জন্য মোদিই উপযুক্ত, কারণ তিনি দৃঢ় ও নির্ণায়ক, তাদের সেই বিশ্বাস থেকে টলাতে হলে লোকসভার ভোটকেও আঞ্চলিকতার আবহে আবদ্ধ রাখা দরকার। সেই সঙ্গে প্রয়োজন মোদির বিপ্রতীপে বিশ্বাসযোগ্য সর্বজনগ্রাহ্য এক ‘বিকল্প’ চরিত্র খাড়া করা। বিরোধীরা এখনও ছাড়া-ছাড়া। পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের আধারে বিরোধীরা জমাট না বঁাধলে মোদি অপসারণ স্বপ্নই থেকে যাবে। কর্ণাটক আশা জাগিয়েছে। স্বপ্ন সাকার করতে বিরোধীদের বহু মাইল হাঁটা বাকি।

(মতামত নিজস্ব)

saumyabandyo@gmail.com

[আরও পড়ুুন: এই অভিমন্যু শত্রুদের চক্রব্যূহ ভাঙতে শিখে গিয়েছে]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement