পরিষেবা নিয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে এককালে বিএসএনএল গ্রাহকেরা চলে যায় অন্য বেসরকারি সংস্থার গ্রাহক হতে। কিন্তু হালে ডেটা রিচার্জের অবাক করা মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেসরকারি টেলিকম সংস্থাগুলির উপর ক্ষোভ উগরে দিয়ে ফের বিএসএনএল-মুখী আমজনতা। লিখছেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়।
প্রায় তিন দশক আগে, ১৯৯৫ সালে, এ-দেশে প্রথম মোবাইল ফোন কল হয়েছিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় টেলিকম মন্ত্রী সুখরাম এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর মধ্যে। সেদিনের ওই পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাটি হল ভারতের বি কে মোদি গোষ্ঠী এবং অস্ট্রেলীয় টেলিকম জায়ান্ট ‘টেলস্ট্রার’-এর যৌথ উদ্যোগে গঠিত ‘মোদি টেলস্ট্রা’। যদিও পরবর্তীকালে অংশীদারদের মধ্যে বিবাদের জেরে সংস্থাটি ‘এয়ারটেল’-এর কাছে বিক্রি হয়ে যায়। তখন, একেবারে প্রথমে, যেসব সংস্থা এই পরিষেবা দেওয়ার লাইসেন্স পেয়েছিল সেগুলিকে বলতে গেলে এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না, কারণ অন্য নামে পরিচিত হয়েছে অথবা অন্য কোনও সংস্থার সঙ্গে মিশে গিয়েছে কিংবা একেবারে ঝঁাপ বন্ধ হয়েছে।
সম্প্রতি, টেলিকম সংস্থার মাশুল ঘিরে তোলপাড় সোশ্যাল মিডিয়া। কারণ, জুলাই মাসের শুরুতেই দেশের প্রধান তিনটি টেলিকম সংস্থা– ‘রিলায়েন্স জিও’, ‘ভারতী এয়ারটেল’ এবং ‘ভোডাফোন আইডিয়া’ তাদের ‘ডেটা প্ল্যান’-এর দাম রীতিমতো বাড়িয়েছে। দু’-দশক আগে অনিল অাম্বানির ‘রিলায়েন্স কমিউনিকেশন’ (রিলায়েন্স ইনফোকম) সস্তায় পরিষেবা দিয়ে টেলিকম ক্ষেত্রকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তখন ওই সংস্থাটির বিজ্ঞাপন ‘কর লো দুনিয়া মুট্ঠি মে’ খুবই জনপ্রিয় হয়। যদিও পরবর্তীকালে ঋণের বোঝা কমাতে ব্যর্থ হওয়ায় ক্রমশ সংস্থাটির পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। সেই তুলনায় অনিলের দাদা মুকেশ আম্বানির ‘রিলায়েন্স জিও’ অনেক পরে টেলিকম দুনিয়ায় পা রাখে যদিও একচেটিয়া বাজার দখলের উদ্দেশ্যে জিও শুরুতেই সস্তায় পরিষেবা দিতে নেমে পড়ে। জিও-র দেওয়া অফার অন্যান্য প্রতিযোগী টেলিকম সংস্থার রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। বাজারে টিকে থাকতে পাল্টা সস্তায় অফার দিতে থাকে বাকিরা। তবে অনেকেই তখন গ্রাহকদের সতর্ক করেছিল জিও-র সস্তার অফারে না ভুলতে, কারণ একচেটিয়া বাজার দখলের উদ্দেশ্যে এমন অফার দেওয়া হচ্ছে। বাজার দখল হয়ে গেলে এমন দাম বাড়াবে যে, গ্রাহকদের নাভিশ্বাস উঠবে।
[আরও পড়ুন: ৪ মাসের হাড়ভাঙা খাটুনি! ‘পুরুষতান্ত্রিক’ স্পাই ইউনিভার্সকে কবজা করতে আলিয়ার ব্রহ্মাস্ত্র ‘আলফা’]
জিও একা পুরো বাজার দখল না করলেও বর্তমানে জিও, এয়ারটেল এবং ভোডাফোন মিলিতভাবে এ-দেশের টেলিকম বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য করছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এ-দেশের মোট ১১৯ কোটি সেলফোন ব্যবহারকারীর মধ্যে ১০৯ কোটি সেলফোন ব্যবহারকারী এই তিন সংস্থার গ্রাহক।
সংস্থাগুলির যুক্তি, ব্যবহারকারী-প্রতি একটি ‘স্বাস্থ্যকর গড় আয়’ (এআরপিইউ) বজায় রাখার জন্য এই চার্জ বৃদ্ধি প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু প্রশ্ন, যেখানে ২০২৩-’২৪ সালে ‘রিলায়েন্স জিও’ এবং ‘ভারতী এয়ারটেল’-এর নিট মুনাফা যথাক্রমে ২০,৬০৭ কোটি টাকা এবং ৭,৪৬৭ কোটি টাকা, সেখানে এই মাশুল বৃদ্ধির কতটা প্রয়োজন ছিল? এই বৃদ্ধির জন্য সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় সরকার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে– টেলিকম নিয়ন্ত্রকের অধীনে বাজারের দ্বারা এই মূল্য নির্ধারিত হয়। এখানে সরকারের কোনও ভূমিকা থাকে না।
[আরও পড়ুন: অনন্ত আম্বানির বিয়ের অতিথি তালিকায় চমক! বরিস জনসন, কিম কার্দাশিয়ান-সহ আর কারা থাকছেন?]
তবে, তিন বেসরকারি সংস্থার মধ্যে গ্রাহকরা মুকেশ আম্বানির জিও-র উপর বেশি রাগ উগড়ে দিচ্ছে। বিশেষত, গত কয়েক মাস ধরে মুকেশ অম্বানির ছেলের বিয়ে উপলক্ষে যে এলাহি আয়োজন ও খরচের প্রবণতা দেখা গিয়েছে, তা দেখে গ্রাহকদের অভিমত, বিয়ের ওই খরচের খরচ তুলতেই গ্রাহকের উপর ভারী মাশুলের বোঝা চাপিয়েছে জিও। তারই জেরে সোশ্যাল মিডিয়ায় আওয়াজ উঠছে জিও বয়কটের। শুধু তা-ই নয়, এই পরিস্থিতিতে এবার পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা বদলে ফেলে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিএসএনএল-এর গ্রাহক হওয়ার জন্যেও সওয়াল উঠছে।
কিন্তু বর্তমানে অন্যান্য বেসরকারি প্রতিযোগীর সাপেক্ষে রাষ্ট্রায়ত্ত বিএসএনএল-এর তো প্রতিবন্ধী দশা! কোনও দিনই বিএসএনএল ত্রুটিমুক্ত ছিল না অবশ্য। বিএসএনএলের ল্যান্ডলাইন হোক বা ব্রডব্যান্ড, খারাপ হলে তা ঠিক হতেই চায় না– পরিষেবা নিয়ে গ্রাহকদের এমন বিস্তর অভিযোগ ছিল এবং আছে। তবুও পিছন ফিরে তাকালে বোঝা যায়, আগে এতটাও পঙ্গু দশা ছিল না এ সংস্থার।
২০০৮ সালে ‘ভারতী এয়ারটেল’ ৫৭ মিলিয়ন, এবং ‘ভোডাফোন-এসার’ ৪১ মিলিয়ন ব্যবহারকারী নিয়ে একেবারে শীর্ষে ছিল দুই সংস্থা। তারপরই তৃতীয় স্থানে ছিল ৩৩.৭ মিলিয়ন ব্যবহারকারীদের নিয়ে ‘বিএসএনএল’। সেই সময় ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে নেটওয়ার্কে ৯৪ মিলিয়ন নতুন লাইন যোগ করার কথা ঘোষণা করেছিল বিএসএনএল। কিন্তু প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ফলে দু’ বছর পর ২০১০ সালে, পুরো প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যায়। একইসঙ্গে বিএসএনএলের সম্প্রসারণ পরিকল্পনাও রীতিমতো ধাক্কা খায়। ওই সময় এয়ারটেল, রিলায়েন্স কমিউনিকেশনস, ভোডাফোন এসার এবং আইডিয়া সেলুলার-এর পর অর্থাৎ পঞ্চম স্থানে নেমে আসে বিএসএনএল। ২০০৭ সালের মার্চ মাসে বিএসএনএলের আয় ছিল প্রায় ৪০,০০০ কোটি টাকা। ২০০৯ সাল নাগাদ, বিএসএনএলের (BSNL) মুনাফা ৮১ শতাংশ এবং রাজস্ব ৬ শতাংশ কমে যায়।
তখন থেকেই এই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটির পতনের শুরু। এরপরে এমন পরিস্থিতি করা হল যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থাগুলি ফোর-জি পরিষেবা প্রদান করছে, সেখানে বিএসএনএল গ্রাহকদের টু-জি এবং থ্রি-জি পরিষেবা পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে, অর্থাৎ, ফোর-জি গ্রাহকদের কাছ থেকে উচ্চতর রাজস্ব উপার্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হল বিএসএনএল। অবশেষে ফোর-জি পরিষেবার অনুমতি দিলেও বিএসএনএলের প্রতি অনায্য শর্ত চাপানো হয়। কারণ শুধুমাত্র বিএসএনএল-কে স্থানীয় ফোর-জি সরঞ্জাম কেনার কথা বলা হল, যেখানে বেসরকারি অন্যান্য সংস্থাগুলিকে বিদেশি গ্লোবাল জায়ান্টদের কাছ থেকে সরঞ্জাম নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। নিরাপত্তাগত সমস্যার কথা তুলে শুধুমাত্র বিএসএনএলের জন্য এই শর্ত আরোপ করা হয়। অর্থাৎ, তখন থেকে এক অসম লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছিল এই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটিকে।
প্রতিযোগিতায় ক্রমশ পিছিয়ে যাওয়ায় কেন্দ্রের কাছে বিএসএনএল ইউনিয়ন আরজি ইতিমধ্যে জানিয়েছিল, যতদিন না পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশীয় প্রযুক্তিতে পুরোপুরি বিএসএনএল-এর ফোর-জি আনা যাচ্ছে, ততদিন ভোডাফোন-আইডিয়ার পরিকাঠামো ব্যবহার করে গ্রাহকদের ওই পরিষেবা দেওয়া হোক। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। এহেন পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের মনে হতেই পারে, বিএসএনএলের ফোর-জি পরিষেবা চালু করে ফাইভ-জি পরিষেবায় সময়মত আপগ্রেড করা হলে এভাবে মুনাফাখোর বেসরকারি টেলিকম পরিষেবা প্রদানকারীদের হাত থেকে দেশের সাধারণ গ্রাহকদের স্বার্থরক্ষা সহজ হত।
আগে দেখা যেত, পরিষেবা নিয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বিএসএনএলের গ্রাহকদের অন্য বেসরকারি সংস্থার গ্রাহক হতে। উল্টে এবার বেসরকারি টেলিকম সংস্থাগুলির উপর ক্ষোভ উগরে দিয়ে বিএসএনএলের গ্রাহক হতে চাইছে তারা। সোশ্যাল মাধ্যমে আওয়াজ উঠেছে ‘বিএসএনএল কি ঘর ওয়াপাসি’। তবে কি এবার চাকা উলটোদিকে ঘুরতে শুরু করল?