shono
Advertisement

Breaking News

বিরল সৌজন্যের সাক্ষী

এক দৃষ্টিতে প্রাক্তনের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছিলেন বর্তমান?
Posted: 12:24 PM Aug 02, 2023Updated: 01:10 PM Aug 02, 2023

কিংশুক প্রামাণিক: কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে নার্স বললেন, স্যর, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) এসেছেন আপনাকে দেখতে।
কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের টিউবে মুখ-নাক সবই ঢাকা। সাদা ধপধপে মাথাটা অর্ধেক দেখা যাচ্ছে। শরীর মিশে আছে বিছানায়। একমাত্র স্পষ্ট দেখছি ডানহাতটা। তবে বেশ ফোলা।
ভেন্টিলেশন খোলা হয়েছে। ডাক্তাররা বলছেন, অবস্থার আগের চেয়ে অনেক উন্নতি। হৃদ্‌যন্ত্র ভাল আছে। অক্সিজেনের মাত্রা ৯২-৯৪ এর মধ্যে। সমস্যা শুধু ফুসফুসে। সীমাহীন সিগারেটের ধোঁয়ায় যার অবস্থা চলতি বাংলায় লজ্‌ঝড়ে। এরপরও সকালে ডাক্তারদের নাকি বলেছেন, দ্রুত বাড়ি যেতে চান। হাসপাতাল বেশি দিন ভাল লাগে না।

Advertisement

[আরও পড়ুন: বিয়ের পর সম্পর্ক রাখছেন না প্রেমিকা! ব্রেক আপ করতেই খুন ‘প্রেমিকে’র!]

মুখ্যমন্ত্রীর কথা নার্স বলতেই শরীরটা যেন নড়ে উঠল! একটু চঞ্চল। মনে হয়, উনি পাশ ফিরতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না। তুলতে শুরু করলেন ফোলা ডানহাতটা। ধীরে ধীরে একটু একটু করে। হাতে তখন প্রবল কাঁপুনি। মনে হল, হাত নেড়ে ইঙ্গিতে কিছু বোঝাতে চাইছেন। সঙ্গে সঙ্গে উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রী বলে উঠলেন, থাক, থাক। জোর করবেন না। আমি বুঝতে পেরেছি। উনি ভাল থাকুন।
সেই মানবিক দৃশ্যের সাক্ষী উডল্যান্ডসের সুপার ডা. সপ্তর্ষি বসু, ডা. সৌভিক পাণ্ডা-সহ অন্তত পঁাচজন অভিজ্ঞ ডাক্তার। মুখ্যমন্ত্রীর দুই সর্বক্ষণের নিরাপত্তা কর্মী ও এই প্রতিবেদক-সহ দু’জন।
রোগশয‌্যায় প্রাক্তন। দেখতে এসেছেন বর্তমান। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য (Buddhadeb Bhattacharjee) ও মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়। এমন অভাবনীয় পরিস্থিতি এক হাত দূর থেকে সত্যি দেখতে পাব ভাবিনি। সোমবার বিধানসভার অধিবেশন শেষ করে মুখ্যমন্ত্রী চললেন উডল্যান্ডসে। অসুস্থ বুদ্ধবাবুকে দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল আমারও। সুযোগ হয়ে গেল মুখ্যমন্ত্রীর জন্য।
লিফ্‌টে সোজা চারতলা। পৌঁছে সামনেই ভিজিটরস’ রুমে সিপিএমের রবীন দেব, ফরওয়ার্ড ব্লকের নরেন চট্টোপাধ্যায় ও কংগ্রেসের এক যুবনেতা বসেছিলেন। রবীনবাবু মুখ্যমন্ত্রীকে দেখে এগিয়ে এলেন। একটি-দু’টি কথা হওয়ার পর উডল্যান্ডস কর্তারা মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে চলে গেলেন করিডোর ধরে ওয়ার্ডে। দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল। সিপিএম ও কংগ্রেসের নেতারা রয়ে গেলেন ভিজিটরস রুমেই।
৫১৬ নম্বর কেবিনের সামনে এসে সুপার ভিতরে নিয়ে যেতে চাইলেন মুখ্যমন্ত্রীকে। কিন্তু রাজি হলেন না তিনি। বললেন, ওঁর ইনফেকশন রয়েছে। আমি বিধানসভা থেকে এলাম। রাস্তার জামাকাপড়ে উচিত নয় ভিতরে যাওয়া। বাইরে থেকে কি দেখা যায়?
সঙ্গে সঙ্গে কেবিনের কাচের জানালার পর্দা সরিয়ে দেওয়া হল। বর্তমানের সামনে ধরা দিলেন প্রাক্তন। এই সেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য! স্বপ্ন যাঁর অঢেল ছিল। কিন্তু ইগোর আড়ালে হাজির হয়েছিল ‘দুঃসময়’। তিনি আজ প্রবল জরায় আক্রান্ত। সময় কত নিষ্ঠুর। লক্ষ করলাম তাঁকে দেখে মুহূর্তে বিষণ্ণ হয়ে গেল বর্তমানের মুখ।
আজ আর ভুল খাঁজার দিন নয়।

[আরও পড়ুন: ‘ইন্ডিয়া নয়, বলুন আইএনডিআইএ জোট’, দলীয় সাংসদদের নির্দেশ মোদির]

পরে মিডিয়ায় দেখলাম এক কংগ্রেস নেতা বলছেন, বুদ্ধবাবু হাত নাড়েননি। অবাক হয়ে গেলাম! একজন দায়িত্বশীল দলের নেতা এমন অনুমানের উপর দাঁড়িয়ে মিথ্যাভাষণ দেন কীভাবে! প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, মুখ্যমন্ত্রী যখন বুদ্ধবাবুর কেবিনে গেলেন আপনি তখন কোথায় ছিলেন?
একটি মানবিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এটাই সৌজন্য। রাজনীতির ময়দানে যত বিরোধিতা থাক, অসুখের সময় পারস্পরিক পাশে থাকাটাই সভ্যতা। এই সৌজন্যগুলি দিনকে দিন হারিয়ে যাচ্ছে।
বঙ্গ রাজনীতিতে একটা দিন ছিল ‘মমতা-বুদ্ধ’র দ্বৈরথ। সময় গড়িয়েছে। সংঘাত ইতিহাস হয়ে গিয়েছে। ১২ বছর পার মমতার মুখ্যমন্ত্রিত্বের। সিপিএমও আর সিপিএম-এ নেই। বুদ্ধবাবুও রাজনীতি থেকে অনেক দূরে।
এর আগেও বেশ কয়েকবার অসুস্থ বুদ্ধবাবুকে দেখতে তাঁর পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে গিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর জন্য উপহার পাঠিয়েছেন সৌজন্য দেখিয়ে। হাসপাতালে ভর্তি হলে চলে এসেছেন দেখতে। স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্যকে ফোন নম্বর দিয়ে বলে এসেছেন, বউদি, যখন প্রয়োজন আমাকে একটা ফোন করবেন।
এমনকী, মীরাদেবীকে এ-ও বলেছিলেন, এত ছোট ফ্ল্যাটে দমবন্ধ হয়ে আসছে বুদ্ধবাবুর। তাঁর যা রোগ তাতে খোলামেলা ফ্ল্যাট দরকার। তিনি সেই ব্যবস্থা করে দেবেন।
এটাই তৃণমূলনেত্রীর মানবিক মুখ। আন্তরিকতা যেখানে নিখাদ। সমস্যা হচ্ছে সিপিএমের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়া প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের একটি অংশের কাছে তিনি হয়ে উঠেছেন ‘দেখতে নারি চলন বাঁকা’। তৃণমূল নেত্রীকে বিজেপির চেয়েও বড় শত্রু মনে করেন তাঁরা। যদিও ঠিক তাঁর উল্টো ছবি দেখে এলাম পাটনা-বেঙ্গালুরুতে। সোনিয়া-রাহুল তাঁদের  মাঝে বসিয়ে বুঝিয়ে দিলেন জাতীয় রাজনীতিতে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর অভিজ্ঞতা, ভাবনা, বুদ্ধিমত্তা কংগ্রেসের আজ কতটা দরকার।
বস্তুত, ইতিহাস বলছে রাজনৈতিক বৈরিতা অথবা বিশ্বাসঘাতকতা কখনও মনে রাখেননি মমতা। প্রয়াত জে্যাতি বসুর সঙ্গে তাঁর সংঘাতের কাহিনি ইতিহাস হয়ে রয়েছে। এই প্রতিবেদক সাক্ষী, কেরল থেকে ফিরে বসুর জন্মদিনে
মিষ্টি-ফুল নিয়ে ইন্দিরা ভবনে হাজির হয়েছিলেন সেদিনের বিরোধী নেত্রী।
সোমেন মিত্র-র সঙ্গে বিরোধের জেরে তাঁকে কংগ্রেস ছাড়তে হয়েছিল। সেই সোমেনবাবু যেদিন তৃণমূলে যোগ দিলেন, সেদিন কালীঘাটে সাংবাদিক বৈঠক করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, সোমেনদা আমাদের নেতা। তাঁকে এবার আমরা সম্মান দিয়ে জিতিয়ে লোকসভায় পাঠাব। প্রয়াত অজিত পাঁজা, সুব্রত মুখোপাধ্যায়রা তৃণমূলের বাইরে গিয়ে কী কী বলেছিলেন, তা মনে রাখেননি মুখ্যমন্ত্রী। ফিরিয়ে নিয়ে মর্যাদার আসন দিয়েছেন।
ভোটে হারের পর ২০১১ সালে তৃণমূলনেত্রীর শপথে এসেছিলেন বুদ্ধবাবু। চরম সৌজন্য দেখিয়েছিলেন। ভাবী মুখ্যমন্ত্রী সেদিন শপথ নেওয়ার আগে স্টেজ থেকে নেমে এসে সদ্য প্রাক্তন বুদ্ধবাবু ও বিমান বসু, অসীম দাশগুপ্তকে হাতজোড় করে নমস্কার করেছিলেন।
মুখ্যমন্ত্রী কেন অসুস্থ বুদ্ধবাবুকে দেখতে যাচ্ছেন না তা নিয়ে কিছু অবোধ নানা ভ্রান্ত কথা বলছিলেন। এমনও বলা হচ্ছিল যে, তিনি নাকি বিজেপির সঙ্গে ‘সেটিং’ করেছেন, তাই বুদ্ধবাবুকে দেখতে আসছেন না। এসব হাস্যকর কথা পিছনে চলে গেল তৃণমূলনেত্রীর উডল্যান্ডস আগমনে।

[আরও পড়ুন: AI-এর কামাল, এবার ‘বার্বি’ রূপে উত্তম-সুচিত্রা, সৌমিত্র হলেন ‘ওপেনহাইমার’]

পরে আসার কারণ নিজেই বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রথমত, হাসপাতালে বুদ্ধবাবুকে দেখতে রাজনৈতিক নেতাদের ভিড়। দ্বিতীয়ত, একটু অবস্থার উন্নতির জন্য অপেক্ষা। নিয়মিত খোঁজ রাখছিলেন। সময়মতো এসে দেখা করে গেলেন। শুধু তাই নয়, ডাক্তারদের বলে গেলেন, রাজ্য চায় চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে। ফেরার পথে অাবার রবীনবাবুর সঙ্গে দেখা। হেসে বললেন, এখন উনি আগের চেয়ে ভাল আছেন। বুদ্ধবাবু শুধু আপনাদেরই নয়।
লক্ষ করছিলাম, ডাক্তারদের কাছ থেকে প্রাক্তনের চিকিৎসার খুঁটিনাটি সব জেনে নিচ্ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রয়োজন হলে আর কোন কোন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে, তা-ও বলছিলেন। তবে যখন জানতে পারলেন, সময় মতো গ্লুকোমার চিকিৎসা না হওয়ায় প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছেন তখন চুপ করে গেলেন।
এক দৃষ্টিতে প্রাক্তনের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছিলেন বর্তমান? বয়স কত নিষ্ঠুর! সেই দৃশ্যের ছবি তুলিনি। হৃদয়স্পর্শী এক বিরল সৌজন্যের সাক্ষী হওয়াটাই সেরা পাওয়া। সারা জীবন যেটি রেখে দেব মনের ক্যানভাসে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement