‘কবচ’ ব্যবস্থায় একই লাইনে দু’টি ট্রেন চলে এলে সংঘর্ষ এড়াতে দু’টি ট্রেনই স্বয়ংক্রিয়ভাবে দাঁড়িয়ে যাবে। দেশের দক্ষিণ-মধ্য রেলের ১,০৯৮ কিলোমিটার পথে, ৬৫টি ট্রেনে ‘কবচ’ চালু। এদিকে, ভারতীয় রেলের নেটওয়ার্ক ৬৪ হাজার কিমির। মানে, ‘কবচ’ ব্যবস্থা এত দিনে দুই শতাংশ লাইনেও চালু করা যায়নি। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
দৃশ্যটা ঠিক একইরকমের। এক বছর আগে ওড়িশার বাহানাগা বাজার স্টেশনেও ঠিক একইরকমভাবে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনকে মালগাড়ির ঘাড়ের উপর উঠে পড়তে দেখা গিয়েছিল। সেটাও ছিল জুন মাসের ভ্যাপসা গরমের একটা দিন। সোমবার উত্তরবঙ্গের রাঙাপানি স্টেশনের কাছে ঠিক ওইভাবেই শিয়ালদহগামী ডাউন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের উপর উঠে গেল মালগাড়ির ইঞ্জিন। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের জন্য বাহানাগা বাজার স্টেশনের মেন লাইনের সিগনাল ছিল সবুজ। কিন্তু ‘পয়েন্ট’ ও ‘সিগনাল’-এর মধ্যে কোনও সমন্বয় ছিল না। পয়েন্ট দুরন্ত গতিতে থাকা করমণ্ডলকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল লুপ লাইনে। যেখানে দাঁড়িয়েছিল লৌহ আকরিক বোঝাই মালগাড়ি।
কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই করমণ্ডল আছড়ে পড়েছিল মালগাড়ির উপর। গোটা দেশ সাক্ষী থেকেছিল মৃত্যুর নিরিখে দেশের অন্যতম বড় রেল দুর্ঘটনার। রাঙাপানিতে কাঞ্চনজঙ্ঘার দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও সেই সিগনাল বিভ্রাট-ই সামনে এসেছে। মালগাড়ির জন্য সিগনাল সবুজ ছিল কি না, তা স্পষ্ট নয়। বলা হচ্ছে, স্বয়ংক্রিয় সিগনাল ব্যবস্থা বিকল ছিল। কাগুজে সিগনাল নিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা চলছিল। মালগাড়ির দুই চালককে কি তাহলে কাগজের মেমোতে সিগনাল দেওয়া হয়নি? না কি কাগুজে সিগনাল পেয়েও তঁারা বুঝতে ভুল করেছিলেন?
[আরও পড়ুন; কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনার দায় কার? মালগাড়ির মৃত চালকের বিরুদ্ধেই FIR]
যখনই একটা রেল দুর্ঘটনা ঘটে যায়, তখনই রেলের তরফে দায় চাপানোর জন্য চুনোপুঁটিদের খোঁজা হয়। ঠিক একবছর আগে বাহানাগা বাজার স্টেশনের দুর্ঘটনার জন্য সিবিআই খুঁজে নিয়েছিল ওই স্টেশনের তিনজন সিগনাল কর্মীকে। যঁাদের গ্রেফতারও করা হয়। কাঞ্চনজঙ্ঘার দুর্ঘটনাতেও দেখা যাচ্ছে রেলের তরফে সাত তাড়াতাড়ি দায় চাপানো হয়েছে মালগাড়ির দুই মৃত চালকের উপর। ওই দুই চালকের ভুলেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে বলে প্রাথমিক নিদান দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে– দেশের ৫৭ শতাংশ রেল দুর্ঘটনাই নাকি কর্মীদের গাফিলতিতে ঘটে। কিন্তু প্রতিটি দুর্ঘটনার পরই রেলের নিরাপত্তা, আধুনিকীকরণ ও পরিকাঠামো নিয়ে যে প্রশ্নগুলি, ওঠে তা নিরুত্তর থেকে যায়।
২০২৩ সালের ২ জুন সন্ধ্যায় করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় পড়ার পর যে-প্রশ্নটি উঠেছিল, ২০২৪-এর ১৭ জুন সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় পড়ার পর ঠিক একই প্রশ্ন ওঠে। প্রশ্নটি হল, রেলের ‘কবচ’ কোথায়? দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য রেলের ‘অ্যান্টি কলিশন ডিভাইস’ (কবচ) লাগানোর সিদ্ধান্ত হয় সেই মমতা বন্দে্যাপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকার সময়। ২০২২ সালে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘কবচ’ ব্যবস্থার উদ্বোধন করেন। মোদি এই ‘কবচ’ চালু করার পর রেলের তরফে এমন প্রচার করা হয়েছিল, মনে হয়েছিল যেন ভারতীয় রেলে দুর্ঘটনার বিষয়টি এবার ইতিহাসের পাতায় চলে গেল। কিন্তু করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনায় যখন ২৯৬টি প্রাণ চলে গেল, তখন জানা গেল যে, এই ‘কবচ’ ব্যবস্থা দেশের দক্ষিণ-মধ্য রেলের মাত্র ১,০৯৮ কিলোমিটার পথে এবং ৬৫টি ট্রেনে চালু হয়েছে। ভারতীয় রেলের নেটওয়ার্ক ৬৪ হাজার কিলোমিটারের। অর্থাৎ ‘কবচ’ ব্যবস্থা এত দিনে দুই শতাংশ লাইনেও চালু করা যায়নি। ‘কবচ’ ব্যবস্থা থাকলে একই লাইনে দু’টি ট্রেন চলে এলে সংঘর্ষ এড়াতে দু’টি ট্রেনই স্বয়ংক্রিয়ভাবে দঁাড়িয়ে যাবে।
উত্তরবঙ্গের রাঙাপানিতে একই লাইনে চলে এল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ও মালগাড়ি। মালগাড়িটি সপাটে গিয়ে ধাক্কা মারল কাঞ্চনজঙ্ঘার পিছনে। কাঞ্চনজঙ্ঘার শেষ দু’টি বগি পার্সেল ভ্যান ছিল। তাই দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা তুলনায় কম। কিন্তু অনিবার্যভাবে প্রশ্ন উঠল, কোথায় কবচ? গুয়াহাটি থেকে দিল্লি পর্যন্ত বিস্তৃত এই লাইনে যে ভারতীয় রেল এখনও ‘কবচ’ ব্যবস্থা চালু করতে পারেনি, তা বলা বাহুল্য।
[আরও পড়ুন: দুর্গাপুরে ডাক-কর্মীকে মাঝরাস্তা থেকে অপরহণের চেষ্টা! কাঠগড়ায় যোগীরাজ্যের পুলিশ]
করমণ্ডল দুর্ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছিল, রেল যখন ‘কবচ’ চালু করে যাত্রীদের নিরাপত্তা নূ্যনতম ব্যবস্থাটি করতে পারছে না, তখন কেন প্রতি সপ্তাহে দেশে দু’টি করে ‘বন্দে ভারত’ চালু করা হচ্ছে? একেকটা ‘বন্দে ভারত’ ট্রেন তৈরির খরচ ১৫০ কোটি টাকা। যাত্রী নিরাপত্তায় অর্থ বরাদ্দ না-করে কেন বন্দে ভারতের মতো ট্রেন চালু করে বিজ্ঞাপনী চমক সৃষ্টি করা হচ্ছে, সেই প্রশ্নর উত্তর আজও দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি রেল কর্তৃপক্ষ। সদ্য লোকসভা ভোটের প্রচারে দেখা গিয়েছে বন্দে ভারতের উপযোগিতা। বন্দে ভারতের ছবি দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নী ভাবমূর্তি গড়ে তোলার প্রয়াস চালানো হয়েছে বিজেপির তরফে। কেন দ্রুত সমগ্র ভারতীয় রেলে ‘কবচ’ ব্যবস্থা চালু হয়নি, তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সবসময় আর্থিক দুরাবস্থার কথা তোলা হয় রেলের তরফে।
করমণ্ডল দুর্ঘটনার পর জানা গিয়েছিল, গোটা দেশে ‘কবচ’ চালু করতে রেলের প্রয়োজন ৩২ হাজার কোটি টাকা। কারণ, প্রতি কিলোমিটার রেলপথে ‘কবচ’ লাগাতে নাকি ৫০ লক্ষ টাকা প্রয়োজন। রেলে প্রতিদিন অন্তত ২৫ লক্ষ মানুষ যাতায়াত করে। তাদের জীবন সুরক্ষিত রাখতে কি ৩২ হাজার কোটি টাকা খুব বড় অঙ্ক? সেন্ট্রাল ভিস্তা তৈরি করতে কেন্দ্রীয় সরকার ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে। আহমেদাবাদ থেকে মুম্বই পর্যন্ত বুলেট ট্রেন চালু করতে সম্ভবত আরও বেশি খরচ হবে। তাহলে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কেন রেলের পরিকাঠামো ও নিরাপত্তার উন্নতিতে প্রয়োজনীয় টাকা খরচ হবে না? কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনাতেও সিগনালিং ব্যবস্থার ত্রুটির বিষয়টি সামনে আসছে। সিগনালিং ব্যবস্থা নিশ্ছিদ্র করতে কেন অগ্রাধিকার দেওয়া হবে না? বাহানাগা বাজার স্টেশনের দুর্ঘটনার পরই প্রশ্ন উঠেছিল, শুধু বন্দে ভারত ও বুলেট ট্রেন চালানোর পিছনে হাজার-হাজার কোটি টাকা খরচ করে রেলের চাকচিক্য বাড়ানোয় গুরুত্ব দেওয়া হবে, না কি সাধারণ যাত্রীদের সুরক্ষা ও পরিষেবা গুরুত্ব পাবে?
[আরও পড়ুন: খাবার নেই, জলও শেষ! বীরভূমের ২৮ পড়ুয়া আটকে ধস কবলিত সিকিমে]
কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আক্ষেপ করে বলেছেন, রেল অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। করমণ্ডল দুর্ঘটনার পরও একই ধরনের আক্ষেপ ও ক্ষোভ তঁার মুখে ঝরে পড়েছিল। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তথ্য দিয়ে দেখানো হয়েছে ২০১৪ সালে মোদি সরকার আসার পর থেকে দেশে কতগুলি বড় বড় ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ-কথা অস্বীকারের কোনও জায়গাই নেই যে, আক্ষরিক অর্থেই ভারতীয় রেল যেন কয়েক বছরে অভিভাবকহীন হয়ে গিয়েছে। মোদি আমলের রেলের আলাদা বাজেট করার প্রথা উঠে গিয়েছে। রেলে নিয়োগ প্রায় শূন্যে ঠেকেছে। ৩ লক্ষের উপর রেলকর্মীর পদ শূন্য। রেলের উন্নত পরিষেবা ও নিরাপত্তার জন্য যে-কর্মীরা ভরসা ছিলেন, তাঁরা এখন নেই। অথচ, সাধারণ ভারতবাসীর রেলের উপর নির্ভরতা কমেনি। এখনও কোনও লাইনে রেলের টিকিট সুলভ নয়। প্রতিদিন লক্ষ-লক্ষ যাত্রী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাত্রা করে চলেছেন।
‘কবচ’-সুরক্ষার বাইরে থাকা যাত্রীদের কি এই বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে, তাঁরা যেন দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে ভবিতব্য ধরে নিয়েই চলাফেরা করেন?