২০২৪ সালের ‘স্ট্যাটিস্টা রিপোর্ট’ অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী পডকাস্ট শ্রোতার সংখ্যা ৪৬৪ মিলিয়ন। ভারতে এই সংখ্যা বেড়ে দঁাড়িয়েছে প্রায় ১০৫ মিলিয়ন– যার মধ্যে বয়সভিত্তিক পরিসংখ্যান হিসাবে, ৪৮% শ্রোতা তরুণ প্রজন্মের। সমীক্ষা আরও বলছে, এখনকার প্রজন্মের মনোযোগের গড় সময়সীমা মাত্র ৮.২৫ সেকেন্ড। শ্রবণভিত্তিক সাহিত্যগ্রহণ কি বই পড়ার প্রকৃত ‘বিকল্প’ হয়ে উঠবে? লিখছেন অগ্রদীপ দত্ত।
একটা সময় ছিল, বই হাতে না-নিয়ে, সাহিত্যচর্চা কল্পনাও করা যেত না। পাঠকের সবচেয়ে কাছের সঙ্গী ছিল ছাপা অক্ষর। কিন্তু সময় বদলেছে। বদলে যাচ্ছে সেই পাঠ-অভ্যাস। এখন তরুণ প্রজন্ম বইয়ের পাতার চেয়ে বেশি নির্ভর করছে কানে ভেসে আসা কণ্ঠস্বরের উপর। অডিও স্টোরি, পডকাস্ট, ভয়েস ড্রামা– এই নতুন ফরম্যাটে সাহিত্যের রমরমা ইঙ্গিত করছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা, পড়ার চেয়েও শোনাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে তারা। ২০২৪ সালের ‘স্ট্যাটিস্টা রিপোর্ট: কনজিমমার ট্রেন্ডস’ অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী পডকাস্ট শ্রোতার সংখ্যা ৪৬৪ মিলিয়নে পৌঁছেছে এবং ভারতে এই সংখ্যা বেড়ে দঁাড়িয়েছে প্রায় ১০৫ মিলিয়ন– যার মধ্যে বয়সভিত্তিক পরিসংখ্যান হিসাবে, ৪৮% শ্রোতা হল ১২ থেকে ৩৪ বছর বয়সি অর্থাৎ তরুণ প্রজন্মের।
এই পরিবর্তনের পিছনে অবশ্য রয়েছে প্রযুক্তির অপরিহার্য অবদান। নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে মোবাইল অ্যাপ, ডিজিটাল কনটেন্ট, অ্যালগরিদ্ম-পরিচালিত জগতে। বই পড়ার জন্য যে নির্জনতা, ধৈর্য, মনঃসংযোগের অবকাশ প্রয়োজন, তা তারা পাচ্ছে কতটুকু? গ্লোবালাইজেশনের তীব্র প্রতিযোগিতা, তথ্যের অতিবন্যা ও সময়ের সীমাবদ্ধতা তাদের ঠেলে দিয়েছে মাল্টিটাস্কিং সংস্কৃতিতে। এমন অবস্থায় অডিও মাধ্যমের চেয়ে ভাল বিকল্প আর কী হতে পারে?
অডিও কনটেন্টের একটি বড় বৈশিষ্ট্য, সহজ গ্রহণযোগ্যতা। অন্য কাজ করতে করতেও শোনা যায়– রান্না করা, হঁাটাহঁাটি, জিমে শরীরচর্চা, বা অফিস যাতায়াতের সময়ও এখন অনেকেই গল্প শোনেন, পডকাস্ট শোনেন। ‘অডিও কনটেন্ট’ যেন হয়ে উঠছে এক বহনযোগ্য সাহচর্য, যা সময় ও পরিসরের সীমানা ছাড়িয়ে লেখার বিষয়বস্তু পৌঁছে দিচ্ছে নিত্যদিনের জীবনে।
এই শ্রবণভিত্তিক অভ্যাসের নেরথ্যে আরও কয়েকটি বিশেষ কারণ রয়েছে। প্রথমত, মানুষের ‘অ্যাটেনশন স্প্যান’ বা ‘মনোযোগের স্থায়িত্ব’ ক্রমশ কমছে। একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, এখনকার প্রজন্মের মনোযোগের গড় সময়সীমা নেমে এসেছে মাত্র ৮.২৫ সেকেন্ডে– যা একটি গোল্ডফিশের অ্যাটেনশন স্প্যানের চেয়েও কম। এই ‘রিল সংস্কৃতি’-তে অভ্যস্ত প্রজন্ম বইয়ের দীর্ঘ বিন্যাসে ধৈর্য হারায়, অথচ অডিও ফরম্যাটে সে কিছুটা সহজেই তা গ্রহণ করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, শোনা আর পড়ার মনঃসংযোগের মধ্যে একটা মৌলিক ফারাক আছে। পাঠকের পাঠে একাগ্রতা জরুরি। সেখানে শ্রোতা অনেক বেশি ‘প্যাসিভ’ ভোক্তা– গল্প নিজে এসে ঢুকে পড়ে কানে, চিন্তার দরজায় সেরকম ধাক্কা না দিয়েই। ফলে যারা পড়তে চায়, কিন্তু সময়, অবসর বা অভ্যাসে টানাপোড়েন রয়েছে, তাদের কাছে অডিও স্টোরি, পডকাস্ট এক উপযুক্ত সমাধান।
এই পরিবর্তন শুধু শ্রোতার নয়, লেখকের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। ইউটিউব ও অন্যান্য ডিজিটাল মাধ্যম লেখকদের জন্য খুলে দিয়েছে এক নতুন দিগন্ত। যেখানে মুদ্রিত পত্রিকার বাজারে মুনাফা অনিশ্চিত, লিখে সাম্মানিক প্রায় জোটে না বললেই চলে– সেখানে অডিও কনটেন্টে রয়েছে রোজগারের নানাবিধ সুযোগ। ফলে অজস্র তরুণ লেখক হালে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে গল্প বলছেন, পডকাস্ট করছেন, ভয়েসওভার শিখে উপার্জনের নতুন দরজা খুলছেন।
শুধু কল্পকাহিনি নয়, অডিও মাধ্যম নন-ফিকশন সাহিত্যের ক্ষেত্রেও জায়গা তৈরি করছে। ‘কুকু এফএম’ বা অডিব্ল-এর মতো প্ল্যাটফর্মে জীবনী, প্রবন্ধ, মনস্তত্ত্ব বা আত্ম-উন্নয়নমূলক বিষয়ক অডিও বইয়ের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। ২০২৪ সালে ‘অডিব্ল ইন্ডিয়া’-তে সবচেয়ে বেশি শোনা অডিওবুকের তালিকায় রয়েছে ‘দ্য সাইকোলজি অফ মানি’, ‘ইকিগাই’, ‘অ্যাটোমিক হ্যাবিটস’-এর মতো বই। বাংলা ভাষায় এখনও এই অংশটি অপ্রতুল, অথচ প্রয়োজনীয়। কারণ জ্ঞানমূলক বিষয় যদি শ্রুতির মাধ্যমে উপভোগ করা যায়, তবে শিক্ষার পরিধিও বেড়ে যায় বহুগুণে।
বাংলা ইউটিউব অডিও জগতের বিষয়বৈচিত্রে একরকম সংকোচ লক্ষ করা যাচ্ছে বলা যেতে পারে। অডিও স্টোরিতে প্রধানত সাসপেন্স, থ্রিলার, হর্র ঘরানার লেখা-ই সবচেয়ে জনপ্রিয়। এই প্রবণতা নতুন নয়, তবে এখন আরও বেশি দৃশ্যমান। এবং বহু ক্ষেত্রেই গল্পে মাত্রাধিক ভায়োলেন্স ঢুকে পড়ছে শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে। অতিরঞ্জিত উপাদানের ভারসাম্য না থাকলে বিষয়বস্তুর সৌন্দর্য ক্ষুণ্ণ হয়। এসব ঘরানার লেখার পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিক গল্প, উপন্যাস বা অন্যান্য বিষয়– যেমন, ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজবিজ্ঞানের মতো বিষয়ে অডিওবুক তৈরি হওয়াও সমানভাবে জরুরি। বাংলার লোকসংস্কৃতি, লোককথা, আঞ্চলিক শিল্প ও শিল্পীর কথা ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ে অডিও লেকচার সিরিজ করা যেতেই পারে।
এই প্রেক্ষাপটে আরও এক প্রশ্ন উঠে আসে– তাহলে কি বই পড়ার দিন শেষ হয়ে এল? না, একেবারেই তা নয়। বরং বলা যায়, সাহিত্যের ‘মাধ্যম’ বদলাচ্ছে। বহু অডিও প্ল্যাটফর্মেই দেখা যাচ্ছে, গল্প শুনে পাঠক বইয়ের মুদ্রিত সংস্করণ কিনছেন। আবার, অনেক লেখক অডিও মাধ্যমের জন্যই গল্প লিখছেন–যেখানে ভাষাপ্রয়োগ বা অলংকারের ব্যবহার প্রধান নয় বরং সংলাপ, গতিশীলতা, নাটকীয়তা, কাহিনি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
তবে এ নিয়ে মেনস্ট্রিম সাহিত্যিক বলয়ে একটা অস্বস্তিও লক্ষ করা যায়। কারণ এখানকার অনেকেই এখনও মনে করেন, সাহিত্য মানেই ছাপা অক্ষরের শিল্প। অথচ বৈদিক সাহিত্য থেকে শুরু করে লোককথা, পালাগান, কীর্তন—সাহিত্যের এক বড় অংশই তো শ্রুতিশিল্প! কালের চাকা ঘুরে, সাহিত্য আজ যেন নিজের আদিম রূপেই ফিরে এসেছে– আধুনিক প্রযুক্তির হাত ধরে। শ্রবণের মাধ্যমে সাহিত্য গ্রহণ করলেই তা অর্থহীন– এই সরলীকরণ বিপজ্জনক। মাধ্যম বদলালেও সাহিত্য যদি তার মৌলিক মাপকাঠি– ভাব, মান, অভিঘাত অক্ষুণ্ণ রাখে, তবে সেটাই গ্রহণযোগ্য সাহিত্য।
অডিও কনটেন্টের উপযোগিতাবাদের কথা যেমন বললাম, এর সীমাবদ্ধতাও বলি এবার। প্রশ্ন হল– শুধু শ্রবণভিত্তিক সাহিত্যগ্রহণ কি বই পড়ার প্রকৃত বিকল্প হতে পারে? মনে হয় না। কারণ বই পড়া মানে কেবল তথ্য বা কাহিনি জানা নয়, বরং পাঠকের কল্পনাশক্তির নিজস্ব বিস্তার। লেখকের ভাবনা, ভাষা, উপমা, বর্ণনায় যে অপরিসীম ব্যাপ্তি থাকে, পাঠক তা নিজের অনুভব, কল্পনা দিয়ে স্পর্শ করতে পারে। কিন্তু অডিও কনটেন্টে শ্রোতা অনেকটাই নির্দিষ্ট ছঁাচে আবদ্ধ– যেখানে আবহ, গলার স্বর, মিউজিক, সবকিছু মিলে লেখার ব্যাখ্যা অনেকখানি আগেই তৈরি করে দেয়।
ফলে শ্রোতার কল্পনা ব্যবহার করার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। সবশেষে, যঁারা মনে করেন, এখনকার প্রজন্ম সাহিত্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তঁারা আসলে মাধ্যম পরিবর্তনকে ভুলভাবে সাহিত্যচ্যুতি ভেবে বসেছেন। পাঠের অভ্যাস বদলেছে, গ্রহণের রূপ বদলেছে, তবে সাহিত্যের প্রয়োজন শেষ হয়নি। নতুন প্রজন্ম বই কম পড়ছে ঠিকই, কিন্তু তারা বইয়ের ভাবনা গ্রহণ করছে নতুন আঙ্গিকে। প্রতিটি যুগ নিজের ভাষা খোঁজে, নিজের ছন্দ তৈরি করে। এখনকার অডিও প্রজন্ম সেই সন্ধানেই আছে। তাই শ্রবণ ও পাঠ– এই দুই মাধ্যমের মধ্যে বিভেদ নয়, প্রয়োজন সমন্বয়ের। একটি যেন অন্যটির প্রতিদ্বন্দ্বী না-হয়ে পরিপূরক হয়ে উঠতে পারে, লক্ষ্য সেটাই হওয়া উচিত।
তথ্যসূত্র
১. স্ট্যাটিস্টা রিপোর্ট (২০২৪)।
বিশ্বব্যাপী পডকাস্ট শ্রোতার সংখ্যা ও বয়সভিত্তিক পরিসংখ্যান
২. ‘অডিব্ল ইন্ডিয়া’ (২০২৪)।
সর্বাধিক শোনা অডিওবুকের তালিকা ও রিপোর্ট
৩. জে. স্মিথ (২০২৩)। ডিজিটাল যুগে মনোযোগের স্থায়িত্ব: স্নায়ুবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি। জার্নাল অফ কগনিটিভ স্টাডিজ।
৪. ইউটিউব অ্যানালিটিক্স রিপোর্ট (২০২৪)
৫. গ্লোবাল ওয়েব ইনডেক্স (২০২৪)
(মতামত নিজস্ব)