নির্মল ধর: কলকাতা শহরের অন্যতম আকর্ষণ, পরাধীন দেশের এক জাতীয় হেরিটেজ লালদিঘির পারের রাইটার্স বিল্ডিং, যার অন্য নাম মহাকরণ এখন অনেকের কাছেই হয়তো শুধুই স্মৃতি! নবান্ন এখন অনেক বেশি কর্মমুখর। এই লালবাড়িই একসময় ইংরেজ শাসকদের মূল ডেরা ছিল। এখান থেকেই চলত সরার দেশের শাসন।
দশ/বারো বছর আগে পর্যন্ত মহাকরণ ছিল রাজ্য রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। এখানেই গত শতকের তিরিশ সালে তিন অসমসাহসী বঙ্গ তরুণ জীবনপণ করে ইংরেজ সৈনিক ও শাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই চালিয়েছিলেন প্রায় চল্লিশ মিনিট নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে। বেশ কিছু ব্রিটিশ সৈনিকের মৃত্যু ঘটেছিল। সিম্পসন এবং ফোর্ড নামের দুই ইংরেজকে নিকেশ করতে গিয়ে বন্দে মাতরম ধ্বনিতে শুধু ওই লালবাড়িকে কাঁপিয়ে তোলেননি, রীতিমতো এক ইতিহাস তৈরি করেছিলেন বিনয়-বাদল-দীনেশ (Benoy-Badal-Dinesh) নামের তিন তরুণ বিপ্লবী।
আজও সেই বিবাদীবাগ আমাদের ক’জনের কাছে পুরনো সেই দিনের কিছু স্মৃতি বয়ে আনে হয়তো, কিন্তু এই বৈদ্যুতীন তাড়িত যুব সমাজের ক’জন ‘বিবাদী’ শব্দটির পুরো অর্থ জানে? পরিচালক চিত্রনাট্যকার অরুণ রায়, গবেষক রুদ্ররূপ মুখোপাধ্যায়ের সাহায্য নিয়ে সেই বিস্মৃতপ্রায় বিপ্লবীদের আত্মত্যাগের কাহিনিকে অযথা নাটকীয় না করে অনেকাংশেই বাস্তব চেহারায় তুলে আনলেন তাঁর নতুন ম্যাগনাম অপাস ‘৮/১২’ ছবিতে (8/12 movie)।
[আরও পড়ুন: মসুর ডালে মেশানো সর্বনাশা পাউডার! ভেজাল কারবার চালানোয় ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করল EB]
নেতাজিকে নিয়ে গাল-গল্প ভিত্তিক কোনো কাল্পনিক রচনা নয়, কিংবা কোনও দেশপ্রেমিককে নিয়ে সাংকেতিক শব্দের ধাঁধা খোঁজার ‘গঞ্জিকা সেবনের গপ্পো’ও নয় এই ছবি। বিদেশি অত্যাচারী শাসকদের সঙ্গে রক্তাক্ত সংঘর্ষে জীবন পণ করে দেশকে স্বাধীন করার মন্ত্র নিয়ে যাঁরা ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগানকে মাতৃমন্ত্র করেছিলেন, তাঁদের জীবনের সেই বীরগাথাকেই অবলম্বন করেই ইতিহাসের বিস্মৃত পাতাকে জীবন্ত করে তুলে এনেছেন।
ছবি দেখতে বসে দর্শকের বার বার মনে হতেই পারে, যে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছিলাম কয়েক হাজার শহিদের আত্মদানের মূল্যে, আজ সেই স্বাধীন দেশের নাগরিক ও নেতাদের কী আত্মস্বার্থের খেলা দেখি। যাই হোক, এটাই হয়তো রক্তহীন বিপ্লব ছাড়া স্বাধীনতা প্রাপ্তির ফল! ছবির শুরু চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের ঘটনার ঠিক পরেই। মাস্টারদা সূর্য সেন (Surya Sen) পলাতক, অনন্ত সিং ধরা দিয়েছেন।
কলকাতায় টেগার্ট এবং ঢাকায় লওম্যান নামের দুই ব্রিটিশ অফিসার আতঙ্ক সৃষ্টি করে চলেছেন। কমলা নামের এক তরুণীকে নারকীয় পাশবিক অত্যাচারে উন্মাদিনী করে দেওয়া হয়েছে। এই সময়েই বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স দলের হেমচন্দ্র ঘোষ(শাশ্বত), রসময়(শংকর দেবনাথ) এবং স্বয়ং নেতাজির নেতৃত্বে দুই অফিসার সিম্পসন এবং ফোর্ডকে হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয় তিন তরুণ ছাত্র বিনয় (Benoy Basu), বাদল (Badal Gupta) ও দীনেশের (Dinesh Gupta) ওপর।
ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দেশের কাজে বিনয় আগে থেকেই নিয়োজিত। লওম্যানকে একাই হত্যা করেছে বিনয়। এবার মেজর গুপ্তর ট্রেনিংয়ে নিয়ে তিন মূর্তির রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান। চল্লিশ মিনিটের সশস্ত্র লড়াইকে পরিচালক অরুণ রায় অত্যন্ত সংযত ভঙ্গিতে, সুন্দর কোরিওগ্রাফির মাধ্যমে মাত্র ১২/১৩ মিনিটে যেভাবে উপস্থিত করেছেন, তেমনটি এর আগে বাংলা ছবিতে সম্ভবত দেখা যায়নি।
সুস্নাতার ক্যামেরার মুভমেন্ট, পুরনো কলকাতাকে দেখানোর জন্য চিটশটগুলির দেখার মতো। সৌম্যঋতের আবহ এবং দু’টি গান “বারুদ ভরা স্বপ্ন বুকে…” আর “উদয়ের পথে শুনি কর বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই…” কবিতার শুধু অস্পষ্ট উচ্চারণই যেন এই ছবির প্রাণভোমরা হয়ে থাকে।
আর শিল্পীদের অভিনয়! হ্যাঁ, বিনয়ের চরিত্রে কিঞ্জল নন্দ স্বল্প সুযোগে তাঁর নিজস্বতার ছাপ রেখেছেন। অর্ণ মুখোপাধ্যায় হয়েছেন বাদল। অ্যাকশন দৃশ্যে তিনি বেশ জমাটি। আবার দীনেশের সঙ্গে ঘরোয়া আড্ডায় খুবই স্বাভাবিক। দীনেশের ভূমিকায় নতুন মুখ সুমন বসু নজর কাড়েন। আর রয়েছেন শারীরিক মানসিক নির্যাতিতা কমলার চরিত্রে নাটকের পরিচিত মুখ গুলশান আরা। তাঁর যন্ত্রণাকাতর উন্মাদিনীর অভিনয় মনে থাকবে অনেকদিন।
আসলে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নিয়ে ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন’, ‘ভুলি নাই’ বা ‘বুড়ি বালামের তীরে’ ধরনের ছবির পাশে এই ‘৮/১২ বিনয় বাদল দীনেশ’ নির্মাণের পরিপাট্যে অনেকটাই আধুনিক ও আগ্রহ উদ্রেককারী। সেজন্য পরিচালক অরুণ রায়কেই ধন্যবাদ জানাতে হয়। দেশপ্রেম নিয়ে ব্যবসায়িক মনোভাবের পরিবর্তে তিনি বিষয়টির প্রতি আন্তরিক থেকেছেন – এটাই দর্শকের প্রাপ্তি। আগের দু-তিনটি ছবিতেও তাঁর এমন সাগ্রহী আন্তরিকতার পরিচয় পেয়েছিলাম। তিনি এখনও বেপথু হননি – এটাই আশার!
ছবি – ৮/১২ বিনয় বাদল দীনেশ
অভিনয়ে – শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, কিঞ্জল নন্দ, অর্ণ মুখোপাধ্যায়, সুমন বসু, খরাজ মুখোপাধ্যায়
পরিচালনা – অরুণ রায়