নির্মল ধর: এবার অন্তত রাজনৈতিক নেতা ও সাংসদ দেবকে ছাপিয়ে গেলেন নায়ক এবং একজন মানুষ দেব। তাঁর এবং অতনু রায়চৌধুরীর প্রযোজনায় ফিরে এলো চলমান জীবনের কিছু বাস্তব সত্য। হোক না সেটা সফল ব্যবসায়িক চেহারায়! এটুকুইবা এতদিন টালিগঞ্জের কজন করার সাহস দেখিয়েছেন? অভিজিৎ সেনের পরিচালনায় ও শুভদীপ বসুর চিত্রনাট্যে কাল্পনিক এক গ্রাম ধর্মপুরের প্রেক্ষাপটে গল্প। আজকের গ্রাম পঞ্চায়েতের দুর্নীতি, পুলিশ-নেতার কারসাজিতে নীতিহীনতার যে স্বার্থান্বেষী এক প্রশাসন চলছে, সেটাই খুব স্পষ্ট করে দেখানো হয়েছে ‘প্রধান’ ছবিতে।
ধর্মপুর গ্রামে আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার দায়িত্ব নিয়ে থানার প্রধান হিসেবে যোগ দেয় সদ্যবিবাহিত তরুণ পুলিশ অফিসার দীপক প্রধান। গ্রামে প্রবেশ করেই দীপক বুঝিয়ে দেন যে ‘পুলিশের শিরদাঁড়া সোজা রেখে কাজ করাটাই চাকরির নিয়ম, লোভ বা নেতার কাছে মাথা নোয়ানো নয়!’ পুরো ছবি জুড়ে দীপক প্রধান সেই কাজটাই করে চলেন! ঘুষখোর দুই সহকর্মী সোহম চক্রবর্তী এবং নীল মুখোপাধ্যায়কে দেবের ‘ভোকাল টনিক’ বদলে দেয়! একদা গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান জটিলেশ্বরের সাজানো আর্থিক কেলেঙ্কারির মিথ্যে অভিযোগে সৎ হেডমাস্টার জীবনকৃষ্ণ চাকরি হারান। তাঁকেও পুলিশ প্রধান দীপক সত্য ঘটনা উন্মোচন করে সসম্মানে তাঁর নিজের বাড়িতে তৈরি স্কুলশিক্ষকের চাকরি দেয়। এককথায় ধর্মপুর গ্রামের ‘মসিহা’ হয়ে ওঠেন পুলিশ প্রধান। শেষপর্যন্ত এই ‘মসিহা’র নেতৃত্বেই নতুন নির্বাচনে জয়ী হয় সত্য, সততা। জয় ঘটে জীবনের। খলনায়ক পঞ্চায়েত প্রধান নির্বাচনে হেরে যান। আর সবটাই ঘটে দীপক প্রধানের নেতৃত্বে। প্রয়োজনে তিনি লাঠি উঁচিয়ে যেমন দুষ্টের দমন করেন, তেমনি শিষ্টের পালনেও সক্রিয় ভূমিকা নেন। স্বাভাবিক ভাবেই প্রায় শূন্য থেকে ধর্মপুরে উত্থান ঘটে জনদরদী পার্টির। যার নেতৃত্বে অম্বরীশ ভট্টাচার্য, খরাজ মুখোপাধ্য়ায়রা।
তবে যেটা বাড়তি মনে হয়েছে, সেটা হল- প্রবীণ দম্পতির একাকীত্বের যন্ত্রনা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিতে পরান বন্দ্যোপাধ্যায় ও মমতা শংকরকে কলকাতায় তাঁদের ছেলের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে উপস্থিত করার কোনও প্রয়োজন ছিল না এই গল্পে। নায়ক দেব ও পরিচালক অভিজিৎ সেনের জুটি সংসারিক মধ্যবিত্ত বাড়ির নাটকোচিত ঘটনায় বেশ মজাদার ফর্মুলার মাধ্যমে পর পর ‘হিট’ ছবি তৈরির সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়েই এমনটি করেছেন সম্ভবত! আবার এটাও বলতেই হচ্ছে, স্কুল শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি ও রাস্তা সারানোর অর্থ গায়েব করার সত্যকথনেও পিছপা হয়নি ‘প্রধান’। এখানেই ‘মানুষ’ দেব এগিয়ে রয়েছেন ‘রাজনীতিক’ দেবের থেকে। হয়তো, এটা তাঁর নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তবে, তিনি যখন ছবির নায়ক এবং অন্যতম প্রযোজক, তখন চিত্রনাট্যে তাঁর চরিত্রের প্রাধান্য থাকবেই, এটা যেমন স্বতঃসিদ্ধ, তেমনই দর্শকের দিক থেকে ভাবলে প্রতিটি চরিত্রের সমান প্রাধান্য পাওয়া উচিত এটাকেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ‘প্রধান’-এর চিত্রনাট্য সেই ধর্মটি এড়িয়ে গিয়েছে! তা যাইহোক, বাণিজ্যিক ফরম্যাটে তৈরি ‘প্রধান’ দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য। ‘প্রধান’ মশলায় ভরপুর। প্রেম নয়, অ্যাকশনও নয়, এই ছবির জনপ্রিয়তার চাবিকাঠি রয়েছে বিষয়বস্তুতে, উপস্থাপনে, ঘটনার বিন্যাসে।
[আরও পড়ুন: ছবি বিশ্বাসকে কি টেক্কা দিতে পারলেন ‘কাবুলিওয়ালা’ মিঠুন? পড়ুন রিভিউ]
আর শিল্পীদের অভিনয়! সেখানেও সিংহভাগ দেবের দখলে। তিনিই ছবির প্রধান মুখ। হ্যাঁ, সাম্প্রতিক অতীতেও দেবের অভিনয় প্রশংসিত হয়েছে। অভিনয়ের দক্ষতা অর্জন করেছেন। এখানেও সেটা দেখা গেলো। অ্যাকশনের চাইতেও সংলাপের শক্তি তাঁকে অভিনয়ে পোক্ত করেছে- এটা মানতেই হবে। পাশে দাঁড়িয়ে সোহম ও নীল তাঁকে সাহায্য করেছেন। পরান বন্দ্যোপাধ্যায় এমন চরিত্রে চিরদিনই ভালো অভিনয় করে থাকেন। মমতা শংকর তেমন সুযোগ পাননি চিত্রনাট্যে। একই কথা স্ত্রী সৌমিতৃষার চরিত্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দেবময় ‘প্রধান’ এবার দেখা যাক দর্শকের কাছে কতটা ‘প্রধান’ হয়ে ওঠে?