সন্দীপ্তা ভঞ্জ: আইনি বিতর্ক, সমালোচনা সঙ্গী করে শুক্রবার মুক্তি পেল আদিত্য ধর পরিচালিত 'ধুরন্ধর'। গুপ্তচরের ভূমিকায় রণবীর সিং। পঁচিশ সালের বক্স অফিস নম্বরের নীরিখে ওপেনিং ইনিংসে ছক্কা হাঁকিয়েছে ঠিকই, কিন্তু দেশপ্রেম, অ্যাকশন, রোম্যান্সের উপকরণে ৩ ঘণ্টা ৩৪ মিনিটের এই স্পাই থ্রিলার কতটা জমল? পড়ুন রিভিউ।
সিনেমার গল্প চিরাচরিত মধ্যপ্রাচ্য, ভারত-পাকিস্তানের শত্রুতা। সন্ত্রাস। RAW, ISI গুপ্তচরদের কাহিনী পর্দায় কম দেখেননি দর্শকরা। তবুও স্পাই থ্রিলারের ভিড়ে ভিন্ন স্বাদ দিল 'ধুরন্ধর'। পাকিস্তানের ছোট্ট শহর লিয়ারি, সেখানকার অপরাধ জগতের এক আস্ত দলিল পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক আদিত্য। সিনেমাজুড়ে মারাকাটারি অ্যাকশন, রক্তারক্তি আর হিংসার কাহিনি। তাই সাড়ে তিন ঘণ্টার এই সিনেমা দেখার আগে দুর্বল চিত্তের দর্শকদের জন্য এই সতর্কীকরণ না দিলেই নয়! তবে মনে সাহস সঞ্চার করে যদি একবার হলমুখো হন তাহলে হতাশ হতে হবে না। কারণ পরিচালনা আর টানটান চিত্রনাট্যের যুগলবন্দির উদাহরণ এই ছবি। তুখড় অভিনয়ে ততোধিক নজর কাড়লেন অক্ষয় খান্না, রণবীর সিং এবং আর মাধবন। হাইভোল্টেজ অ্যাকশন, গুপ্তচরবৃত্তি করতে গিয়ে ভিনদেশি প্রেমিকার সঙ্গে বিয়ে-রোম্যান্স থেকে প্রতিশোধের আগুনে পোড়া ইস্পাতসম মনন, আদ্যোপান্ত কমার্শিয়াল ছবির যাবতীয় উপকরণ মজুত 'ধুরন্ধর'-এ। বাণিজ্যিক সিনেপ্রেমীদের কথা ধার করে বলতে হলে, 'পয়সা উসুল ধুন্ধুমার ধুরন্ধর!' সবথেকে বেশি নজর কাড়ল পরিচালক আদিত্য ধরের ডিটেলিং। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিক এবং নতুন সহস্রাব্দের গোড়ার দিকের কিছু ঘৃণ্য সন্ত্রাসের ঘটনাবলী পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ফ্রেমে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি।
'ধুরন্ধর'-এর দৃশ্যে রণবীর সিং (ছবি- সংগৃহীত)
১৯৯৯ সালের কান্দাহার বিমান হাইজ্যাকের ঘটনার প্রেক্ষাপট দিয়ে শুরু হয় 'ধুরন্ধর'-এর গল্প। সেসময়ই সিস্টেমে 'ঘুণে'র আভাস পান ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো প্রধান অজয় সান্যাল (মাধবন)। গল্প যত এগোয় পাকিস্তানের 'সন্ত্রাস লীলা'র মাত্রাও তত তীব্র হয়! তবে ২০০১ সালে পার্লামেন্ট হামলার ঘটনা যখন সিস্টেমে টোকা দেয়, তখনই ব্রহ্মাস্ত্র হিসেবে অবতরণ 'ধুরন্ধুর'-এর। ভায়া আফগানিস্তান হয়ে পরিচয় বদলে সে চলে যায় করাচিতে। সেখান থেকে গন্তব্য লিয়ারি। পাকিস্তানের অন্যতম প্রাচীন শহর যেখান থেকে ইসলামাবাদের সিংহাসনের উত্তরাধিকারের দৌড় শুরু হত। এই লিয়ারি একসময়ে বাবু ডাকাইত আর রহমান ডাকাইতের (রহমান ডাকাইত) দুই প্রতিদ্বন্দ্বী অপরাধ গোষ্ঠীর ভয়ে কাঁপত। আর সেই গোষ্ঠীগুলির মদতেই বহাল তবিয়তে সিংহাসনের তলায় ছড়ি ঘোরাত সন্ত্রাস গোষ্ঠীগুলি। কীভাবে 'অপারেশন' চলত? আদিত্যর 'ধুরন্ধর' ছবিতে সেই গল্পই ফুটে উঠেছে। এসবের সঙ্গে সমান্তরালে বালোচ বিরোধী পাক-রাজনীতির প্লটও জুড়ে দিয়েছেন পরিচালক।
অন্যদিকে পাকিস্তানের সন্ত্রাস গোষ্ঠীর ছক জানতে হামজা আলিকে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে ঢুকতে হয় রহমান ডাকাইতের দলে। সেখানে তার পরিচয় হয় আইএসআইয়ের মেজর ইকবালের (অর্জুন রামপাল) সঙ্গে। যে ভারতকে রক্তাক্ত করার ষড়যন্ত্র কষছিল পরোক্ষভাবে বালোচ গোষ্ঠীর মদত নিয়ে। বিশ্বাস অর্জন করে এদেরই সেতু হয়ে ওঠে হামজা। সেই সূত্রেই ২৬/১১-র মুম্বই হামলা নিয়ে সতর্ক করে দেশকে। তবে শেষরক্ষা হয়নি! এরপর প্রতিশোধস্পৃহ হামজা কী করে? সেই গল্প এই পরিসরে না ভাঙাই ভালো। পুরোটা জানতে হলে প্রেক্ষাগৃহে ঢুঁ মারতে হবে। তবে হামজার অপারেশন যে এখানেই শেষ নয়, সিনেমার শেষে দ্বিতীয় ভাগের ইঙ্গিত দিয়ে সেকথা জানিয়ে দিয়েছেন নির্মাতারা।
'ধুরন্ধর'-এর দৃশ্যে অর্জুন রামপাল, অক্ষয় খান্না (ছবি- সংগৃহীত)
এবার আসা যাক অভিনয়ের কথায়। বছরখানেক বাদে পর্দাজুড়ে রণবীর সিংয়ের একক পারফরম্যান্স দেখার সুযোগ পাবেন দর্শক। শেষবার 'পদ্মাবত'-এ খিলজির চরিত্রে এহেন অভিনয় দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন রণবীর। অতঃপর 'ধুরন্ধুর'-এ তাঁর অভিনয় দেখে বলাই যায়, 'রণবীর ইজ ব্যাক'! রহমান ডাকাইতের ভূমিকায় ততোধিক যোগ্য সারথির মতো সমান্তরালে গল্প টেনে নিয়ে গিয়েছেন অক্ষয় খান্না। এককথায় ব্রিলিয়ান্ট! অন্যদিকে মাধবন অভিনীত অজয় সান্যালের চরিত্র মনে করিয়ে দেয় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের কথা। স্বল্প পরিসরে আইএসআই মেজর ইকবালের ভূমিকায় 'রোমহর্ষক' অর্জুন রামপাল। কিছু দৃশ্যে গায়ে কাঁটা ধরালেন তিনি। চৌধরী আসলামের চরিত্রে যথাযথ সঞ্জয় দত্ত। তাঁর চরিত্র এই ছবির অন্যতম সারপ্রাইজ এলিমেন্ট! তবে হামজার মিশন বোঝাতে গিয়ে অযথা সিনেমার প্রথমার্ধের দৈর্ঘ্য বাড়িয়েছেন আদিত্য ধর। কিছু অংশ মোটেই মেদবর্জিত নয়, চাইলেই সেই দৃশ্যের দৈর্ঘ্য কমানো যেত, তবে বড়পর্দায় তারকাদের হাইভোল্টেজ সংলাপ, অ্যাকশন সিকোয়েন্স দেখতে মন্দ লাগে না। আক্ষেপ একটাই, দেশপ্রেমের গল্প দেখতে গিয়ে পাকিস্তানের লিয়ারির গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব দেখে বেরলাম মনে হল! অপেক্ষা এবার দ্বিতীয় ভাগের। শেষপাতে উল্লেখ্য, রণবীরের প্রত্যাবর্তন, অক্ষয় খান্নার যোগ্য সঙ্গত আর আদিত্য ধরের ডিটেইলিং 'ধুরন্ধর'-এর ইউএসপি।
