বিশ্বদীপ দে: এপ্রিল যে 'নিষ্ঠুরতম' মাস একথা আমাদের জানিয়েছিলেন টিএস এলিয়ট। কিন্তু 'দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড'-এর কবির জন্মেরও চার বছর আগে বাঙালির জীবনে এপ্রিল এমন এক অভিঘাত এনেছিল, যা আজও ছুরির তীক্ষ্ণ ফলা হয়ে গেঁথে আছে বঙ্গজীবনের সাংস্কৃতিক এক বেদনাবিধুর লোককথার গভীরে! ১৯ এপ্রিল তারিখটা ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবির নাম হিসেবে একটা অন্য মাত্রা পেয়েছে বটে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের 'নতুন বউঠান'-এর আত্মহত্যার দিনটা যে ওই তারিখেই তা হয়তো সব সময় খেয়াল থাকে না। তবু কখনও খেয়াল পড়লেই সেই 'নিষ্ঠুরতা'র জলছাপকে সম্যক উপলব্ধি করা যায় বইকি।
১৮৮৪ সাল থেকে ২০২৫। সময়ের হিসেবে প্রায় দেড়শো বছর হতে চলল। তবু রবীন্দ্র আলোচনায় বারবার উঠে আসে কাদম্বরীর মৃত্যুপ্রসঙ্গও। আর সঙ্গেই দু'জনের সম্পর্কের আলো-আঁধারি এবং তার সঙ্গে কাদম্বরীর জীবনের শেষপর্বের যোগসূত্র নিয়ে কাটাছেঁড়াও। যা নিয়ে বাঙালির এক আশ্চর্য অস্বস্তি রয়েছে। আবার কৌতূহলও। সেই চর্বিতচর্বণে আমরা এই লেখায় আর ঢুকব না। কেবল দেখব সেই ১৯ এপ্রিলের রাত এবং রবীন্দ্রনাথের জীবনে সেই কীভাবে একই সঙ্গে সেই ঘটনা শোক ও শোক থেকে শান্তি হয়ে উঠেছে ক্রমশ।
'মৃত্যুশোক' নামের রচনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন 'চব্বিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়। তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদশোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাঁথিয়া চলিয়াছে। শিশু বয়েসের লঘু জীবন বড়ো বড়ো মৃত্যুকেও অনায়াসেই পাশ কাটাইয়া ছুটিয়া যায়— কিন্তু অধিক বয়সে মৃত্যুকে অত সহজে ফাঁকি দিয়া এড়াইয়া চলিবার পথ নাই। তাই সেদিনকার সমস্ত দুঃসহ আঘাত বুক পাতিয়া লইতে হইয়াছিল।'
এই ২৪ বছরের শোকের কথা তিনি লিখেছেন তাঁর 'প্রথম শোক' কবিতাতেও। সেখানে অবশ্য সেটাকে পঁচিশ বছর করা হয়েছে। সেই কবিতা শুরুই হচ্ছে- 'বনের ছায়াতে যে পথটি ছিল সে আজ ঘাসে ঢাকা।/ সেই নির্জনে হঠাৎ পিছন থেকে কে বলে উঠল, 'আমাকে চিনতে পার না?'/ আমি ফিরে তার মুখের দিকে তাকালেম। বললেম, 'মনে পড়ছে, কিন্তু ঠিক নাম করতে পারছি নে।'/ সে বললে, 'আমি তোমার সেই অনেক কালের, সেই পঁচিশ বছর বয়সের শোক।'/ তার চোখের কোণে একটু ছল্ছলে আভা দেখা দিলে, যেন দিঘির জলে চাঁদের রেখা।' এই কবিতার শেষে রয়েছে 'যা ছিল শোক, আজ তাই হয়েছে শান্তি।'
এই রচনাটি 'লিপিকা'র। যে গ্রন্থ ১৯২২ সালে প্রকাশিত। অর্থাৎ ততদিনে কবি প্রৌঢ়। নোবেলপ্রাপ্তির মধ্যে দিয়ে খ্যাতির চূড়ায় অবস্থান করছেন। তবু ব্যক্তিগত জীবনকে ফালাফালা করে দিয়েছে মৃত্যুশোকের ধারালো তরবারি। কিন্তু তবু সব শোকের একেবারে প্রথম যে শোক, তার কাছেই ফিরতে হয়েছে তাঁকে। কেননা আজ সেই শোক তাঁর কাছে আরও গভীর ব্যাঞ্জনায় ধরা দিচ্ছে। শোকের যে অস্থিরতা, যে প্রবল তিক্ত গরলস্রোত তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে থিতিয়ে যায়। সেই প্রিয়জন সান্নিধ্যের স্মৃতি তখন এক শান্তিকে নির্মাণ করতে থাকে। তাঁর লেখাতেই তো আমরা পেয়েছি 'হে জগতের বিস্মৃত, আমার চিরস্মৃত, আগে তোমাকে যেমন গান শুনাইতাম, এখন তোমাকে তেমন শুনাইতে পারি না কেন? যে-সব লেখা তুমি এত ভালোবাসিয়া শুনিতে, তোমার সঙ্গেই যাহাদের বিশেষ যোগ, একটু আড়াল হইয়াছ বলিয়াই তোমার সঙ্গে আর কি তাহাদের কোনও সম্বন্ধ নাই!' অর্থাৎ জীবনের এই প্রথম শোককে সারাজীবন এক লাইটহাউসের মতো সামনে রেখে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কখনও যদি মনে হয়, আস্তে আস্তে নিভে আসছে সেই স্মৃতি, তখন নিজের সেই অসহায়তাও তিনি রেখে গিয়েছেন তাঁর লেখার ভিতরেই। আবার জ্যোতিরিন্দ্রও তাঁকে ভোলেননি। হয়তো মনে কোণে থেকে গিয়েছিল এক তীব্র আপসোস...
কিন্তু এ অনেক পরের কথা। আমাদের লেখা ছুঁয়ে দিক ১৯ এপ্রিলকে। কী হয়েছিল সেই রাতে? কেন জীবন শেষ করে দিতে চেয়ে বিশু নাম্নী এক 'কাপড়উলী'র থেকে লুকিয়ে আফিম কিনে খেলেন তিনি, সেই রহস্যের মীমাংসা বোধহয় আর কখনওই থাকবে না। এই আত্মহত্যার সঙ্গে সরাসরি রবীন্দ্রনাথকে জড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতাও বজায় থাকবে। যেহেতু রবীন্দ্রনাথের বিয়ের চার মাসের মধ্যেই এই ঘটনা ঘটেছিল, সেই কারণেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি গুঞ্জন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর মতো পারিবারিক বন্ধু কিংবা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে ইন্দিরা দেবীর মতে এর পিছনে ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। স্বামীর প্রতি অভিমান থেকেই কাদম্বরী চরম পথ বেছে নিয়েছিলেন কিনা তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই বটে। কিন্তু রয়েছে এই সব মানুষদের ধারণা।
আসলে কাদম্বরী দেবী সংস্কৃতিতে অবগাহন করা নরম মনের এক মানুষ। অভিমান এমন মানুষকেই কুড়ে কুড়ে খায়। হ্যাঁ, তাঁকে দংশন করেছিল একাকিত্বও। হয়তো প্রিয় 'রবি'র ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া, অন্যদিকে জ্যোতিরিন্দ্রর সঙ্গে মনোমালিন্য, সন্তানহীনতার মতো নানা কারণই বুকের ভিতরে ভাসিয়ে রেখেছিল ঘন কালো মেঘ। যে মেঘ থেকে বৃষ্টি হয় না। কেবলই এক দৃঢ় ধ্বনি ছড়িয়ে যেতে থাকে দূরে দূরে। এমনও দাবি করা হয়, কাদম্বরীর আত্মহত্যার প্রবণতা আগেও ছিল। কেবল ১৮৮৪ সালের সেই দিনটা মনের ভিতরে সবচেয়ে বেশি একলা হওয়ার রিনরিনে নিঃসঙ্গ সুর বেজে উঠেছিল। কাদম্বরীর মৃত্যু নিয়ে ঠাকুরবাড়ির নীরবতা কিংবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংবাদমাধ্যমকে প্রভাবিত করে খবরটা চেপে দেওয়াই পরবর্তী সময়ে কাদম্বরীর মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে একটা 'কেচ্ছা'র গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে। কাদম্বরীর ক্রমশ একলা হওয়ার অসহায়তার চেয়ে সেটার আবেদন যে অনেক বেশি তা বলাই বাহুল্য। আর সেটাই হয়েছে কাল। কাদম্বরীর মৃত্যুর নেপথ্য কাহিনি না খুঁজে বরং রবীন্দ্রনাথের লেখায় সেই মৃত্যুর যে অভিঘাত, তা খুঁজতে গেলে হয়তো প্রাপ্তি কম হয় না। আমরা যেন সেই অন্বেষণ জারি রাখি।
আজকের দিনে হয়তো কাদম্বরীকে কাউন্সেলিং করানো যেত। প্রয়োজন পড়লে দেওয়া যেত ওষুধও। শতাব্দী পেরিয়ে আরও দূরে চলে আসা কাদম্বরীর মৃত্যুদিন প্রকৃত প্রস্তাবে এক প্রতীকী মৃত্যুও। প্রিয়জনের ক্রমেই দূরে সরে যাওয়া, কুয়াশাকে দূর না করে তার ভিতর আরও বেশি করে অবুঝ কুয়াশা ছড়িয়ে দেওয়ার পরিণাম থেকে আমাদের সতর্ক করে দেয় এই দিনটা। প্রিয়জনের সান্নিধ্যের চেয়ে বড় ওষুধ যে কিছু হতে পারে না সেকথা মনে করিয়ে দেয়। পাশাপাশি অভিমানী মনকেও বুঝিয়ে দেয়, জীবনের চেয়ে কিছুতেই দামি হতে পারে না লুকিয়ে রাখা আফিমের কালো গুলি!