নির্মল ধর: সত্যান্বেষীর আবিষ্কর্তা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয় পুরনো ইতিহাসের মধ্যেও ফিকশনের এলিমেন্ট খুঁজে বার করে ইতিহাস আশ্রিত বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছিলেন। নিজেই যাকে বলতেন 'ফিকশনাল হিস্ট্রি'! নিশ্চিতভাবে তাঁর হাফডজনের বেশি উপন্যাসের মধ্যে জনপ্রিয়তম রচনা টু 'তুঙ্গভদ্রার তীরে'। দাক্ষিণাত্যের বিজয়নগর রাজ্য যে রচনার মূল পটভূমি। অবশ্য কলিঙ্গ রাজ্যও জড়িত উপন্যাসের দুই নায়িকার কারণে। কারণ কলিঙ্গারাজ তাঁর দুই কন্যা বিদ্যুন্মালা ও মনিকঙ্কনাকে বিজয়নগরের রাজা দেব রায়ের কাছে পাঠিয়েছেন বিবাহের জন্য! পথে তুঙ্গ নদী গর্ভে দুর্ঘটনায় পড়লে বিদ্যুন্মালাকে উদ্ধার করেন অপরিচিত এক যোদ্ধা অর্জুন বর্মা। উদ্ধারকারী অর্জুনের প্রতি বিদ্যুন্মালার স্বাভাবিক ভাবেই দুর্বলতা তৈরি হয়। এবং এক ত্রিকোণ প্রেমের সৃষ্টি হয় লেখকের কলমে।
ছবি: কৌশিক দত্ত
কলিঙ্গ রাজ কন্যাদের সঙ্গে বিজয়নগর রাজার বিয়ের ব্যাপারটাও ছিল এক ধরনের রাজনৈতিক খেলা। বিদ্যুন্মালা সেই খেলার ঘুঁটি হতেও চায়নি। কিন্তু সে তো নারী, তাঁকে পুরুষের ইচ্ছায় চলতেই হয়েছে। কিন্তু রাজা দেব রায়ের প্রতিপক্ষ কম্পনের বিরুদ্ধতায় ও অর্জুন বর্মার নীরব প্রেম বিদ্যুন্মালার মিলন ঘটে। একই সঙ্গে মণিকঙ্কনার সঙ্গে রাজার বন্ধুত্ব হয়। লেখকের কাহিনী ঠিকঠাক বজায় রেখেও নাট্যরূপকার ফিকশনাল হিস্ট্রির মধ্যেই সাবলীল ভঙ্গিতে জুড়ে দিয়েছেন আজকের সময়ের আভাস, অভিঘাত এবং সংঘাতও। নব রূপকার। শুনিয়েছেন সরল রেখায় জীবন চলেনা, বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে একলাও চলতে হয় কখনও। তখনকার রাজা ও প্রজার জীবনেও অনেককিছু মেনে নেওয়া নিয়ে সংশয় করা যেতনা! আর যুদ্ধ - ধর্ম যুদ্ধ, হত্যা যুদ্ধ, গণ হত্যা তখনও চলতো। এবং তখনও কথা উঠত। যে কোনও যুদ্ধে সাধারণ সৈনিক মৃত্যুবরণ করে অথচ যুদ্ধে যেতেন রাজা। এটা একধরনের শঠতা নয়,যা ঘটছে এখনও। তাই অর্জুন বর্মার আক্ষেপ জীবন নদীর জলের মতোই, যতই তাকে হাতের মুঠোয় রাখতে চাও, থাকবেনা। গলে যাবে।
এই নাটক প্রযোজনার সব চাইতে দর্শনীয় দিক হলো উপস্থাপনা। মঞ্চে চিত্রপট দিয়ে সাজানো হয়েছে সেই বিজয়নগর, পম্পাপতির মন্দির, বাহমনিদের আক্রমণপর্ব। কোনও সেট নেই। দুর্দান্ত এই সিনেগ্রাফির কাজ। এমনিতেও মঞ্চ প্রায় প্রপস-হীন! নৌকার দাঁড় বাইবার লাঠিটাই প্রয়োজনে সৈনিকের অস্ত্র হয়েছে, আর কিচ্ছু বাক্স দিয়ে তৈরি রাজসভা। দর্শকের চিত্রপট মুগ্ধ করে দেয় মঞ্চের চিত্রপট! এবং শিল্পীদের পারস্পরিক সহযোগিতায় মঞ্চে তৈরি হয়ে যায় পরিচালক সানি চট্টোপাধ্যায়ের কাঙ্ক্ষিত নাট্য টেনশন! অতীত এগিয়ে এসে হাত ধরে বর্তমানের। 'নান্দনিক' প্রযোজিত এই নাটক প্রমাণ করে দেয় কলকাতার বাইরেও সৃজনী কাজের লোকের অভাব নেই! তাঁরা শহর থেকে দূরে থাকেন বলে বাঁকা চোখে দেখার কোনও কারণ নেই। বর্ধমান আলাপ এর সহযোগিতায় তৈরি এই 'তুঙ্গভদ্রার তীরে' অভিনয়ের দিক থেকেও এতটুকু পিছিয়ে নেই।
ছবি: কৌশিক দত্ত
বরং এগিয়েই রয়েছে প্রায়োগিক শৈলীর অভিনব চিন্তনে। সঙ্গীত রসিক ও গবেষক মানব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজের প্রশংসা অবশ্যই করতে হবে। এবং পরিচালক সানি চট্টোপাধ্যায় একই সঙ্গে নির্দেশনার কাজ ও অর্জুন বর্মার চরিত্রে চারিত্রানুগ অভিনয়ে বেশ সফল। শুধু তিনি নন, প্রতাপ মন্ডল(দেব রায়), প্রীতি কর্মকার(বিদ্যুন্মালা), ঋত্বিকা নাথ(মনিকঙ্কনা), সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়(কম্পন), শর্মিলা চট্টোপাধ্যায়(পিঙ্গলা) সহ প্রত্যেক শিল্পীই নাচ - গানে, স্বাভাবিক অভিনয়ে দলের এমন অভিনব প্রচেষ্টাকে সাফল্যের দরজায় পৌঁছে দিয়েছেন। তবে একটাই শুধু অনুরোধ - পরবর্তী অভিনয়ের আগে আরও একটু সার্বিক অনুশীলন করতে পারলে ভালো হয়।