চারুবাক: নিধুবাবুকে নিয়ে 'অমরগীতি' নামের একটি মিউজিক্যাল ছবি বানিয়েছিলেন পরিচালক তরুণ মজুমদার ! সেখানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-সহ আরও পাঁচজন সুরকার ছিলেন। বিস্ময়ের ঘটনা, এখন শুনতে পাই সেই ছবির প্রিন্ট নাকি 'লোপাট'! আমাদের ইতিহাস সংরক্ষণের কি আশ্চর্য দায়! একচল্লিশ বছর বাদে বাংলা টপ্পা গানের সেই প্রবাদপ্রতিম মানুষটি এই কলকাতার মঞ্চে জীবন্ত হয়ে উপস্থিত হচ্ছেন। সৌজন্যে 'পূর্ব পশ্চিম' নাট্যদল এবং অভিনেতা-গায়ক রজত গঙ্গোপাধ্যায়। দল ও অভিনেতার এমন জুটি না পেলে উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের কলম থেকে বেরোনো এমন মনোহারী নাটকটি মঞ্চে উঠে আসতো না। তাঁর রচনার মধ্যে গুরু নিধুবাবুর জীবনের একটি পর্বই শুধু এসেছে।
আড়াইশো বছর আগের কলকাতার 'সুতানুটি' পাড়ায় ছাপড়া থেকে অপমানিত হয়ে রামনিধি গুপ্তমশাই আখড়া বাঁধেন গরাণহাটা এলাকায়। আপনমনে সঙ্গীতচর্চা করেন। মনের মতো শিষ্য পেলে গানও শেখান। সেখানেই এসে পড়েন রাজা মহানন্দ। তাঁর বড্ড শখ নিজের সুন্দরী তরুণী 'রাখেল' শ্রীকে নিধুবাবুর কাছে গান শেখাবেন। প্রথম গানটি শুনেই তিনি রাজি হন শ্রীমতির সংগীতগুরু হতে। তবে শর্ত একটাই। গুরুগৃহে থেকে গান শিখতে হবে। কারণ বিভিন্ন রাগ গাইবার সময় ও ক্ষন যে নির্দিষ্ট। নিধুবাবু মধ্যরাত বা ভোররাতের রাগ ঠিক ওই সময়ই শেখাবেন, অন্য সময়ে নয়। নিজের রক্ষিতাকে এভাবে অন্যের হেফাজতে রাখতে প্রথমটায় রাজি না হলেও, শ্রীমতির আগ্রহে নিমরাজি হন। অচিরেই, গুরু শিষ্যার সম্পর্ক নিয়ে রাজার মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়! যখন তিনি জানতে পারেন সবাইকে লুকিয়ে ভোর রাতে গঙ্গা স্নানের অজুহাতে শ্রী গান শিখতে চলে আসে গুরুর আখড়ায়।
গুরু শিষ্যার মধ্যে কৃষ্ণ-রাধার অভিসার কল্পনা করে বিরোধ বাঁধে দুজনের মধ্যে! অবশ্য শেষপর্যন্ত নিধুবাবুর বিশ্লেষণেই বিরোধের অবসান। একজন সঙ্গীতপ্রেমী শিষ্যাকে গুরু বলেন, মন খুলে হাওয়ায় উড়তে। রাজা যেন তাঁকে খাঁচার বেড়ায় আটকে না রাখেন, তাহলেই প্রকৃত ভালোবাসা প্রাপ্তিসম্ভব। আরও একটি তৎকালীন সামাজিক বাস্তবের কথাও এসেছে নাটকে। রাজা রক্ষিতা রাখতে পারেন, তাতে দোষ নেই, কিন্তু রক্ষিতাকে বিয়ে করলে রাজত্ব হারাতে হয়। উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের গভীর গবেষণাপ্রসূত লেখায় এই তিনটি চরিত্রের কাঠামো গঠন, পারস্পরিক বোঝাপড়ার বিষয়টা একটু বেশিই সরল লাগলেও, আড়াইশো বছর আগের সুতানুটির জীবনযাপনকে মনে রাখলে সেটা অস্বাভাবিক ঠেকবে না।
গুরু-শিষ্যার অমলিন সম্পর্কটি তাঁর কলমে সুন্দর ও সুচারু ভঙ্গিতেই এসেছে। কোনও মালিন্য স্পর্শ করেনি কাউকেই! পরিচালক সৌমিত্র মিত্র, কোনরকম নাটকীয় প্যাঁচপয়জার না দেখিয়ে প্রায় নিরাভরণ মঞ্চে শুধু আলোর ব্যবহার এবং শুরুতেই মজাদার ভঙ্গিতে সংলাপের মাধ্যমে পরিবেশটি তৈরি করে দেন। এমনকী মোবাইল ব্যবহারের বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ কাজটিও। এই নাটক পুরো দাঁড়িয়ে আছে সুরবদ্ধ গানের চলনে, যার অনেকটাই ধরে রেখেছেন সুগায়ক অভিনেতা রজত গঙ্গোপাধ্যায় এবং শ্রীমতী চরিত্রের শিল্পী আনন্দরূপা চক্রবর্তী! তাঁর গানের কণ্ঠটি যেমন রেওয়াজি, তেমন চর্চিত অভিনয়টাও। যেমন দুটি গান- "নানান দেশে নানান ভাষা/বিনি স্বদেশী ভাষা," বা "কাজল দিও না চোখে কাজল নয়নে আজ।" কিংবা শ্রীমতী যখন গুরুর উদ্দেশে বলে ওঠে- "যিনি আসল ধনে ধনী, আমি তাঁর কাছেই ঋণী! আমি বিবাহ করব না...", তখনই অনুভূত হয় আমরা কোন সময়ে ছিলাম, আর এখন কোন সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি। এখানেই এই প্রযোজনার সার্থকতা।
[আরও পড়ুন: স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হিনা খান, জল্পনায় সিলমোহর দিয়ে বললেন, ‘স্টেজ ৩, প্রার্থনা করুন…’]
অলক রায় চৌধুরী তখনকার সময়কে মনে রেখেই বিভিন্ন যন্ত্র ব্যবহার করে সেই আবহ সৃজন করেছেন, ধন্যবাদ তাঁকেও। মহাজনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন কিংশুক গঙ্গোপাধ্যায়। রাজা মহানন্দর চরিত্রে শন্তিলাল মুখোপাধ্যায় ছাড়া আর কাউকে এই মুহূর্তে ভাবতেও পারছি না। তিনি শ্রীমতিকে নিজের করে পাওয়ার জন্য যেমন ব্যাকুলতা দেখিয়েছেন, তেমনই হৃদয় পরিবর্তনের ব্যাপারটিও স্বল্প সময়ে সামলে নিয়েছেন। এখানে তাঁর আরও একটু সময় পাওয়া উচিত ছিল। মালবিকা মিত্রের পোশাক পরিকল্পনা সময়ানুগ! আজকের আগুন নিয়ে খেলার সময় থেকে চোখ সরিয়ে একটু অতীতচারন হয়তো কারও কাছে 'পলায়ন' মনে হতে পারে, কিন্তু মনে রাখতে হবে অতীতটা তো নিজের মাটি ও মানুষের, ভিনদেশের নয়।