বিদিশা চট্টোপাধ্যায়: ‘পক্ষীরাজের ডিম’ ঘোঁতনদের মতো ফেল করা ছেলেদের নিয়ে ছবি। ‘পক্ষীরাজের ডিম’ ফেল-পাসের বালাই না-করা পপিন্সদের মতো মেয়েদের নিয়ে ছবি। ‘পক্ষীরাজের ডিম’ ব্রাত্য হয়ে যাওয়া পাগলাটে বটব্যালদের মতো বিজ্ঞান-পাগলদের নিয়ে ছবি। ‘পক্ষীরাজের ডিম’ সাপরাজবাবার মতো আশ্চর্য লোভহীন মানুষদের নিয়ে ছবি। এইসব মানুষ কি আমি-আপনি আমাদের চারপাশে দেখতে পাই আর? ‘পক্ষীরাজের ডিম’ আসলে এই ডোডো পাখির মতো হারিয়ে যাওয়া মানুষ, মূল্যবোধ আর মনের ছবি। সৌকর্য ঘোষাল এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। আর গোটা ছবি আমি ঘোঁতনের মতো হাঁ-মুখ নিয়ে দেখেছি। অমন হাঁ-মুখ করা ছেলে বা মেয়েদের দেখলে এক সময় হাসাহাসি করতাম, বলতাম কি হাবলা রে বাবা, মাথায় এক্কেবারে গোবর পোরা নির্ঘাত। কী আনস্মার্ট! ‘পক্ষীরাজের ডিম’ সেইসব আনস্মার্টদের নিয়ে ছবি। যাদের কোনও বন্ধু হয় না, যারা একা-একা থাকে, নিজের সঙ্গে কথা বলে। বন্ধুরা খেলতে নেয় না, বড়রা দলে নেয় না। যারা দলছুট। যাদের এই পৃথিবীতে খুব কম মানুষ বোঝে।
ছবি: সংগৃহীত
তারা পটাপট জীবনযুদ্ধে জিতে যায় না, যারা ক্লাসে ফার্স্ট হওয়ার গর্ব কী জানতেই পারে না। যারা খুব সহজে মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকেও যায়। কিন্তু তাদেরও পাশে বন্ধু থাকে। যেমন ঘোঁতন অঙ্কে ফেল করলেও পপিন্স তাঁকে ভালবাসে, ভূগোল পড়াতে রাজি হয়। যেমন ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ ছিল। যেমন ‘ফটিকচাঁদ’-এর মন বুঝেছিল কেবল ‘হারুনদা’! যেমন ‘বদনবাবু’ বিশ্বাস করেছিলেন যে, ‘টেরোড্যাকটিলের ডিম’ হয় ঠিক তেমন। ঘোঁতনও বিশ্বাস করত এমন অলৌকিক সব গল্পে। রাতের আকাশ দেখতে-দেখতে অবিশ্বাস্য সব কথা ভাবত, যা জোরে বললে একেবারে মাথাখারাপ বলে বাতিল করে দেবে আশেপাশের মানুষ। যেমন বটব্যাল স্যরকে বাতিল করল ঘোঁতনদের স্কুলের হেডস্যর। আহা কি এমন করেছিলেন তিনি, ফিজিক্সের প্র্যাকটিকাল ক্লাস নিচ্ছিলেন। তবে হ্যাঁ, প্রথাগত ক্লাস নয়। এই তো, এইখানেই মুশকিল! কেন মশাই আপনি কোন হরিদাস পাল যে বাকিদের মতো ক্লাস নেবেন না! এই হচ্ছে রুল্স আর এই হচ্ছে রেগুলেশন! এর বাইরে গিয়েছ কি মরেছ। আমি, আমরা প্রতিদিন এই রুল্স আর রেগুলেশন মেপে মেপে চলি। আর প্রতিদিন কি প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরি। শিরদাঁড়া ঝুঁকে যায়। মাথায় কিলবিল করা অন্য ভাবনাগুলো কলিগদের সামনে বলার সাহস হয় না। কারণ নিয়মের বাইরে গেলেই কাঁচি করে দেবে! আর সেই কল্পনাপ্রবণ মনটা আসতে-আসতে মরে যায়। আজকালকার দিনে তাই ঘোঁতন, পপিন্স, বটব্যাল, সাপরাজবাবাদের আর এই শহরের ভিড়ে দেখতেই পাই না। তাই সৌকর্য-র তৈরি ‘পক্ষীরাজের ডিম’ দেখতে-দেখতে আপনা থেকেই গলা বুজে এল।
ছবি: সংগৃহীত
আমিও অঙ্কে ফেল করেছিলাম একবার। ফোর্থ সাবজেক্ট ছিল বলে কোনওরকমে উতরে গিয়েছিলাম। আমারও যদি তখন একটা পপিন্স থাকত, যে আমাকে ছেড়ে যেত না, তাহলে মা কালীর দিব্যি কেটে আমিও দাঁত বের করে হাসতাম। ভাগ্যিস ঘোঁতনের ছিল, আর খ্যাঁকখ্যাঁক করলেও ঘোঁতনকে বিশ্বাস করেছিল বটব্যাল আর তার শাগরেদ প্যাংলা। বটব্যাল খুঁজে চলেছে বাবার রেখে যাওয়া অসম্পূর্ণ সায়েন্স থিওরি-র উৎস। ঘোঁতন অঙ্কে পাশ করতে চায় আর গ্রামের উড়ন্ত মন্দিরের রহস্যভেদ করতে চায়। অন্যদিকে উড়ন্ত মন্দিরের তলায় এক আশ্চর্য শক্তির খোঁজে এসে পড়ে এক বিদেশি, মিস্টার ভিলেন। আশ্চর্য শক্তি ভুল লোকের হাতে পড়লে কি হয় সে এখন আমরা পৃথিবীর যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় বুঝেই গিয়েছি। কিন্তু সবসময় ক্ষমতাশালী হলেই জিতে যাবে এমন তো নাও হতে পারে– এই একটা বিশ্বাস না থাকলে এই পোড়া জীবন বড়ই অর্থহীন।
মিস্টার ভিলেনদের সঙ্গে তাই ঘোঁতন, পপিন্স, বটব্যালদের লড়াই চলবে আজীবন। তার মধ্যেই থাকবে একসঙ্গে হাত ধরে মাঠে-ঘাটে ঘোরা, পপিন্সদের ফ্রক থেকে চোরকাটা বেছে দেওয়া, থাকবে অভিমান, থাকবে বটব্যালদের মতো উল্টো পথে হাঁটা মানুষ। আর থাকবে ‘পক্ষীরাজের ডিম’-এর খোঁজ– যা বেশির ভাগ ক্ষমতালোভী মানুষের কাছে শুধুই অর্থ আর পৃথিবী দমন করার শক্তি। ‘পক্ষীরাজের ডিম’ এক অবয়বহীন মন যেখান থেকে বিছুরিত হয় শিক্ষা, সচেতনতা আর বন্ধুতার আলো। মহাব্রত (ঘোঁতন), অনুমেঘা (পপিন্স) এই ছবির সেই আলো। কী যে মায়াবী এই দুই অভিনেতা! মন জয় করে নিলেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য (বটব্যাল), শ্যামল চক্রবর্তীও (প্যাংলা)। ওঁদের অভিনয় যেন এই দু’জনকে আরও জোরালো করে দেয়। আসলে এই ছবির সকলেই একটা টিম, একটা ভয়েস হয়ে কাজ করেছেন। দেবেশ রায়চৌধুরি, অনুজয় চট্টোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গেও একই কথা প্রযোজ্য। সিনেমাটোগ্রাফার সৌমিক হালদার ম্যাজিকের মতো কাজ করেছেন। মিউজিকে নবারুণ বোস, সম্পাদনায় সংলাপ ভৌমিক, পোশাকে পূজা চট্টোপাধ্যায় সকলেই একটা টিম হয়ে পরিচালক-চিত্রনাট্যকার সৌকর্য ঘোষালের সঙ্গে মিলে ‘পক্ষীরাজের ডিম’-এর অনুসন্ধান করেছেন। আর তাই বোধহয় পর্দায় আমিও খুঁজে পেলাম সেই অমূল্য রতন!