শম্পালী মৌলিক: আমি যখন মফস্সল থেকে কলকাতা শহরে এসে থাকতে শুরু করি, সেই সময় চাবিওয়ালার খুব প্রয়োজন পড়েছিল। নতুন থাকার জায়গা, অচেনা তালা-চাবি এবং প্রয়োজন মতো একটা বাড়তি চাবির চাহিদায়। আমার ধারণা ছিল একমাত্র শহরতলিতেই দক্ষ চাবিওয়ালা পাওয়া যায়। কিন্তু না, দক্ষিণ কলকাতার সম্ভ্রান্ত অঞ্চলে দুপুরবেলায় রাস্তা থেকে ভেসে আসা চাবির ধাতব শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল চাবি হারালেও মুশকিল আসান আছে তাহলে। চাবিওয়ালারা হারিয়ে যায়নি। বড়পর্দায় সেই ‘চাবিওয়ালা’-কে দেখে স্রেফ খুশি হয়ে গেলাম। রাজা ঘোষের ছবি ‘চাবিওয়ালা’ দেশ-বিদেশের ফিল্মোৎসবে সমাদৃত হয়েছে। একটি ফেস্টিভালে ছবির অন্যতম প্রধান শিল্পী অমৃতা চট্টোপাধ্যায় সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কারও অর্জন করেছেন। ছবির প্রত্যেকটা ফ্রেম খুব সুন্দর। খুব ক্ষীণ হলেও বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ফ্রেম-ভাবনার কথা মনে করায়।
গল্পটা কেমন? মূলত চাবির অন্বেষণ নিয়েই ছবির কাহিনি। কাজ হারিয়ে শহরে এসে পড়েছে দুই চাবিওয়ালা ভবেন ( কৌশিক কর) আর নগেন ( সৌমেন চক্রবর্তী)। ভবেন খুঁজছে তার হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকা ফতিমাকে (অমৃতা চট্টোপাধ্যায়)। আর্থসামাজিক অবস্থান ও ভিন্ন ধর্মের কারণে তাদের প্রেম পূর্ণতা পায়নি। ফতিমার বিয়ে হয়ে গেছে পরিবারের চাপে। শহরে এসে ফতিমাও জীবনের জটিল আবর্তে আটকে গিয়েছে। অন্যদিকে ভবেন প্রতিনিয়ত এমন মানুষের মুখোমুখি হয় যাদের কোনও না কোনও চাবি হারিয়ে গিয়েছে। চাবির খোঁজে সেই সব মানুষ কী করে? কারও আবার মনের চাবিটাই ভ্যানিস। এইসবের মধ্যে ভবেন আশায় বাঁচে যে, কোনও একদিন ঠিক ফতিমাকে খুঁজে পাবে। কিন্তু কীভাবে? এই নিয়েই ছবির গল্প দানা বাঁধে।
মুক্তিতে বিলম্ব হলেও, যাঁরা ছবিটা দেখছেন তাঁদের মন ছুঁয়ে যাচ্ছে এই ছবির ভাবনা। চাবিওয়ালার চরিত্রে অত্যন্ত সাবলীল কৌশিক কর। প্রায় সাত বছর আগে শুট করা ছবিটি, ফলে অভিনেতাদের চেহারায় কমবয়সের ছাপ স্পষ্ট। সেটা ছবিতে ভোরের আলোর উজ্জ্বলতা যোগ করেছে। চমৎকার অভিনয় করেছেন ফতিমার চরিত্রে অমৃতা। চরিত্রের দোলাচল, অসহায়তা দারুণ ধরেছেন। রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায় ছবির আরেক চমক। ‘ভুখারাম’ তার নাম। বহুরূপী ঠিক নয়, কিন্তু অদ্ভুত তার পেশা। সংলাপ বলার ধরন এবং চোখের চাউনিতে রাহুল মুগ্ধ করেছেন। শুভাশিস মুখোপাধ্যায় হতাশ লেখকের চরিত্রে অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য। দারুণ ভালো লাগে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়কে। বিজ্ঞাপন সংস্থার এক কর্তার চরিত্রে তিনি প্রায় নিখুঁত। তার প্রতিটি সংলাপ চেতনায় ধাক্কা মারে। শঙ্কর দেবনাথ, দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত ও সোহাগ সেন স্বল্প পরিসরে ঠিকঠাক। প্রসেনজিৎ চৌধুরির সিনেমাটোগ্রাফি ছবির বড় জোরের জায়গা। তবে চিত্রনাট্য নির্মাণে আরও যত্নের প্রয়োজন ছিল। শেষত বলা যায় ‘চাবিওয়ালা’ বড়পর্দায় দেখার ছবি।