shono
Advertisement
Chaalchitra Ekhon Review

মৃণাল সেনকে অঞ্জন দত্তর শ্রদ্ধার্ঘ্য, কেমন হল 'চালচিত্র এখন'? পড়ুন রিভিউ

এই ছবির ফরম্যাট মৃণাল সেনের ছবির মতোই ছকভাঙা।
Published By: Suparna MajumderPosted: 04:38 PM May 10, 2024Updated: 04:44 PM May 10, 2024

চারুবাক: অঞ্জন দত্তর সঙ্গে মৃণাল সেনের (Mrinal Sen) বয়সের ফারাক অন্তত তিরিশ বা একত্রিশ বছরের। দুজনের সম্পর্ক? আমরা ভালো করেই জানি পিতা ও সন্তানের মতোই। পিতৃসম মৃণাল সেনের জন্মশতার্ষিকীতে পুত্রসম অঞ্জন দত্তর শুধু আন্তরিক নয়, বন্ধুত্বে, ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায়, রাজনীতির শিক্ষায়, জীর্ণ পুরাতন কলকাতাকে ঘৃণা-ভালোবাসায় বুকের কাছে আবার টেনে নিয়ে মনের সুখে গান গেয়ে উঠে তাঁর প্রতি এক সিনেমাটিক অবিচুয়ারি 'চালচিত্র এখন'।

Advertisement

মৃণাল সেন অঞ্জনকে (Anjan Dutt) ডেকে নিয়েছিলেন 'চালচিত্র' ছবিতে দীপুর চরিত্রে অভিনয়ের জন্য। তখন তাঁর নাটকের অভিজ্ঞতা বলতে ছিল, বাংলা নাটকের চেনা ছকের বাইরে, 'মারা সাদ' ও আরও দু-তিনটি নাটকে অভিনয় ও পরিচালনা। আশির দশকের শুরুতে তখন বাংলায় বামপন্থী সরকার। মৃণাল সেন নিজে বামপন্থী হয়েও কনফিউজড। অঞ্জন দত্ত নিজে কমিউনিস্ট নন সেটা জানেন এবং ব্যক্তিগত সত্তার মৃত্যুতে বিশ্বাস করেন না, তাঁর বিশ্বাস কমিউনিস্ট দল ব্যক্তি স্বাতন্ত্র পছন্দ করে না। তাই তিনি নিজের নাটকের দল ধরে রাখতে পারেন না। প্রথম মৃণাল সেনের মুখোমুখি হয়ে জানতে পারেন ওপার বাংলা থেকে ছিন্নমূল হয়ে এপারে আশা মানুষটি কিন্তু এই কলকাতার। শহরটাকেই প্রচন্ড ভালোবাসেন, আবার বিরক্তও হন। অথচ তাঁকে ফ্যাসিনেট করে এই কলকাতা। কলকাতাই তাঁর এলডোরাডো।

কিছু বছর আগে এই বিচিত্র মানুষটি এক বিষন্ন বিকেলে বিহারের কোনও একটি হোটেলের আয়নায় নিজেকে উলঙ্গ করে দেখে উপলব্ধি করেন, ওষুধ ফিরি করার কাজ আর নয়, সিনেমাই তিনি করবেন। গেটক্রাস করে ঢুকে পড়েন ফিল্ম তৈরির কাজে। আর এত বছর পর অঞ্জন (ছবিতে অবশ্য নাম রঞ্জন) নামের চিন্তাশীল অথচ দ্বিধাগ্রস্থ তরুণকে তিনি দেখিয়ে দেন একজন মননশীল সৃজনশিল্পীর চলার পথ। অঞ্জনের জীবনটাই ঘুরে যায় অন্য এক পথে - যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি গেয়ে ওঠেন "....মনের সুখে কথা বলার হয়নি সুযোগ/মনের সুখে গাইছি আমি গান..."। একজন সৃষ্টিশীল মানুষ কীভাবে অপর একজনের মধ্যে জীবনের বোধ, অনুভূতি শুধু নয়, সৃজনশীলতার বীজ বপন করে দিতে পারে, অন্য এক শিল্পীর জন্ম দেন, তার উদাহরণ 'চালচিত্র এখন' (Chaalchitra Ekhon)। সুখ-দুঃখ মিলেমিশে এক সুন্দর 'মেলানকলি'।

[আরও পড়ুন: টোকা ছবি লাপাতা লেডিজ! কিরণ রাওয়ের ছবি নিয়ে বিস্ফোরক আমিরের সহ-অভিনেতা]

টাইটেল কার্ডের শুরুতেই অঞ্জন জানিয়ে দিয়েছেন ছবিটি হচ্ছে "আ টাইমলেস টেল অফ মৃণাল সেন অ্যান্ড অঞ্জন দত্ত!" সত্যিই তাই, বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের পরই বলা হয় - এটা সত্যি ঘটনা। একেবারে মৃণাল সেনের চরিত্রের মতোই গিমিক। বাকি দেড় ঘণ্টা সময় পরিচালক অঞ্জন দত্ত গুরুদেবের জুতোয় পা ঢুকিয়ে তাঁর সিনেমা ব্যকরণের প্রকৌশলী ঢঙে 'চালচিত্র' ছবি তৈরির গল্পই শুধু বলেননি, তিনি তাঁর জীবন দর্শনের পরিবর্তিত অবস্থানকে রীতিমতো জাস্টিফাই করেছেন মৃণাল সেনের (ছবিতে অবশ্য কুণাল সেন) স্বাভাবিক ও পারিবারিক জীবনধারণ, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন কীভাবে জার্মানিতে অঞ্জনের 'পালিয়ে' যাবার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। কুণাল সেনের বুকে মুখ লুকিয়ে রঞ্জন আত্নসমর্পণ করলে, মৃণাল সেন আঞ্জনকে বলে ওঠেন "কাঁদ, ভালো করে কেঁদে নাও!" এরপর আর কোনও কথার প্রয়োজন হয় না। দর্শক উপলব্ধি করেন কেন এই শ্রদ্ধার্ঘ্য, মনের কোন গহন গভীর থেকে একজন তরুণ পিতৃসম মানুষের প্রতি এতটা আন্তরিক নিবেদন আগ্রহী হয়ে ওঠে।

এই ছবির ফরম্যাট মৃণাল সেনের ছবির মতোই ছকভাঙা, রীতিবরুদ্ধ, সিনেমা তৈরির শট, সিনেমা তৈরির বাইরের শট পাশাপাশি একাকার। জীবন ও বাস্তব সমান্তরাল ভাবেই এসেছে ছবিতে। অথচ কোথাও এতটুকু ধাক্কা নেই, কী মোলায়েম মসৃণ চলন! ভালো লাগে সেই আশির দশকে মৃণাল সেনের ইউনিটের চেনা মানুষগুলোর অন্য নামে উপস্থিতি - মহাজন হয়েছেন মাধবন (সুপ্রভাত), গীতা হয়েছেন মিতা(বিদীপ্তা), মুকুল হয়েছেন বিপুল (শুভাশিস), উৎপল হয়েছেন উজ্জ্বল (শেখর)। কুণাল সেনের বাড়ির অন্তরঙ্গ পরিবেশটিও পরিচ্ছন্নতা ও স্নিগ্ধতায় ভরা। বিনম্র শ্রদ্ধায় তৈরি এই ছবির শরীরে অঞ্জন বাহারি রঙিন এক গানের চাদর জড়িয়ে দিয়েছেন। যে গান একান্তই অঞ্জনের গান হয়েও মৃণাল সেনের অন্তরের কথারই প্রতিধ্বনি। যেমন, "পকেট গড়ের মাঠ, তবু স্বপ্ন দেখা যায় আকাশ কুসুম নীল আকাশের নীচে..." বা "ভাঙাচোরা গলি, পিচ গলা রাস্তায় / ভাঙাচোরা মন এখনও স্বপ্ন দেখতে পায়..."।

তবে শেষ গানটির একেবারে শেষলাইনটি (অল আই হ্যাভ টু ডু ইজ টু মেক এ মুভি অন মৃণাল সেন) না উচ্চারণ করলেও চলত। এই ছবির মূল আকর্ষণ দুজন - রঞ্জনের চরিত্রে সায়ন চক্রবর্তী এবং কুণাল সেনের ভূমিকায় অঞ্জন দত্ত নিজে। নিজের চরিত্রে সায়নকে দিয়ে দুর্দান্ত অভিনয় করিয়ে নিয়েছেন অঞ্জন। না, সেজন্য সায়নের ক্রেডিটকে এতটুকু খাটো করছি না, তিনি চরিত্রটির অস্থিরতা, সংকট, অসহায়তা সুন্দর ফুটিয়েছেন। আর অঞ্জন? তাঁকে মৃণাল সেন-মহাজন রাতো বলেই গেছেন 'আল পাচিনো!' মৃণাল সেনের দৈনন্দিন ব্যবহারিক ভালো-মন্দ সব দিকগুলোই অঞ্জন সুন্দর রপ্ত করেছেন। আসলে গভীর ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতার শুধু ছোঁয়া নয়, মনন ও মানবিকতা দিয়ে বিগ্রহ তৈরির এক দৃষ্টান্ত এই ছবি। বলতে পারি - অঞ্জনের জীবনের এপর্যন্ত সেরা কাজ!

সিনেমা - চালচিত্র এখন
অভিনয়ে - অঞ্জন দত্ত, সায়ন চক্রবর্তী, বিদীপ্তা চক্রবর্তী, সুপ্রভাত দাস, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, প্রমুখ
পরিচালনা - অঞ্জন দত্ত

[আরও পড়ুন: সৃজিতের গলায় সাপ! পরিচালকের ‘অতি উত্তম’ ছবি দেখে হইচই, ব্যাপারটা কী?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • টাইটেল কার্ডের শুরুতেই অঞ্জন জানিয়ে দিয়েছেন ছবিটি হচ্ছে "আ টাইমলেস টেল অফ মৃণাল সেন অ্যান্ড অঞ্জন দত্ত!"
  • সত্যিই তাই, বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের পরই বলা হয় - 'চালচিত্র এখন' সত্যি ঘটনা।
Advertisement