চারুবাক: প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা জুটির পঞ্চাশতম ছবি। নাম 'অযোগ্য' (Ajogyo Movie)। সমীকরণ যে আলাদা হবে এটাই অবধারিত। দীর্ঘ সময়ের এই জুটি অধিকাংশ ছবিতেই সুচিত্রা-উত্তমের মতো শেষ দৃশ্যে 'মধুরেণ সমাপয়েৎ' ঘরানার গল্পেই কাজ করেছেন। পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর নিজের ৩২তম ছবিতে জনপ্রিয় এই জুটিকে নিয়ে ব্যতিক্রমী কিছু করবেন এটাই তো স্বাভাবিক। 'অযোগ্য' এমন গল্প যাতে রয়েছে অগনিত চওড়া রাস্তা, লেন, গলি, কানাগলি আর 'জয় জগন্নাথ'। যে উচ্চারণে অতীত-বর্তমান, পুরনো প্রেম, ব্যথা-যন্ত্রণা, রাগ-দুঃখ, অভিমান আর পুরীর সমুদ্র মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
কৌশিকের চিত্রনাট্য তাঁর একান্ত নিজস্ব সুরে বাঁধা। যেখানে আজকের সমযের আঁচড় যেমন স্পষ্ট, তেমনি হালকা থ্রিলারের মেজাজও অস্পষ্ট নয়। আবার অতীতের রক্ত ঝরানো রাজনীতির সঙ্গে বিরোধী পক্ষের তীব্র সংঘাতও অনিবার্য ভাবে এসেছে। এই অতীত ও বর্তমান বুননের কাজটিতে কৌশিকের হাতে নকশিকাঁথা মতো সুন্দর হয়ে উঠেছে। কিন্তু বর্তমানের ঘটনা ও তার বিন্যাসে একটু বেশিই বাস্তবের অভাব ও কাকতালীয়র সমাবেশ মনে হয়। সব চরিত্র ও ঘটনার গোলগাল নিটোল সমাপ্তি না টানলেই বা ক্ষতি হত কী? পর্ণা (ঋতুপর্ণা), রক্তিম(শিলাজিৎ) ও তাঁদের অসুস্থ শিশুকন্যার সংসারে আর্থিক দুর্যোগ এলে পর্ণাকে চাকরি নিতে হয় এক অফিসে, যেখানকার বস (সুদীপ) আবার পর্ণার পুরনো প্রেমিক প্রসেনের (প্রসেনজিৎ) পরিচিত(কাকতালীয়!)। রক্তিম পানশালায় এক সন্ধ্যায় পরিচিত হয় প্রসেনের সঙ্গে, বন্ধুত্বও হয়ে যায়। তার পর ঘটনাক্রমে দেখা যায় এঁরা তিনজনই জড়িত চাকরি ও ব্যবসার সুতোয় (কাকতালীয়!)। কেন সকলে (কেউ জানিয়ে, কেউ না জানিয়ে) পুরীতে জগন্নাথ দর্শনে যায়, সেটা হলে গিয়ে দেখাটাই ভালো।
[আরও পড়ুন: প্রথম ছবিই সুপারহিট, নতুন ‘গল্প’ নিয়ে ফিরছেন পরিচালক মানসী সিনহা ]
গল্পে প্রসেন অর্থাৎ প্রসেনজিতের চরিত্রটি মাকে (লিলি চক্রবর্তী) বলে 'গার্লফ্রেন্ড'। আবার আচমকাই চলে আসে অম্বরীশের চরিত্র। অতীতের প্রেম, রাজনীতির জট ধীরে ধীরে খোলস খুলতে থাকে। যেন সিনেমার পর্দায় কোনও উপন্যাসের রচনা হয়েছে। চেনা ছন্দে একটু আলাদা পথে হেঁটেছেন কৌশিক। বিস্তীর্ণ ঘটনাকে গুটিয়ে ফেলার কাজেই ছিল হয়তো বেশি নজর ছিল। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের সুরে এবং অনুপম, কৌশিক প্রমুখের লেখা গানগুলো এই ছবিকে বড্ড মন ভালো করে দেবার কাজটি করেছে। ছবির বিভিন্ন চরিত্রের মানসিক অবস্থা, পরিস্থিতির প্রিলিউড হিসেবে গানগুলির কথা ও সুরের চলন পুরো ছবিটাকে ঋদ্ধ করেছে - এটা মানতেই হচ্ছে! বিশেষ করে দুটি গান - "যত ভাবি ভুলে গেছি / চুপিচুপি তত খোঁজে সে আমায়" ও "অচেনা নদী দুটো মেশে মোহনায়!" অন্য গানগুলোও কথায়-সুরে অনেক অনুভূতি প্রকাশ করে।
এবার আসা যাক অভিনয়ের কথায়, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় (Prosenjit Chatterjee) এই ছবিতে হারানো প্রেমের অভিমান, দুঃখ, যন্ত্রণা নিজের ভিতরে গুমরে চেপে রেখে বাইরে একটু বেশি সপ্রতিভ, কিছুই হয়নি গোছের ব্যবহার করতে অভ্যস্ত। এই পর্যায়ে তিনি বেশ ভালো। পর্ণার মুখোমুখি হবার পর সেই মুখোশ খসে পড়লে তাঁর কাছে একটু অস্বস্তির অভিনয় দেখার আশা ছিল। পর্ণার চরিত্রে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত (Rituparna Sengupta) সাংসারিক ঝামেলায় বিধ্বস্ত থাকা, অসহায়তা, প্রসেনের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর পুরোনো স্মৃতির যন্ত্রণায় কাতর হয়ে ওঠার পর্বগুলো সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন। আসলে এঁরা দুজনেই চিত্রনাট্যের মেরুদণ্ড।
অভিনয়েও সুন্দর বোঝাপড়া ক্যামেরার সামনে। কৌশিকের হাতে এঁরাই তো তুরুপের তাস!তবে তুরুপের টেক্কা না হয়েও রক্তিমের চরিত্রে শিলাজিৎ (Silajit Majumder) দুর্দান্ত ও দারুণ এক সহ-অভিনেতা। তাঁর স্বাভাবিক, সাবলীল অভিনয় চরিত্রটির চামড়া ভেদ করে শিরায় পৌঁছেছে। 'গার্লফ্রেন্ড'-এর মোড়কে লিলি চক্রবর্তী বেশ একজন স্নেহশীল 'মা' হয়ে উঠেছেন। সুদীপ মুখোপাধ্যায় ও অম্বারীশ ভট্টাচার্যের ছোট্ট সময়ের উপস্থিতিও চোখে পড়তে বাধ্য চিত্রনাট্যের গুণে। আদতে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের যোগ্য হাতে ছবিটা 'অযোগ্য' হতে পারল না। বরং পরিচালক সুযোগ্যভাবেই দীর্ঘ ন্যারেটিভ সামলে বড়পর্দায় এক উপন্যাসের রচনা করলেন। এটাই এটাই বড় পাওনা দর্শকের।
সিনেমা - অযোগ্য
অভিনয়ে - প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, শিলাজিৎ মজুমদার, লিলি চক্রবর্তী, সুদীপ মুখোপাধ্যায়, অম্বরীশ ভট্টাচার্য
পরিচালনায় - কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়