বিশ্বদীপ দে: 'লোনলিনেস হ্যাজ ফলোড মি মাই হোল লাইফ, এভরিহোয়্যার।... আই অ্যাম গডস লোনলি ম্যান।' ১৯৭৬ সালে মুক্তি পাওয়া মার্টিন স্করসিসির 'ট্যাক্সি ড্রাইভার' ছবির এই সংলাপই যেন টড ফিলিপসের 'জোকার' (২০১৯) ছবির প্রোটাগনিস্ট আর্থার ফ্লেক চরিত্রটির মূল ভিত্তি। এবার মুক্তি পেল ছবির সিক্যুয়েল 'জোকার: ফোলি আ দ্যু'। এখানে জোকারের এক দোসরও রয়েছে। হার্লে কুইন ওরফে লি। এই যুগলবন্দি কি ম্যাজিক তৈরি করতে পারল? নাকি প্রথম ছবির থেকে অনেকটাই পিছিয়ে রইল সিক্যুয়েল?
প্রথম ছবি যেখানে থেমেছিল সেখান থেকেই শুরু হয় ছবিটি। আদালতে বিচার চলছে আর্থারের। যাকে গথাম শহর চিহ্নিত করছে শতাব্দীর সবচেয়ে আলোচিত বিচার হিসেবে। তার মাথায় পাঁচটা খুনের অভিযোগ! যদিও হার্লে কুইনের সঙ্গে প্রথম আলাপেই অম্লানচিত্তে সে বলে দেয়, আসলে সংখ্যাটা ছয়। নিজের অসুস্থ মাকেও সে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করেছে। এটা অবশ্য প্রথম ছবির সব দর্শকই জানেন। গোটা শহরে আর্থারের অসংখ্য ভক্ত। জোকার সেজে তারা ঘুরে বেড়ায় গথামের রাস্তায়। তাদের কাছে আর্থার কোনও অপরাধী নয়। সে একজন নায়ক। তবু বিচার তো বিচারের নিয়মেই চলে। এরই মধ্যে হার্লের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে থাকে আর্থার। লি তাকে বলে, তারা দুজন একদিন এক হবে। আর তার পর একটা ছোট্ট পাহাড় নির্মাণ করবে।
১৯৩৯ সালে জন্ম ব্যাটম্যানের। পরের বছরই আবির্ভূত হয় জোকার। প্রথমে কথা ছিল, প্রথম পর্বেই সে মারা যাবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সে হয়ে ওঠে ব্রুস ওয়েনের পয়লা নম্বর শত্রু। পরবর্তী সময়ে রুপোলি পর্দায় জ্যাক নিকলসন থেকে হিথ লেজার হয়ে জোয়াকিন ফিনিক্সের হাত ধরে আপাত ভাবে মজার, কিন্তু অসম্ভব নিষ্ঠুর এক অপরাধী হিসেবে জোকার হয়ে উঠেছে সুপার ভিলেন। সেই তুলনায় লি আবির্ভূত হয় অনেক পরে, নয়ের দশকে। ব্যাটম্যানের অ্যানিমেটেড সিরিজে। সমাপতন হল, তাকেও মাত্র এক পর্বের বেশি ভাবা হয়নি। কালক্রমে সেও হয়ে ওঠে মহা-খলনায়িকা। কিন্তু সিনেমার লি চরিত্রটি এতদিনের চেনা হার্লে কুইনের মতো নয়। জোকারের 'প্রেমিকা' আদপে ছিল তারই মনোবিদ। পরে সে নিজের রোগীর কাউন্সেলিং করতে গিয়ে নিজেই হয়ে পড়ে অপরাধী! এই আখ্যান রুপোলি পর্দায় গ্রহণ করা হয়নি। এখানে সে আর্থারের অসংখ্য ফ্যানদের একজন। আর্খাম হাসপাতালে তার সঙ্গে আলাপ হয় জোকারের। সে বলে, ''ইউ ক্যান ডু এনিথিং। ইউ আর জোকার।''
একটা অদ্ভুত সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে দুজনের। সেই সম্পর্ককে নির্মাণ করতে গানের আশ্রয় নিয়েছেন টড। আর এখানেই ছবিটি চরিত্রগত ভাবে অনেকটাই আলাদা হয়ে যায় আগেরটির থেকে। গানের সংলাপের চমক ও অসাধারণ সব দৃশ্যায়ন মুগ্ধ করে। ফলে ধীরে ধীরে ছবিটি ঘিরে একটা প্রত্যাশা গড়ে ওঠে। মনে হয় যেন কোন গোপন বিস্ফোরণের প্রস্তুতি চলছে। বিস্ফোরণ অবশ্য একেবারে শেষে আক্ষরিক অর্থেই হয় (এর বেশি বললে স্পয়লার হয়ে যাবে)। কিন্তু তবুও এই ছবি যেভাবে অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্সের দিকে যায় তা শেষপর্যন্ত দর্শককে হতাশই করে।
অথচ এই ছবির বিপুল সম্ভাবনা ছিল। জোয়াকিন ফিনিক্স এবারও একাই একশো। সেই তুলনায় লেডি গাগা অনেকটাই নিষ্প্রভ। তবুও তাঁর সঙ্গে ফিনিক্সের রসায়ন ভালো লাগে। বাকি অভিনেতারাও সকলেই ভালো। কিন্তু ছবিটিকে শেষপর্যন্ত আটকে দেয় চিত্রনাট্য। বহু দৃশ্যই অযথা দীর্ঘ। সংলাপে ভারী বলে মনে হয়। ফলে দর্শক একটা সময় ক্লান্ত বোধ করতে থাকেন। ঠিক যেমন আর্থারও খানিক ক্লান্ত হতে থাকে জোকারের বেশে। প্রশ্ন ওঠে, ''হাউ অ্যাবাউট ইউ আর্থার? ডু ইউ স্টিল থিঙ্ক ইউ আর আ স্টার?'' ছবির শুরুতেই রয়েছে এক অনবদ্য অ্যানিমেশন। দেখা যায় জোকারকে দখল করে ফেলছে তারই ছায়া! গুলিয়ে যেতে থাকে কোনটা ছায়া, কোনটা আসল? কেন এই অ্যানিমেশন দিয়ে ছবি শুরু, তা ক্রমে পরিষ্কার হতে থাকে।
সমাজে হিংসা কীভাবে মহিমান্বিত হতে থাকে, তার গায়ে এসে পড়ে রঙিন আলো, সেই দিকটিকে জোরাল থাপ্পড় দিতে সক্ষম 'জোকার: ফোলি আ দ্যু'। ছবির একেবারে শেষের চমকটিও অপ্রত্যাশিত। তবু একটা কথা মনে হয়। সত্যিই কি প্রয়োজন ছিল এই সিকুয়েলের? প্রথম ছবির মেজাজ, বিষণ্ণতার পরত এখানেও রয়েছে। কিন্তু এই 'ক্যাথারসিস' দর্শকের চেনা। অতঃকিম? ছবিটি যেখানে পৌঁছে দেয় তা অপ্রত্যাশিত ছিল কি? শেষের চমকটি মেনে নিলেও সংশয় থেকে যায়।