shono
Advertisement

Breaking News

Frankenstein

পর্দায় ফিরল ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন ও তার দানব ‘সন্তান’! কেমন হল দেল তোরোর নতুন ছবি? পড়ুন রিভিউ

আধুনিক মানুষ ও তার অমরত্বের প্রত্যাশার কাহিনিকে কোন নতুন মাত্রা দিলেন পরিচালক?
Published By: Arani BhattacharyaPosted: 01:47 PM Nov 09, 2025Updated: 12:43 AM Nov 11, 2025

বিশ্বদীপ দে: ‘অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ’... কে দেবে আলো ও প্রাণ, প্রশ্ন করেছিলেন সত্যজিতের ‘আগ‌ন্তুক’ মনমোহন। ১৮১৮ সালে এক অষ্টাদশীও সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিলেন। খুঁজতে খুঁজতে রচনা করেছিলেন এমন উপন্যাস, যা আজও একই রকম প্রাসঙ্গিক। স্বপ্নের ভিতরে দেখেছিলেন ‘হলুদ, জলে ভরা, কৌতূহলোদ্দীপক চোখ’ নিয়ে তাকিয়ে থাকা এক মানুষকে। যে মৃত্যুর গভীর থেকে উঠে এসেছে প্রাণের উঠোনে। ভোর হতেই কলম টেনে নিয়ে মেরি শেলি নাম্নী সেই তরুণী সাদা পাতায় লিখে ফেলেছিলেন প্রথম বাক্যটি— ‘ইট ওয়াজ অন আ ড্রিরি নাইট অফ নভেম্বর...’ নাটক থেকে সিনেমা— নানা মাধ্যমে নানা ভাবে ফিরে ফিরে এসেছে ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন অর দ্য মডার্ন প্রমিথিউস’। এবার বিশ্বখ্যাত পরিচালক গিয়ের্মো দেল তোরো বানিয়েছেন তাঁর ছবি ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’। মুক্তি পেয়েছে ‘নেটফ্লিক্স’-এ। ‘পিনাক্কিও’কে তিনি নতুন রূপ দিয়েছিলেন। এবারও তেমনই কিছু করবেন সেই প্রত্যাশা নিয়ে দেখতে বসা ছবিটি। সেই প্রত্যাশা কি পূরণ হল?

Advertisement

এই ছবির সূচনা উত্তরমেরু অভিযানে বেরনো এক জাহাজ থেকে। যে জাহাজ আটকে পড়েছে বরফের ভিতরে। সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়াই যখন চ্যালেঞ্জ, সেই সময়ই ধেয়ে আসে নতুন বিপদ। বরফে পড়ে থাকা আহত অবসৃত ব্যারন ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনকে উদ্ধার করতেই হানা দেয় এক অতিকায় দানব! যে দানব আসলে ভিক্টরেরই ‘সন্তান’! অথচ  যাকে ‘ইট’ বলে সম্বোধন করে তার ‘বাবা’। হ্যাঁ, উপন্যাস থেমে গিয়েছিল সমুদ্রে দানবটির তলিয়ে যাওয়া নিয়ে। এখানে গল্প শুরুই হচ্ছে তার পরের সময় থেকে। দেল তোরোর বিশেষত্ব এটাই। শুরুতে সেই দানবের অসামান্য শক্তি দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আজকের উন্নত প্রযুক্তির ঝলকানি ও দেল তোরোর দুর্নিবার কল্পনাশক্তির মিশ্রণে তার ধ্বংসলীলাই হয়ে উঠতে পারত ছবির ইউএসপি। তবে তাহলে শেষপর্যন্ত তা হয়ে দাঁড়াত হাজার ছবির ভিড়ে মিশে থাকা এক সাধারণ হলিউডি ছবিমাত্র। কিন্তু... পরিচালকের নাম যে দেল তোরো। মেক্সিকোর এই পরিচালক জানেন ‘মনস্টার’-এরও হৃদয় আছে। ‘দ্য শেপ অব ওয়াটার’ কিংবা ‘পিনাক্কিও’ অথবা ‘হেলবয়’, বারে বারে ‘অবমানব’-এর মনের কথা তিনি কান পেতে শুনেছেন।

এই ছবিও কেবলই মূল টেক্সটকে অনুসরণ করে একটি কাহিনির চলচ্চিত্রে রূপান্তরে থেমে যায় না। বরং তা হয়ে ওঠে ভিক্টরের পাশাপাশি সেই দানবেরও আত্মকথা! ছবির শেষে ভিক্টরের ভাই দাদাকে বলে, ‘ইউ আর দ্য মনস্টার।’ কিন্তু কথাটা উচ্চারণের আগেই আমাদের মনের ভিতরে ভেসে ওঠে বহু আগে। ছবি যত এগিয়েছে কে যে দানব, কে যে আসলে সকলের ভালোবাসা-প্রত্যাশী সব গুলিয়ে দিয়েছেন দেল তোরো। ভিক্টর ছোটবেলায় বাবার নিষ্ঠুর অনুশাসনে বিদ্ধ হয়েছিলেন। স্নেহশীলা মায়ের মৃত্যু তাকে জগতের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলে অচিরেই। তাই কি সে হারিয়ে ফেলে প্রেম-প্রীতির প্রতি চিরন্তন বিশ্বাস?

উপন্যাসে গ্রামের এক বৃদ্ধের দানবের হাতে মৃত্যুর কথা আছে। এখানে সেই বৃদ্ধকে একেবারে অন্যভাবে নিয়ে এসেছেন পরিচালক। দৃষ্টিহীন সেই মানুষটির সংস্পর্শে দানবের আত্মজিজ্ঞাসা এক অন্য মাত্রা পায়। সে বুঝে যায় সে আসলে কেউ না। বহু ‘আমি’র সমষ্টি মাত্র। তাই কি তার স্বপ্নগুলো ছেঁড়া ছেঁড়া, বহু মানুষের স্বপ্নের কোলাজ হয়ে ওঠে? এক প্রাণের পক্ষে এর চেয়ে বড় যন্ত্রণা আর কী হতে পারে, যদি সে বুঝতে পারে আসলে তার অস্তিত্ব ল্যাবরেটরিতে এক পাগল বিজ্ঞানীর কৌতূহলী প্রয়াস মাত্র?

এই ছবির সংলাপও অসাধারণ এবং অব্যর্থ। দানব নিজের মতো করে জগৎকে বুঝে নিতে চেয়েছে। এই পৃথিবী যে আক্রান্ত ও ঘাতকের এক ধারাবাহিক ‘চেন’ দিয়ে গড়া... সে বুঝতে পারে। বলে, ‘‘একটা অনুভূতি আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। শিকারী নেকড়েকে ঘৃণা করে না। নেকড়েও ভেড়াকে ঘৃণা করে না। কিন্তু তাদের মধ্যে সহিংসতা অনিবার্য। আমি বুঝতে পারছি এটাই এই পৃথিবীর রীতি। তুমি যেমন, সেটার জন্যই তোমাকে শিকার করা হবে। হত্যা করা হবে।’’ যুদ্ধে বিদীর্ণ হতে থাকা এই পৃথিবীতে এমন সংলাপ বহুস্তরীয় মনে হতে থাকে। আরেক অংশে ভিক্টর দানবের উদ্দেশে বলে, ‘‘তোমার মাধ্যমে আমি এমন কিছু একটা সৃষ্টি করেছি যা সত্যিকারের ভয়ংকর।’’ প্রতিক্রিয়ায় দানব কেবল সংশোধন করতে চায় একটাই অংশ। ‘‘কিছু একটা নয়, কোনও একজন।’’ সে মানুষের সমান হওয়ার স্বীকৃতি চেয়েছে। আকুতি করেছে ভিক্টরের কাছে। এই দ্বন্দ্ব, এই সংঘাত বৈষম্যের পৃথিবীতে কেবল দানব ও তার স্রষ্টার দ্বন্দ্বমাত্র যে নয়, তা বোধহয় বলাই বাহুল্য। ‘অপর’-কে মনুষ্যেতর করে দেখার প্রয়াস সভ্যতার এক ভয়াল অসুখ দীর্ঘ সময় ধরেই।

ছবির বহু অংশ অস্বস্তিকর। ফাঁসির দৃশ্য হোক কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত সৈনিকদের লাশের স্তূপে ‘গবেষণার উপযোগী’ দেহ খোঁজা অথবা মৃতদেহে ছুরি চালিয়ে ‘ডিসেকশন’... উদাহরণ অসংখ্য। ইচ্ছে করেই দর্শককে এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যান দেল তোরো। সেই সঙ্গেই ধু ধু বরফ-সাদা প্রান্তর, গথিক দুর্গ— এই বিশালতা, শূন্যতাও এক অন্যতর প্রেক্ষাপট তৈরি করে। দেখতে দেখতে একটাই আফসোস হয়। এই ছবিটা কেন বড় পর্দায় মুক্তি পেল না এখানে (আমেরিকাতেও নামমাত্র হলে মুক্তি পেয়েছিল)? কিন্তু এটা সত্যিই ‘বিগ স্ক্রিন মুভি’। আশা রইল, কখনও যদি সেই সুযোগ আসে।

ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ভূমিকায় অস্কার আইজাক, দানবের ভূমিকায় জ্যাকব এলর্দি, এলিজাবেথের চরিত্রে মিয়া গথ মুগ্ধ করেন। দৃষ্টিহীন বৃদ্ধের ভূমিকায় ডেভিড ব্র্যাডলেও চমৎকার। ছবির আবহ অসামান্য। সম্পাদনাও নিপুণ। দেল তোরোর এই স্বপ্নের প্রোজেক্টে সকলেই যথাযোগ্য অবদান রেখেছেন।

এক আতঙ্কঘন অথচ বিষাদে ভরা আখ্যান লিখেছিলেন মেরি শেলি। অচিরেই তা হয়ে ওঠে ক্লাসিক। আধুনিক মানুষ ও তার অমরত্বের প্রত্যাশার এই কাহিনিকে নানা ভাবে ভেঙেচুরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে বহুবার। কিন্তু দেল তোরো যে কাজ করলেন তা সমস্ত ছবির ভিড়ে বিশেষ হয়ে থাকবে। এই ছবিও কাল্ট ক্লাসিক হয়ে উঠবে বলেই বিশ্বাস। যার কাছে আমাদের বারে বারে ফিরে আসতে হবে। যেভাবে ছবির শেষে সাদা বরফে ঝলসে ওঠা সূর্যের আলো মেখে নির্জন প্রান্ত থেকে জীবনের দিকে ফিরতে থাকে একাকী দানব। ছবির শেষেও সে সঙ্গে থেকে যায়। চলতে থাকে আমাদের সঙ্গেই। 

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • দুই শতক পেরনো কাহিনিটি নাটক থেকে সিনেমা— নানা মাধ্যমে নানা ভাবে ফিরে ফিরে এসেছে ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন অর দ্য মডার্ন প্রমিথিউস’।
  • এবার বিশ্বখ্যাত পরিচালক গিয়ের্মো দেল তোরো বানিয়েছেন তাঁর ছবি ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’।
  • মুক্তি পেয়েছে ‘নেটফ্লিক্স’-এ। ‘পিনাক্কিও’কে তিনি নতুন রূপ দিয়েছিলেন।
Advertisement