রাতে বিছানায় উঠে আসে বিষধর কালাচ৷ কেন ওঠে? গোখরো, কেউটের কামড়ে মৃত্যু হচ্ছে আকছার৷ আর যেন কারও প্রাণ না যায়৷ তবে সাপ মারবেন না৷ ওরা শত্রূ নয়৷ জেনে রাখুন বিষধরদের মতিগতি৷ সাপ কামড়ালে ঝাড়ফুঁক নয়, ‘রুল অফ ১০০’ জানলেই বাঁচা সম্ভব৷ কীভাবে? খোঁজ নিলেন গৌতম ব্রহ্ম৷
বর্ষাকাল মানেই সাপের উৎপাত৷ সর্পদংশনের ঘটনাও এই সময়ই বেশি হয়৷ পরিসংখ্যান বলছে, আমাদের দেশে প্রতিবছর সাপের কামড়ে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়৷ বেসরকারি মতে, সংখ্যাটা লক্ষাধিক৷ অথচ অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের দেশে থেকে অনেক বেশি বিষধর সাপ থাকলেও মৃত্যু হয় পাঁচবছরে সাকুল্যে দুই থেকে তিন জনের৷ আসলে আমাদের দেশে এখনও বহু মানুষ সর্পদংশনের পর ডাক্তারদের তুলনায় ওঝা, ঝাড়ফুঁকের উপর বেশি ভরসা রাখে৷ ফলে রোগী গুরুত্বপূর্ণ প্রথম কয়েক ঘণ্টা (গোল্ডেন আওয়ার) বিনা চিকিৎসায় নষ্ট হয়ে যায়৷ সমীক্ষা অনুযায়ী সাপে কাটা রোগীদের মধ্যে মাত্র ২২ শতাংশ সরকারি হাসপাতালে আসেন৷ জনমানসে ভ্রান্ত ধারণার ফলেও অনেক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে৷
ঘাতক
ভারতে প্রায় আড়াইশো প্রজাতির সাপ আছে, তার মধ্যে ৫২টি প্রজাতি বিষধর৷ এর মধ্যে ৪০টিরও বেশি প্রজাতির সাপ সামুদ্রিক৷ পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ছটি বিষধর প্রজাতির সাপ পাওয়া যায়৷ এর মধ্যে চারটি সাপের কামড়েই বেশি মৃত্যু হয়৷
গোখরো
ফণাধর ও নার্ভবিষযুক্ত৷ এদের ফণার পিছনে ইংরাজি ইউ অক্ষরের মতো একটি চিহ্ন থাকে৷ যাকে খড়ম চিহ্নও বলা হয়৷ এদের কামড়ে ক্ষতস্থানে প্রচণ্ড ব্যথা হয় এবং ক্রমাগত ফুলতে থাকে৷ এদের স্থানীয় নাম খরিস৷ এক ছোবলে ১৫ মিলিগ্রাম পর্যন্ত বিষ ঢালতে পারে৷
কেউটে
ফণাধর ও নার্ভবিষযুক্ত৷ এদের ফণার পিছনে থাকে পদ্মচিহ্ন৷ এদের স্থানীয় নাম আলকেউটে, কালকেউটে, শামুকভাঙা৷ বিষের মারণডোজ ১৫ মিলিগ্রাম৷
চন্দ্রবোড়া
এই সাপের বিষ রক্তকণিকা ধ্বংস করে৷ এটি বাংলার একমাত্র হিমোটক্সিক সাপ৷ এই সাপ সবথেকে বেশি প্রাণ কাড়ছে বাংলায়৷ সাপটি মোটা চেহারায়৷ বাদামি বা কাঠ রঙের৷ ফণাহীন সাপ৷ গায়ে চন্দন হলুদ চাকা চাকা দাগ৷ এরা কামড়ালে রোগীর রক্ততঞ্চনের গন্ডগোল হয়৷ চিকিৎসায় দেরি হলে রোগীর কিডনি নষ্ট হতে থাকে৷ মূত্রে রক্ত এসে যায়৷
কালাচ
এটি ভয়ংকর বিষধর৷ রহস্যময় সাপ৷ ফণাহীন মাঝারি চেহারার এই সাপটির গায়ের রং কালো, তার উপর সরু সরু সাদা ব্যান্ড৷ দিনের বেলা এদের প্রায় দেখাই যায় না৷ রাতে এরা খোলা বিছানায় উঠে আসে৷ কেন ওঠে তা আজও অজানা৷
এছাড়া আছে মারাত্মক বিষধর শাঁখামুটি সাপ৷ চেহারায় বেশ বড়৷ গায়ের রং উজ্জ্বল হলুদ আর কালোর উপর ব্যান্ড৷ এরা খুবই শান্ত প্রকৃতির৷ সাধারণত মানুষকে কামড়ায় না৷ গেছো বোড়ার মতো মৃদু বিষযুক্ত সাপ সুন্দরবনের বাদাবনে দেখা যায়৷ তবে এদের কামড়ে মৃত্যুর সম্ভাবনা নেই৷
বিষহীন সাপ
ঘরচিতি, কালনাগিনী, দাঁড়াশ, লাউডগা, তুতুর, লালবাড়ি বোড়া, বেত আছড়া, অজগর, জলঢোঁড়া, মেটেলি, জলমেটেলি৷
সামুদ্রিক সাপ
চ্যাপ্টা লেজের সামুদ্রিক সাপ ভীষণ বিষধর৷ এই ধরনের সাপ কামড়ালে প্রাণে বাঁচানো মুশকিল৷ এএসভি ইঞ্জেকশন এই সাপের কামড়ে কাজ করে না৷
প্রাথমিক চিকিৎসা
‘RIGHT’ ফর্মুলা মাথায় রাখতে হবে৷ R(Reassurance)–প্রথমে রোগীকে আশ্বস্ত করতে হবে৷ কারণ রোগী খুবই আতঙ্কের মধ্যে থাকেন৷ আতঙ্ক মৃত্যু ডেকে আনতে পারে৷ রোগীকে বোঝান সাপের কামড়ে আক্রান্ত বহু মানুষ চিকিত্সার ফলে বেঁচে উঠেছে৷ আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন৷
I(Immobilization)–যত কম নাড়াচাড়া হবে, তত কম হারে বিষ সারা শরীরে ছড়াবে৷ স্কেল বা বাঁশের টুকরো সহ হাতে বা পায়ে (যে অংশে কামড়াবে) কাপড় দিয়ে হাল্কা করে বেঁধে দিন৷ হাত বা পা যাতে তিনি ভাঁজ করতে পারেন তাই এই ব্যবস্থা৷
GH(Go to Hospital)–ফোন করে জেনে নিন আপনার নিকটতম হাসপাতালে এএসভি, নিওস্টিগনিন, অ্যাট্রোপিন এবং অ্যাড্রিনালিন আছে কি না৷ মাথায় রাখবেন, সাপের কামড়ের সম্পূর্ণ চিকিৎসা একটি ব্লক প্রাইমারি হেল্থ সেণ্টারেই সম্ভব৷
T(Tell Doctor For Treatment)–হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসককে সাপের কামড়ের চিকিৎসা করতে বলুন৷ রোগীর কথা জড়িয়ে যাওয়া, নাকি সুরে কথা বলা, চোখের পাতা পড়ে আসা এগুলি লক্ষ্য করতে চিকিৎসককে জানান৷
রুল অফ ১০০
সাপে কামড়ানোর ১০০ মিনিটের মধ্যে ১০০ মিলিলিটার এএসভি শরীরে প্রবেশ করালে রোগী বেঁচে যাবে৷
খেয়াল রাখুন, ডাক্তারকে বলুন
পথে আসার সময় কামড়ের জায়গায় ফোলা কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে৷ ঠিক কত সময় আগে রোগী বলছেন যে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে৷ কতক্ষণ পর্যন্ত রোগী কথা বলতে পেরেছেন৷
কী করবেন
- শান্ত থাকবেন
- কাছাকাছির মানুষজনকে ডাকবেন৷
- হাতে ঘড়ি বা চুড়ি, বালা থাকলে খুলতে হবে৷
- ক্ষতস্থান যত সম্ভব স্থির রাখতে হবে৷
- যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে যেতে হবে৷
কী করবেন না
- কোনওরকম বাঁধন দেবেন না৷
- কামড়ের জায়গায় কোনও কেমিক্যাল লাগাবেন না৷
- কামড়ের স্থানে ঠান্ডা, গরম, বরফ জল দেবেন না৷
- কেটে চিরে বিষ বের করার চেষ্টা করবেন না৷
- মনে রাখবেন, সাপ যখন কামড়ায় তার বিষ দাঁতের মাধ্যমে ইঞ্জেকশনের মতো শরীরের ভিতরে চলে যায়৷ বিষ পাম্প বলে একরকম অবৈজ্ঞানিক বস্তু প্রয়োগ করে ভোজবাজি দেখানো হচ্ছে৷ এগুলি সব অর্থহীন৷ উল্টে চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ের পর ক্ষতস্থান চিরলে মারাত্মক রক্তপাত হতে পারে৷
- রোগী নিজে দৌড়ে বা সাইকেল চালিয়ে আসবেন না৷
- সাপ ধরে হাসপাতালে আনার দরকার নেই৷
সাপ ঠেকাবেন কীভাবে?
- বাড়ির চারপাশ পরিচছন্ন রাখুন৷ কার্বলিক অ্যাসিড শরীরে লাগলে ক্ষতি হয় তাই ব্যবহার না করাই ভাল৷ চুনের সঙ্গে ব্লিচিং পাউডার মিশিয়ে ছড়িয়ে দিন৷ এর ঝাঁঝালো গন্ধে সাপ আসে না৷
- রাতে অবশ্যই বিছানা ঝেড়ে মশারি টাঙিয়ে শোবেন৷ দরজা-জানলার নিচে ফাঁকা জায়গা কাপড় গুঁজে ভরাট করে রাখতে পারেন৷
- অন্ধকারে হাঁটাচলা করবেন না৷ হাতে লাঠি নিয়ে রাস্তা ঠুকে চলুন৷ হাততালি দিয়ে লাভ নেই, কারণ সাপের কান নেই৷
- জুতো পরার আগে সেটা ঝেড়ে নিন৷ মাটির বাড়িতে ইঁদুরের গর্ত থাকলে তা বুজিয়ে ফেলুন৷
তথ্যসাহায্য- ডা. কৃষ্ণাংশু রায়, অধিকর্তা, ইনস্টিটিউট অফ হেলথ অ্যান্ড ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার ও সৌম্য সেনগুপ্ত, স্কুল শিক্ষক৷
এই রোগ ও তার প্রতিকার সম্বন্ধে আরও জানতে ক্লিক করুন epaper.sangbadpratidin.in
The post সাপের কামড়? ‘রুল অফ ১০০’ জানলেই বাঁচা সম্ভব appeared first on Sangbad Pratidin.