দেশে কি জ্ঞানীগুণী মানুষ কম পড়েছে? একজন বিজ্ঞানী, একজন ইতিহাসবিদ, একজন প্রখ্যাত চিকিৎসক, ভারতীয় ক্রিকেটের একজন জীবন্ত কিংবদন্তি, একজন অলিম্পিকে সোনাজয়ী ক্রীড়াবিদ, একজন সফল শিল্পপতি, শ্রেষ্ঠ একজন অভিনেতা, একজন ঔপন্যাসিক, একজন বীরাঙ্গনা নারী কি ১৩৫ কোটির দেশে পাওয়া গেল না- যাঁরা রাজদণ্ড হাতে প্রধানমন্ত্রীর দু’-পাশে হাঁটতেন? কলমে কিংশুক প্রামাণিক
ইতিহাসকে হয়তো সাময়িক বিকৃত করা যায়। কিন্তু ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না। ভারতের ইতিহাস নতুন করে লেখার চেষ্টা হচ্ছে। গান্ধীর আততায়ী নাথুরাম গডসের পুজো আগেই শুরু হয়েছিল। এবার হিন্দুর বাইরে আর কোন ধর্ম, বিশেষ করে মুসলমান শাসকদের শৌর্য এ-দেশে ছিল, তা আগামী প্রজন্মকে জানাতে চায় না কেন্দ্রের শাসক। তাই সিলেবাস বদল। মুঘল সাম্রাজ্যের কথা বেমালুম চেপে দেওয়া হবে পাঠ্যে। এমনকী, বাদ চলে যাবে ডারউইনের তত্ত্বও!
নাম বদলও ইতিহাস বিকৃতির আরেক পন্থা। বিখ্যাত রেলস্টেশন মুঘলসরাই হয়েছে পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়। আপত্তি যখন ‘মুঘল’-এ তখন, মোগলাই পরোটারও নতুন নাম ভাবা
যেতে পারে।
কাজটা শুরু হয়েছিল অটলবিহারী বাজপেয়ীর সময়। সিলেবাস বদল করার লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালে ক্ষমতায় এসেই ‘ন্যাশনাল কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক’ সংশোধন করে বিজেপিশাসিত কেন্দ্রীয় সরকার। তবে নরেন্দ্র মোদির আমলে যে-দ্রুতির সঙ্গে ইতিহাস মোছার কাজ অহর্নিশ চলছে তা দেখে প্রশ্ন জাগে, শাসক কি জানে না- অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ হয় না? এটা ঘোড়ার গাড়ি অথবা হাতির পিঠে উঠে যুদ্ধের যুগ নয়। ইন্টারনেট-মোবাইলে ডুবে মানুষ ব্রহ্মাণ্ডকে জয় করার স্বপ্ন দেখে। এখন গাঁয়ের গৃহবধূরও হাতের মুঠোয় পৃথিবী। মেসি-রোনাল্ডোরা এসে বসেছেন ড্রয়িং রুমে। কোটি কোটি চোখ নজর রাখছে একে-অপরকে। আজকের যুগে সোনার কেল্লাকে ‘ভ্যানিশ’ বললেই ভ্যানিশ করা যায় না।
ভারত এক অদ্ভুত দেশ। এত বৈচিত্র আর কোনও দেশে নেই। যুগ যুগ ধরে ‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান’। ভারতীয় সভ্যতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে কবির সারকথা, ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’।
[আরও পড়ুন: দেশজুড়ে ‘কোটা’র নামে রাজনীতি, ‘হাঁড়িকাঠে’ মণিপুর]
ভক্তি ও সুফি আন্দোলন এ দেশে সমান তালে চলেছিল। অশোক থেকে আকবর- সম্রাটের মর্যাদা নিয়ে কালের ইতিহাস গড়েছেন। অজন্তার কারুকার্য থেকে তাজমহল শ্বেতশুভ্র শোভা বিশ্বকে বিস্মিত করেছে। রবীন্দ্রনাথের পাশে বসে সাম্যের গান গেয়েছেন নজরুল। দেশকে গর্বিত করেছেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু থেকে বিজ্ঞানী এ. পি. জে. আবদুল কালাম। এমন বহুত্ববাদের দেশের কোন ইতিহাস আপনি চেপে দেবেন মশাই! যত লুকবেন তত ফাঁস হবে। ভারতের সুপ্রাচীন ইতিহাস আরব থেকে আসা ধ্বংসাত্মক বাহিনী মুছতে পারেনি। আজকেও সিলেবাস থেকে মুঘল সাম্রাজ্য বাদ দিলে লালকেল্লার ইতিহাস মোছা যাবে না।
‘বন্দে মাতরম্’-এর সঙ্গে একই সুরে উচ্চারিত হয় ‘সারে জাহা সে আচ্ছা।’ আপনি ইকবালকে বাদ দিলেও সেই গান রয়ে যাবে। ইতিহাস কালের গর্ভে বিরাজমান। তাকে মুছতে গেলে মুখ পুড়বে।
যুগে যুগে ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে একনায়কতান্ত্রিক শাসকরা। হিটলার জার্মানির অনার্যদের অধিকার কেড়ে নিতে কড়া আইন করেছিলেন। ইতিহাস তাঁকে ক্ষমা করেনি। মুঘলরা এদেশে এসে বংশবিস্তার করে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলে হাজার হাজার বছরের প্রাচীন ভারতীয় হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতাকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। শুধু মন্দির ধ্বংস নয়, ধর্মান্তরকরণের মধ্য দিয়ে সমাজকে হিন্দুশূন্য করার চেষ্টা করেছিলেন বাবর থেকে ঔরঙ্গজেব। মারাঠা-সহ বহু দেশীয় রাজার সঙ্গে মুঘলদের যুদ্ধ হয়েছে। কেউ বশ্যতা স্বীকার করেছেন, কেউ করেননি। ক্রমে মুঘলরা দেশ দখল করলেও হিন্দুত্বকে খতম করতে পারেনি। প্রায় পৌনে দুশো বছর তারা রাজত্ব করেছিল। আজ মুকুট পড়ে আছে, রাজা-ই শুধু নেই। দিল্লি-আগ্রায় অজস্র মুঘল সৌধ রয়েছে। সম্রাটরা কবরে ঘুমচ্ছেন। ইতিহাস কিন্তু জেগে আছে।
লুঠেরা বক্তিয়ার খলজি আসার আগে হিন্দু ও বৌদ্ধ সংস্কৃতি ছিল ভারতীয়ত্বের পরম্পরা। ১২০০ খ্রিস্টাব্দের পর হিন্দু মন্দির ও বৌদ্ধ বিহারগুলি গুঁড়িয়ে দিতে থাকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা লুণ্ঠনকারীরা। সুলতান মামুদ, নাদির শাহ, কালাপাহাড়-সহ অনেকেই তাণ্ডব চালান হিন্দু স্থাপত্যে। সোমনাথ থেকে দ্বারকা, অযোধ্যা থেকে পুরীর জগন্নাথ মন্দির বারবার আক্রান্ত হয়েছে। কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির ভেঙে যে মসজিদ তৈরি হয়েছিল, তা বাবা বিশ্বনাথ দর্শনে গেলে আজও বোঝা যায়। রামের মন্দিরের উপরই যে বাবরি মসজিদ তৈরি হয়েছিল, সে রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
খলজি বাহিনী আসার আগে ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের ‘স্বর্ণযুগ’ ছিল। সম্রাট অশোক থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যর আমল ছিল বিত্তশালী, বর্ণময়। শিক্ষার প্রচার ও প্রসার ছিল প্রচুর। নালন্দা, বিক্রমশীলা, তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ব এশিয়া থেকে ছাত্ররা পড়তে আসত। পরিব্রাজক হিউয়েন সাংয়ের বর্ণনা থেকে সমৃদ্ধির তথ্য জানা যায়। একসঙ্গে হাজার হাজার ছাত্রের থাকার ব্যবস্থা ছিল নালন্দায়। ছিল লক্ষাধিক বই-পুঁথি। সেই গর্ব ধুলোয় মিশিয়ে দিতে নালন্দায় আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। শোনা যায়, এক বছর পরও নালন্দার আগুন নেভেনি। কিন্তু তাতে ইতিহাস হারিয়ে যায়নি। বিকৃত করা যায়নি নালন্দার ঐতিহ্য। হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস একদিন পুনর্জাগরিত হয়েছে।
ব্রিটিশদের স্টাইল ছিল ভিন্ন। ইতিহাস বিকৃতির চেয়েও তাদের নজর ছিল লুঠপাট, ব্যবসায়। পলাশির যুদ্ধে সিরাজকে পরাজিত করে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’-র আধিপত্য কায়েম হয়। ইউরোপীয় কালচার ও ব্রিটিশ আইন ভারতীয়দের উপর চাপাতে শুরু করে তারা। ১৯০ বছর ধরে তারা রাজত্ব করে। হয়তো পরিকাঠামো উন্নয়নে ব্রিটিশরা বিরাট কাজ করে গিয়েছে। খণ্ড ভারতকে তারা সীমানা দিয়ে এক করেছিল। কিন্তু তাতে ভারতের মূল ভাবধারা, পরম্পরা, স্থানীয় গুরুত্ব, ইতিহাস থেকে মুছে যায়নি।
বিজেপি নেতারা কি সেই ইতিহাস পড়েছে? যেভাবে তারা এই দেশের সুপ্রাচীন অধ্যায়ের একটি অংশকে মুছে নতুন করে ইতিহাস লেখার চেষ্টা করছে তা কি মানুষ গ্রহণ করছে?
আসলে বিষয়টি তা নয়। সবটাই ভোটকৌশল। মেরুকরণ যতদূর সম্ভব নিয়ে যাওয়া। তাই নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন ঘিরে প্রধানমন্ত্রী যা করলেন, সেটা খানিক ইচ্ছা করেই। দেখালেন: ভারত মানেই হিন্দুত্ব।
দেশে কি জ্ঞানীগুণী মানুষ কম পড়েছে? একজন বিজ্ঞানী, একজন মহাকাশ গবেষক, একজন ইতিহাসবিদ, একজন প্রখ্যাত চিকিৎসক, ভারতীয় ক্রিকেট দলের একজন জীবন্ত কিংবদন্তি, একজন অলিম্পিকে সোনাজয়ী ক্রীড়াবিদ, একজন সফল শিল্পপতি, শ্রেষ্ঠ একজন অভিনেতা, একজন ঔপন্যাসিক, একজন বীরাঙ্গনা নারী, একজন প্রতিকূলতাকে জয় করে শিখরে পৌঁছনো মানুষ কি ১৩৫ কোটির দেশে পাওয়া গেল না যাঁরা রাজদণ্ড হাতে প্রধানমন্ত্রীর দু’-পাশে হাঁটতেন?
যে দৃশ্যে ভারতীয় গণতন্ত্র উদ্ভাসিত হত। নরেন্দ্র মোদির নামে সব অপবাদ ধুয়েমুছে যেত। তামাম বিশ্বকে তিনি দেখিয়ে দিতে পারতেন, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রে সমগ্র দেশবাসীর কাছে
‘আমি তোমাদের লোক’।
তথাপি নতুন ভবনকে কুম্ভমেলার রূপ দেওয়ার একটাই কারণ- মেরুকরণ। যে-পথ ধরে আর কিছুদিন পর রাম মন্দিরের উদ্বোধন। সেই হিন্দুত্বকে পাথেয় করে ভোটে জিততে ইতিহাস বিকৃতি। তাই মোছামুছি এখন চলবে। বামিয়ানের পাথরের গুহা থেকে বুদ্ধদেবকে উপড়ে ফেলার মতো মুছে দেওয়া হবে মুঘল, সুলতান আমলের কথা। শাসকের যখন ক্ষমতা আলগা হয় তখন তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তাতে কিছু যায়-আসে না। ব্রিটিশদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নির্বাসন থেকে মুক্তি পাওয়া সাভারকরের জন্মদিনে নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন হলেও তিনি কখনও মোহনদাস হতে পারবেন না। ভুলে গেলে চলবে না
‘জয় শ্রীরাম’-এ উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের যত মানুষ পদ্মফুলে ভোট দেয়, তার দ্বিগুণ মানুষ গান্ধীর নামে নতমস্তক হয়। যিনি মৃত্যুর শেষ মুহূর্তে বলেছিলেন ‘হে রাম’। এই ফারাক থাকবে। ইতিহাসের বেঁচে থাকার সংগ্রামও থাকবে। কিছুই ভুলিয়ে দেওয়া যাবে না। শাসক বদল হলে মুছে যাওয়া ঘটনাক্রম ফিরে আসবে। অতীত বলছে, ইতিহাস তার দেওয়ালে সব লিখে রাখে।
(মতামত নিজস্ব)