যাঁরা দুর্গাপূজায় অসমর্থ, তাঁরাই কি বেছে নিয়েছিলেন জগদ্ধাত্রীর পূজা? পুরাণপথে, দার্শনিক মতে আর এই বঙ্গের জগদ্ধাত্রী পূজার ইতিহাসের নিরিখে উত্তর খুঁজলেন অনির্বাণ চৌধুরী
Advertisement
দেবীর নামটি কী? না, জগদ্ধাত্রী দুর্গা- ‘জয় সর্বগত দুর্গে জগদ্ধাত্রি নমোহস্তুতে’! জগদ্ধাত্রীও নয়, দুর্গাও নয়, দুইয়ে মিলেই দেবীর স্বরূপে প্রকাশ। তা-ই যদি হয়, জগদ্ধাত্রীকে বলতে হবে দেবী দুর্গারই অন্য রূপমহিমা? সেই সূত্র ধরেই সিদ্ধান্তে আসতে হবে- যাঁরা দুর্গাপূজা করে উঠতে পারেন না বা কোনও কালে পেরে ওঠেননি, তাঁরাই বেছে নিয়েছিলেন জগদ্ধাত্রী আরাধনার পথ ও পন্থা?
দুর্গার সঙ্গে জগদ্ধাত্রীর এই বিকল্পের সংযোগ বুঝতে গেলে আমাদের একবার ভাল করে তাকাতে হবে দেবীর দিকে। তখন আমরা ধ্যানমন্ত্র অনুসরণ করে দেখব- এই মহাদেবী জগদ্ধাত্রী সিংহের স্কন্ধে আরূঢ়া, নানা অলঙ্কারে ভূষিতা ও নাগরূপ যজ্ঞোপবীতধারিণী। দেবীর বাম হস্তদ্বয়ে শঙ্খ ও শার্ঙ্গধনু, দক্ষিণ হস্তদ্বয়ে চক্র ও পঞ্চবাণ। রক্তবস্ত্রপরিহিতা সেই ভবসুন্দরী প্রভাতসূর্যের ন্যায় রক্তবর্ণা। নারদাদি মুনিগণ তাঁর নিত্যসেবা করে থাকেন- “সিংহস্কন্ধসমারূঢ়াং নানালঙ্কারভূষিতাম্/চতুর্ভুজাং মহাদেবীং নাগযজ্ঞোপবীতিনীম্/শঙ্খশার্ঙ্গসমাযুক্তবামপাণিদ্বয়ান্বিতাম্/চক্রঞ্চ পঞ্চবাণাংশ্চ দধতীং দক্ষিণে করে/রক্তবস্ত্রাপরিধানাং বালার্কসদৃশীতনুম্/নারদাদ্যৈর্মুনিগণৈঃ সেবিতাং ভবসুন্দরীম্।”
দুর্গার সঙ্গে সংযোগটি তাহলে কোথায়? এ তো যেমনটি মূর্তিতে দেখে থাকি, প্রায় তেমন রূপবর্ণনাই! দুর্গার সঙ্গে জগদ্ধাত্রীর সংযোগ তাই যদি মন্ত্রের সূত্র ধরে খুঁজতে হয়, তবে তাকাতে হবে জগদ্ধাত্রীস্তোত্রের দিকে। তার তিন নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে- “জয়দে জগদানন্দে জগদেক প্রপূজিতে/জয় সর্ব্বগতে দুর্গে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে।” আবার কিছু কিছু পুরাণ বলছে, মহিষাসুর বধের পর দেবতাদের উল্লাসের কথা। তাঁরা ভেবেছিলেন, দুর্গা যেহেতু তাঁদেরই সম্মিলিত শক্তির প্রকাশ, তাই অসুর বধ হয়েছে তাঁদেরই যুগ্ম শক্তিতে। ব্রহ্মার বরের সম্মানরক্ষা করতে কেবল ওই নারীদেহটির আবশ্যিকতা। তাঁদের ওই গর্ব দেখে পরমেশ্বরী দেবী একটি তৃণখণ্ড অলক্ষ থেকে নিক্ষেপ করলেন দেবতাদের দিকে। পরীক্ষা করতে চাইলেন তাঁদের শক্তি। ইন্দ্র বজ্রদ্বারা সেই তৃণটি ধ্বংস করতে ব্যর্থ হলেন। অগ্নি সেই তৃণ দহন করতে পারলেন না, বায়ু অসমর্থ হলেন তা উড়িয়ে নিয়ে যেতে। বরুণের শক্তি সেই তৃণটুকুর একটি অংশও জলস্রোতে প্লাবিত করতে পারল না। দেবতাদের এই দুরবস্থা দেখে তাঁদের সামনে আবির্ভূতা হল এক পরমাসুন্দরী সালঙ্কারা চতুর্ভুজা মূর্তি। তিনিই জগদ্ধাত্রী। জগদ্ধাত্রী এভাবে আবির্ভূতা হয়ে দেবতাদের জ্ঞানচক্ষুটি উন্মীলিত করলেন। বুঝিয়ে দিলেন, তিনিই এই জগতের ধারিণী শক্তি।
এই একই গল্প আমরা কেন উপনিষদ এবং কাত্যায়নীতন্ত্রেও দেখব। তফাতের মধ্যে কেন উপনিষদে দেবী প্রথমে দেখা দিয়েছিলেন এক যক্ষের বেশে। আর স্বরূপে আবির্ভূতা হওয়ার পর তাঁর নাম জানা গিয়েছিল উমা হৈমবতী। মহিষাসুর বধের কোনও প্রসঙ্গ সেখানে নেই। আবার, কাত্যায়নী তন্ত্রে উমা বা জগদ্ধাত্রী- কোনও নামটিই পাওয়া যায় না। সেখানে দেবী কেবল হৈমবতী অর্থাৎ স্বর্ণালঙ্কারভূষিতা। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই উমা নামটির সূত্র ধরেই উপনিষদের গল্পটি গৃহীত হল অনেক পরে লেখা নানা পুরাণে। এবং, জগদ্ধাত্রীস্তোত্রের দুর্গা নামটির সূত্রে এল মহিষাসুর বধের প্রসঙ্গ।
কিন্তু, কোথাও খুব একটা স্পষ্ট করে বলা হল না জগদ্ধাত্রী দুর্গারই বিকল্প রূপ। কেন না, যে দেবী দেবতাদের গর্ব খর্ব করার জন্য রূপধারণ করলেন, উপনিষদ তাঁকে আদিশক্তিরূপেই ব্যাখ্যা করছে। পুরাণেও দুর্গার আবির্ভাবের আগে বেশ কয়েকবার এক দেবীর উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে যিনি বিষ্ণুমায়া বা বৈষ্ণবী শক্তি হিসেবেই সুপরিচিতা। বিষ্ণুর মতো জগদ্ধাত্রীর হাতেও রয়েছে শঙ্খ এবং চক্র, অতএব এই দেবীর বিষ্ণুমায়া হওয়াটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। আবার, বিষ্ণুর মতোই তিনিও ধারণ ও পালন করেন এই বিশ্ব। তাহলে?
জগদ্ধাত্রী যে দুর্গারই বিকল্প রূপ, তার প্রথম সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া গেল শ্রীশ্রীচণ্ডীতে এসে। সেখানে বলা হল, যুদ্ধের সময় মত্ত মহিষাসুর নানা মায়ারূপ ধরে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন দেবীকে। একবার সেই প্রচেষ্টায় মহিষাসুর ধারণ করেন হস্তীরূপ। সেই হস্তী দেবীকে বধের চেষ্টা করলে দুর্গা ধারণ করেন এক চতুর্ভুজা মূর্তি। চক্রদ্বারা তিনি ছেদন করেন হাতির শুঁড়টি। সেই রূপটিই জগদ্ধাত্রীর। সেই জন্যই ধ্যানমন্ত্রে কোথাও উল্লেখ না থাকলেও মূর্তিতত্ত্বে আমরা দেখছি, জগদ্ধাত্রী বাহন সিংহ এক হস্তীর মৃত শরীরের উপর দাঁড়িয়ে। কখনও বা সেই সিংহ খেলা করে হস্তীর কাটা মাথা নিয়ে। সংস্কৃতে হাতির একটি নাম করী, সেই অনুসারে অসুরটির নাম করীন্দ্রাসুর। তাকে বধ করেন বলে জগদ্ধাত্রীর অপর নাম করীন্দ্রাসুরনিসূদিনী।
এভাবেই খুব ধীরে ধীরে জগদ্ধাত্রীর আদি মহিমা থেকে সরে এলাম আমরা। তিনি সত্ত্বগুণের প্রতীক, তাই প্রথম সূর্যের মতো তাঁর গায়ের রং। অর্থাৎ, দেবীর গাত্রবর্ণটি কমলা। কিন্তু, দুর্গার সঙ্গে তাঁর সংযোগ স্থাপন করে আমরা বর্তমানে তাঁর মূর্তিটি নির্মাণ করি তপ্তকাঞ্চনবর্ণ বা কাঁচা সোনার রঙে। কমলা রঙের জগদ্ধাত্রী প্রতিমা বর্তমানে এই বঙ্গে দুর্লভ। আবার কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর হুতোম প্যাঁচার নকশায় লিখছেন, সেই সময়ের বাবু কলকাতা দুর্গার মতো জগদ্ধাত্রী মূর্তিতেও স্থান দিয়েছে লক্ষ্মী-সরস্বতীকে- “বারোইয়ারি প্রতিমাখানি প্রায় বিশ হাত উঁচু– ঘোড়ায় চড়া হাইল্যান্ডের গোরা, বিবি, পরী ও নানাবিধ চিড়িয়া, শোলার ফল ও পদ্ম দিয়ে সাজানো; মধ্যে মা ভগবতী জগদ্ধাত্রী-মূর্তি– সিঙ্গির গায়ে রূপুলি গিলটি ও হাতী সবুজ মখমল দিয়ে মোড়া। ঠাকরুণের বিবিয়ানা মুখ, রং ও গড়ন আদল ইহুদী ও আরমানী কেতা, ব্রহ্মা বিষ্ণু, মহেশ্বর ও ইন্দ্র দাঁড়িয়ে জোড়হাত ক’রে স্তব কচ্চেন।”
এই যে শুরু হল দুর্গার বিকল্প রূপে জগদ্ধাত্রীর আরাধনা, কালে কালে তা-ই জনপ্রিয় হল বঙ্গে। যার হোতা নিঃসন্দেহেই নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। কেন না, দুর্গাপূজা করতে অসমর্থ হয়ে বিকল্পে জগদ্ধাত্রী আরাধনা বঙ্গে প্রথম প্রচলন করছেন তিনিই। কাহিনি বলছে, তখন বঙ্গের তখতে আসীন নবাব আলিবর্দি খাঁ। তাঁর রাজত্বকালে রাজার কাছ থেকে বারো লক্ষ টাকা নজরানা দাবি করা হয়। কৃষ্ণচন্দ্র তা দিতে অস্বীকার করলে তাঁকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয় মুর্শিদাবাদে। ছাড়া পেয়ে রাজা যখন নদিপথে কৃষ্ণনগরে ফিরছেন, শুনতে পেলেন বিসর্জনের বাজনা। ভারাক্রান্ত হল তাঁর মন- এ বছর আর দুর্গাপুজো করা হয়ে উঠল না! জনশ্রুতি, সেই রাতেই রাজাকে স্বপ্নে দর্শন দেন জগদ্ধাত্রী। তাঁর পূজার নির্দেশ দেন যা দুর্গাপূজারই সমতুল! সেই ১৯৬৬ সাল থেকে কৃষ্ণনগরে দুর্গাপুজোর বিকল্পর হিসেবে প্রচলিত হল জগদ্ধাত্রীর পূজা। চন্দননগরেও সেই দৃষ্টান্ত অনুসরণ। কৃষ্ণচন্দ্রের পূজায় অনুপ্রাণিত হয়ে ফরাসিদের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরি শুরু করলেন তৎকালীন ফরাসডাঙা বা অধুনা চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পূজা। যা পরে বিকল্প এক উৎসবের আকার নিল।
আবার, এক দেবীর পূজায় অসমর্থ হয়ে জগদ্ধাত্রী আরাধনার প্রচলন দেখা যায় সারদামণির বংশেও। শোনা যায়, সারদামণির মা শ্যামাসুন্দরী দেবী প্রতি বছর প্রতিবেশি নব মুখুজ্যের বাড়ির কালীপুজোয় চাল পাঠাতেন। একবার ঝগড়ার জন্য মুখুজ্যেরা সেই চাল নিতে অস্বীকার করেন। শ্যামাসুন্দরীকে সেই রাতেই স্বপ্নে দর্শন দেন জগদ্ধাত্রী। ওই চালে তাঁর পূজার নির্দেশ দেন। সেই থেকে জয়রামবাটীতে সারদামণির বংশে জগদ্ধাত্রী পূজা বিখ্যাত।
তবে এই বিকল্প পূজার সূত্রে আরও কিছু সময় পিছিয়ে গিয়ে একবার জগদ্ধাত্রী আরাধনার দিকে দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে। সেই ইতিহাস বলছে, জগদ্ধাত্রী পূজা প্রথমে কট্টর ভাবেই প্রচলিত ছিল ব্রাহ্মণদের মধ্যে। দেবী সত্ত্বগুণের প্রতীক যা ব্রাহ্মণদের একটি বৈশিষ্ট্য বলে গণ্য করা হয়। দেবীর গলায় থাকে নাগযজ্ঞোপবীত যা স্পষ্টভাবেই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের পরিচায়ক। আবার, মন্ত্রে এই দেবীকে সাক্ষাৎ ব্রাহ্মণ বলেও অভিহিত করা হয়েছে। এখান থেকেই তৈরি হয়েছে বিকল্প এবং শ্রেণিবিভাগ। সত্ত্বগুণধারিণী জগদ্ধাত্রীর পূজা করবেন ব্রাহ্ণরা, রজোগুণধারিণী দুর্গার পূজা ক্ষত্রিয়রা এবং তমোগুণধারিণী কালীর পূজা অন্যরা। পরে ব্রাহ্মণদের এই জগদ্ধাত্রী আরাধনার সূত্রটি গ্রহণ করলেন বণিকশ্রেণি। দুর্গাপূজায় তাঁদের অধিকার নেই, কালীপূজা তন্ত্রসম্মত বলে সবার সামর্থ্য নয়, অতএব রইলেন কেবল এই জগদ্ধাত্রী দুর্গাই!
সেই ইতিহাস বহন করেই এখনও দুর্গাপূজার উৎসবের বিকল্প হিসেবেই জগদ্ধাত্রীর পূজার উৎসব দেখছি আমরা। সেই জন্যই এই পুজো সর্বজনীন হল না। রয়ে গেল কিছু কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলের উৎসব হয়েই।
নিজেই ভেবে দেখুন না, কৃষ্ণনগর-চন্দননগরের বাসিন্দা না হলে কি জগদ্ধাত্রী পুজোয় ততটাও আনন্দ করি আমরা?
The post দুর্গাপুজো করতে না পারার খেদ থেকেই কি জন্ম নিল জগদ্ধাত্রী পূজা? appeared first on Sangbad Pratidin.