ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়: বইয়ে আমরা ছবি দেখেছি এদের। আকবরি মোহর বা জাহাঙ্গিরের রুপি। ইতিহাসবিদদের লেখায় মেলে বিবরণ। কিন্তু একসঙ্গে এই সব বিরল মুদ্রা দেখতে পাওয়ার সুযোগ এবার কলকাতাতেই। শুক্রবার থেকে শুরু হল কলকাতার নিউমিসম্যাটিক সোসাইটি বা মুদ্রা পরিষদের বিরল মুদ্রা প্রদর্শনী। উত্তর-পূর্ব শহরতলির শ্রীভূমির কাছে চলছে এই মুদ্রা উৎসব। চলবে রবিবার পর্যন্ত। সামান্য কিছুটা ঘুরেই যে খাজানার খবর পাওয়া গেল তাতে দেখা গেল শুধু আকবর একা নয়, প্রদর্শনীতে হাজির সমুদ্রগুপ্ত, কনিষ্কের আমলের স্বর্ণমুদ্রাও। তবে সমুদ্রগুপ্তের বঙ্গবিজয়ের স্মারক মুদ্রা নিঃসন্দেহে এই প্রদর্শনীর অন্যতম সেরা আকর্ষণ। রয়েছে আলেকজান্ডারের স্বর্ণমুদ্রা, যা বিরলের মধ্যে বিরলতম।
ওই মুদ্রা আসলে মোহর। যেখানে রয়্যাল বেঙ্গল শিকারের ভঙ্গিতে রয়েছেন সমুদ্রগুপ্ত। রয়েছে বহুল প্রচারিত বিনাবাদনরত ভঙ্গির মুদ্রাও। সব ক'টিরই মূল্য ওই একই ধরনের। এছাড়া রয়েছে আকবরি মোহরও! মুঘল আমলে ১১.৬৬ গ্রাম ওজনের একটি রুপোর মুদ্রাকে এক রুপি বা রুপে বলা হত। এমন ১৫টি রুপির বিনিময় মিলত একটি মোহর। যার মাঝখানে খোদিত রয়েছে মুঘল বাদশার পুরো নাম। জালালুদ্দিন মহম্মদ আকবর বাদশাহ গাজি। উত্তরপ্রদেশের জৌনপুর টাঁকশালে তৈরি ২৬.৩৯ মিলিমিটারের সেই মোহরের ওজন ১০.৮৮ গ্রাম। দাম আড়াই লক্ষ টাকা। শীতের সন্ধ্যার উষ্ণতা বাড়াতে শহরে হাজির এমন গোছা গোছা স্বর্ণমুদ্রা।
আকবরের শাসনে সুবে বাংলার প্রথম রুপোর মুদ্রা
তবে প্রদর্শনীতে দেখা মিলল বিরলের মধ্যে বিরলতম আলেকজান্ডারের স্বর্ণমুদ্রা। প্রাচীন ভারত যখন আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, আলেকজান্ডার সে সময় ভারত-বিজয় করেছিলেন আফগানিস্তান থেকেই। সম্রাট শখ করে একটা মুকুট বানিয়েছিলেন হাঁ-করা সিংহের মুখের খোলস ও চামড়া দিয়ে। সেই চেহারার স্বর্ণমুদ্রাও বানিয়েছিলেন তিনি। যার মূল্য ১০ লক্ষ টাকা। পেশায় চিকিৎসক মুদ্রা-সংগ্রাহক ডা. উজ্জ্বল সাহার খাজানায় এমন অন্তত ১২-১৪ রকমের মোহর। সব মিলিয়ে মূল্য দেড় কোটি টাকা।
আবার ‘সুবে বাংলায়’ যখন আকবরি শাসনকাল শুরু হল সে সময় থেকে একাধিক রুপোর মুদ্রা চালু হয়েছিল। আকবর ছাড়াও শাহজাহান, জাহাঙ্গির, আবার সিরাজের আমলেও বদলে বদলে এসেছে নানা মুদ্রা। বাংলাদেশ থেকে পাটনা পর্যন্ত তৎকালীন বৃহৎ বাংলাই ছিল সুবে বাংলা। শৌভিক মজুমদারের সংগ্রহে রয়েছে সেই এলাকার নানা সময়ে বাংলার নানা এলাকার টাঁকশালে তৈরি হওয়া অসংখ্য মুদ্রা। শৌভিক জানাচ্ছেন, সম্রাট আকবর মান সিংহকে বাংলার শাসনে পাঠিয়েছিলেন। সেটা ১৫৫৬ সালের আশপাশে। গঙ্গা তীরবর্তী ফারাক্কার উত্তরের অংশটুকুকেই সে সময় বলা হত ‘বঙ্গ’। সেই নামে হল বঙ্গ টঁাকশাল। সেখানে তৈরি হওয়া মুদ্রাই চালু হয় আকবরি রূপি নামে।
এতসব বহুমূল্য মুদ্রা সংগ্রহে রাখতে আইনের প্যাঁচে পড়তে হয় না? সোসাইটির সচিব রবি শর্মা জানাচ্ছেন, “এটা বিরাট সমস্যা ছিল এক সময়। এইসব ঐতিহাসিক মুদ্রার মতো সম্পদ এক সময় ছিল অ্যান্টিকুইটি অ্যাক্টের অধীনে। কারও সংগ্রহে এসব আছে জানা গেলে তার মাল বাজেয়াপ্ত হত। এই ভয়ে এমন মোহর কেউ পেলে আইনের হাত থেকে বঁাচতে সেসব গলিয়ে সোনা বের করে নিত। তাতে তো ইতিহাসের ক্ষতি।” তারপরই পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে বলে জানাচ্ছেন তিনি। এখন প্রাচীন মুদ্রা আর সেই আইনের আওতায় নেই। ফলে সংগ্রাহকরাও মনের আনন্দে সেসব সঙ্গে রাখেন, বেচা-কেনা করেন, প্রদর্শনী হয়।
