কৃষ্ণকুমার দাস: এই মন্দিরে সেই কাপালিক থাকতেন। সঙ্গে থাকতেন তাঁর পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলাও (Kapalkundala)।
–ঠিক এই, এইখানটাতেই নবকুমারকে বেঁধে রাখা হয়েছিল।
–ওই যে দরজা দেখছেন, ওখান দিয়েই নবকুমারকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন কপলাকুণ্ডলা।
বক্তা ভূদেব জানা। স্থান, উত্তর কাঁথির (North Kanthi) প্রত্যন্ত গ্রাম দরিয়াপুর। সময় রবিবার পড়ন্ত বিকেলের আধো আলো আধো ছায়া। সামনে দাঁড়িয়ে শ্রোতা তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ (Kunal Ghosh) ও দলের শ্রমিক শাখার রাজ্য সভাপতি ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্যসভার দুই প্রাক্তন সাংসদ।
কাঁথির পেটুয়াঘাট মৎস্যবন্দরের জনসভা সেরে ফেরার পথে জাতীয় সড়ক ছেড়ে আচমকাই গ্রামে ঢুকে পড়েন কুণাল ঘোষ। সঙ্গে ঋতব্রত। গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে চায়ের দোকানে জানতে চান, কপালকুণ্ডলা মন্দির যাব কোন পথে? মাঝবয়সি দোকানি উঠে এসে পালটা সৌজন্য দেখিয়ে বলেন, গ্রামের ভিতর এগিয়ে যান। ঢালু পথ ধরে খানিকটা হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন গাছপালা ঘেরা কপালকুণ্ডলার মন্দিরে। আরও রোমাঞ্চিত হয়ে পা চালিয়ে গ্রামের ছায়াঘেরা সরু পথ ধরেন কুণালরা। হাঁটতে হাঁটতে ঋতব্রত বলেন, ‘‘গায়ে হালকা জ্বর আছে। তবু কুণালদার কাছে বিষয়টি শুনে আসার লোভ সামলাতে পারলাম না।’’ পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেন দুই প্রাক্তন সাংসদ।
[আরও পড়ুন: পুরনো মামলায় পুলিশি হেফাজত, এখনই অনুব্রতকে দিল্লি নিয়ে যেতে পারছে না ইডি]
–একটু আগেই তো আপনাকে টিভিতে দেখলাম। এখন দেখছি সামনে। কী ব্যপার এখানে কেন? পথ চলতে চলতে মধ্যবয়স্ক এক গ্রামবাসীর কৌতূহলি প্রশ্ন কুণালকে।
–এই তো মন্দির দেখতে এলাম। আর আপনাদের গ্রাম তো ঐতিহাসিক! স্মিত হেসে উত্তর দেন কুণাল।
গ্রামের আঁকাবাকা ঢালু পথ ধরে বড় বড় গাছপালায় ঘেরা পুরনো দিনের পাতলা পোড়া ইটের কাঠামোয় পৌঁছে যান দুই প্রাক্তন সাংসদ।
সামনেই সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (Bankim Chandra Chattopadhyay) মূর্তি। রাস্তার বাঁদিকে কাপালিকের সেই মন্দির, কপালকুণ্ডলার বাসস্থান। আগে মন্দিরে দেবী চণ্ডীর মূর্তি ছিল, এখন নেই। ওই মূর্তিতেই তন্ত্রসাধক কাপালিক পুজো করতেন। অমাবস্যার রাতে নিকটবর্তী মোহানায় যজ্ঞ করতেন বলে স্থানীয়দের বিশ্বাস। এখনও জঙ্গলের মাঝে নিঝুমপুরীর হাতছানি ঘেরা ওই জরাজীর্ণ কাঠামোর প্রতিটি খাঁজে ইতিহাস কথা বলে। চারপাশে পুরো গা-ছমছমে পরিবেশ। সামান্য কিছু কাজ হলেও অধিকাংশ অংশই ভগ্নপ্রায়। চত্বরে পা রাখতেই প্রায় মাটি ফুঁড়ে উঠে আসার মতো হাজির আশি ছুঁই ছুঁই বর্ষীয়ান এক বাসিন্দা। পরে নাম জানা যায় তিনিই ভূদেব জানা, মন্দির-বাড়ির অলিখিত গাইড। হতদরিদ্র, ছিন্নবস্ত্রে শীতে শরীর ঢেকে রেখেছেন তিনি। জীবন্ত কাহিনি বর্ণনা করার ফাঁকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখান বাড়ি ও মন্দিরের পথ। দেখিয়ে দেন, কোন দরজা দিয়ে বাঁধন খুলে নবকুমারের হাত ধরে গভীর রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গিয়েছিলেন কপালকুণ্ডলা।
–দরিয়াপুরের এই বাড়ি থেকেই কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের জন্ম দেন বঙ্কিমবাবু। অথচ আজ উপেক্ষিত, কাপালিকের মন্দির-বাড়ি পুরোপুরি অনাদৃত। ক্ষোভ ঝরে পড়ে ভূদেব জানার গলায়।
–কপালকুণ্ডলা তো উপন্যাসের চরিত্র। এসব তো গল্প। কপালকুণ্ডলা, কাপালিক, নবকুমারকে বেঁধে রাখা, এসব তো উপন্যাসের চরিত্র? বৃদ্ধকে কৌতূহলি প্রশ্ন কুণালের।
–মোটেই না, ভাল করে খোঁজ নিন। আমরা নিশ্চিত, এখানেই কাপালিক ও তাঁর পালিতা কন্যা থাকতেন। নবকুমারও এখানে এসেছিলেন। তাঁদের জীবন নিয়েই তো বঙ্কিমবাবু লিখেছেন। আত্মবিশ্বাসী স্বর ভূদেব জানার।
–সাহিত্যের চরিত্র এমনভাবে মেলে না কি? পাশে দাঁড়ানো ঋতব্রতকে প্রশ্ন করেন কুণাল। (পাশ থেকে কান খাড়া করে শুনে নেন ভূদেব জানা)
–না, না বাবু, আপনারা একদম গল্প বলে উড়িয়ে দেবেন না। গ্রামের সব মানুষ জানে, বঙ্কিমবাবু এখানে এসে তিনদিন থেকে কাপালিকের সঙ্গে কথা বলেই তো সব কথা লিখেছেন। গলার স্বর একটু চড়িয়ে বলেন বৃদ্ধ।
–আপনার কথা অবিশ্বাস তো করিনি, আমরা নিজেদের মধ্যে কপালকুণ্ডলা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। স্মিত হেসে জবাব দেন তৃণমূল মুখপাত্র।
[আরও পড়ুন: অবৈধ বালি পাচার রুখতে গিয়ে আক্রান্ত ভূমি দপ্তরের আধিকারিকরা, হামলা পুলিশের গাড়িতেও]
কথা শুনতে শুনতে গোটা বাড়ি ও মন্দির চত্বর ঘুরে দেখছিলেন কুণালরা। ততক্ষণে আশপাশের গ্রামবাসীরা অনেকেই ভিড় জমিয়েছেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, মেদিনীপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন একটি ডাকাতি মামলায় তদন্ত করতে এই দরিয়াপুরে এসেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। দিন কয়েক ছিলেন পাশেই এক পরিচিতের বাড়িতে। তখন এই মন্দির থেকে কাছেই ছিল সমুদ্রের মোহানা। রাতে নেগুয়া (স্থানীয় নাম) ও কাঁথি থেকেও সমুদ্র গর্জন শোনা যেত। পর পর তিনদিন বঙ্কিমবাবুর সঙ্গে দেখা করেন কাপালিক। প্রস্তাব দিয়েছিলেন, রাতে মোহানার বালিয়াড়িতে হোমযজ্ঞে গিয়ে অংশ নিতে। তন্ত্রসাধক কাপালিক চলে যাওয়ার পরেই আবার সন্ধ্যার আঁধার নামতে সাদা শাড়ি পরা ঘোমটা দেওয়া এক মহিলা এসে দেখা করতেন সাহিত্যসম্রাটের সঙ্গে। তিনিও একান্তে কথা বলে যেতেন।
তবে কেনই বা তান্ত্রিক রাতে মোহানার হোমযজ্ঞে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করেছিলেন বঙ্কিমবাবুকে তা যেমন রহস্যাবৃত। বালিয়াড়িতে পুজোর নাম করে বঙ্কিমবাবুকে নিয়ে যাওয়ার পিছনে কী কোনও অসৎ উদ্দেশ্য ছিল তান্ত্রিকের? আবার ওই সাদা শাড়ি পরা অজ্ঞাতমহিলার ব্যস্ত হয়ে আগমন। তবে কি সাদা শাড়ি পরিহিতা রহস্যময়ী নারী কোন অজ্ঞাত ভয়ংকর কারণের কথা বলে সন্ধ্যায় এসে সাহিত্যসম্রাটকে সতর্ক করেছিলেন? মন্দিরের চারপাশের শ্বাপদসংকুল জলজঙ্গল পেরিয়ে দু’জনের আগমনের কোনও উদ্দেশ্যই আজও জানা যায়নি। প্রেক্ষাপট ও কপালকুণ্ডলা চরিত্র নিয়ে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সম্পূর্ণ রোমান্টিক উপন্যাস লিখলেও কোথাও সাহিত্যসম্রাট এই দু’জনের সাক্ষাতের রহস্য ভেদ করেননি। দেড়শো বছরের বেশি প্রাচীন মন্দির নিয়ে স্থানীয়দের এমন নানা কাহিনি থাকলেও অবশ্য কোনও প্রামাণ্য দলিলও নেই।
মন্দির চত্বরে ততক্ষণে গ্রামবাসীদের ভিড় জমে গিয়েছে কুণাল-ঋতব্রতদের ঘিরে। অনেকেই টিভির দৌলতে চিনতে পেরেছেন তৃণমূল মুখপাত্রকে। বস্তুত সেই কারণে অনেক গ্রামবাসী মন্দিরটি সংরক্ষণ ও রাস্তাঘাটের উন্নয়নের দাবি করেন দুই প্রাক্তন সাংসদের কাছে। জানান, ‘‘সরকার নয়, প্রতিবছর চৈত্রমাসের শেষ সপ্তাহে কপালকুণ্ডলার স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে ওই গ্রামে বঙ্কিম মেলার আয়োজন করেন গ্রামবাসীরাই।’’ স্বভাবতই রোমাঞ্চিত ও শিহরিত কুণাল ঘোষ। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম মাইলস্টোনে দাঁড়িয়ে কপালকুণ্ডলা মন্দিরটি নিয়ে সরাসরি ফোন করেন রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারম্যান আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বিষয়টি শুনে আলাপনবাবু জানান, গোটা বিষয়টি নিয়ে তিনি রিপোর্ট নিচ্ছেন জেলাশাসকের কাছে। তারপর বাংলা সাহিত্যের এক অমর সৃষ্টির গর্ভগৃহ সংরক্ষণ নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন। রাস্তা সংস্কার নিয়ে জেলাপরিষদের বর্তমান সভাধিপতি উত্তম বারিককে ফোন করেন তৃণমূল মুখপাত্র। তিনিও রাস্তা মেরামতি নিয়ে আশ্বস্ত করেন কুণালকে।
গোধূলি পেরিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসে জঙ্গলে ঘেরা দেড়শো বছরের প্রাচীন জীর্ণ মন্দিরের দেওয়ালে। দূরে তুলসীতলার প্রদীপ জ্বালিয়ে সন্ধ্যা দিয়ে শঙ্খধ্বনি শোনাতে শুরু করেন গ্রামের নারীরা। ঢালু পথ ধরে ফেরার পথ ধরেন কুণাল-ঋতব্রতরা। কানে তখনও তাঁদের বারে বারে বাজছে নবকুমারের উদ্দেশে কপালকুণ্ডলার সেই আচমকা প্রশ্ন, ‘‘পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?”