বুদ্ধদেব সেনগুপ্ত, সবরমতী: বাপু বন্দি আশ্রমেই। সঙ্গী শুধু স্বচ্ছ ভারত অভিযান। ‘জাতির জনক’ মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (Mohandas Karamchand Gandhi)। দেশজুড়ে যাঁর কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে থাকার কথা ছিল। দিন যতে গড়াচ্ছে, তিনিই কিনা কার্যত বন্দি হচ্ছেন রাজনীতির কারাগারে। সবরমতী (Sabarmati) নদীর ধারে গড়ে ওঠা বাপুর আশ্রমে এখন শুধুই দর্শনার্থীদের আনাগোনা। সুবিশাল ঝাঁ চকচকে আশ্রমের চারিদিকে তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে কাঁচের ‘শো কেসে’ কিছু ছবি ও ছাপার অক্ষরে কিছু লেখালেখি। ব্যস, এখানেই শেষ!
হারাতে বসেছে আশ্রমের ঐতিহ্য। নেই শিক্ষানবিশদের ভিড়। মহাত্মাকে জানতে বছরভর ছুটে আসা ছাত্রছাত্রীরা। এমনকী বিদেশি গবেষকদের সংখ্যাও কমছে। চমকে উঠতে হয় দর্শনার্থীদের মতামত লিখে যাওয়ার খাতায় চোখ রাখলে। আশ্রমের ট্রাস্টি ও কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে যাওয়া একাধিক মতামত। বাপুকে কেন আশ্রমে বন্দি করে রাখা হচ্ছে? সেই প্রশ্নও রেখে গিয়েছেন অনেক দর্শনার্থী। যদিও কোনও এক অজানা ভয়ে মুখে কুলুপ ট্রাস্টিদের। গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র-সহ উত্তর ও পশ্চিম ভারতে বাপু, নেতাজি (Netaji Subhash Chandra Bose) আর বল্লভভাই (Ballav Vai Patel) প্যাটেলকে নিয়ে যে রাজনীতি শুরু হয়েছে, তা কী ঠিক? শুনেই চুপ আশ্রমের এক আধিকারিক। তবে প্রকাশ্যেই ক্ষোভ জানাচ্ছেন দর্শনার্থীরা।
[আরও পড়ুন: ভারতের সাধারণতন্ত্র দিবসে প্রথমবার প্রধান অতিথির আসনে মিশরের প্রেসিডেন্ট]
স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব (Azadi Ka Amrit Mahotsav) পালন হচ্ছে দেশজুড়ে। ‘হর ঘর তিরঙ্গা’র ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। রাজধানী দিল্লি থেকে বাপুর আশ্রম আমেদাবাদ। মোদির ডাকে সাড়া দিতে প্রায় সব বাড়ির ছাদে পতপত করে উড়ছে জাতীয় পতাকা। কিন্তু রাজনীতির জাঁতাকলে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী। তার প্রভাব সবরমতীতেও, গান্ধী আশ্রমে। দর্শনার্থীদের মতামত লিখে নেওয়ার দায়িত্বে আশ্রমের গেটে বসে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মচারি জানালেন, প্রতিদিন দর্শনার্থীর সংখ্যা কমতে কমতে এখন হাতে গোনা কয়েকজনে দাঁড়িয়েছে। বিদেশির সংখ্যাও কমছে। আসলে মানুষের মন থেকে মহাত্মাকে ভুলিয়ে দেওয়ার প্রবল প্রচেষ্টায় বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার। মনে করছেন দর্শনার্থীদের একাংশ। মহারাষ্ট্রের নাসিক থেকে শুধুমাত্র বাপুর টানে জনা চল্লিশেক প্রতিবেশীকে নিয়ে সবরমতীতে ছুটে এসেছেন ইতিহাসের প্রাক্তন অধ্যাপক অরুণপ্রসাদ টবুলি।
ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে জানান, দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে যাঁরা মহান ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের মধ্যে কখনই তুলনা টানা ঠিক নয়। গান্ধী, নেতাজি বা বল্লভভাই প্যাটেল–প্রত্যেকের অবদান রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার যে তুলনা টানা শুরু করেছে, তার বিরোধিতা করতে হবে প্রত্যেক দেশবাসীকে। এই নিয়ে সাতবার আশ্রমে এসেছেন। পরিবর্তন যে হচ্ছে, তা সহজেই মালুম হচ্ছে। আগে প্রতিদিনই আশ্রমে কিছু না কিছু অনুষ্ঠান হত। এখন একাকী হয়ে পরছেন জাতির জনক। পরিবার নিয়ে এসেছেন ওড়িশার বাসিন্দা মনোহর জানা। তাঁর মত, রাজনীতি করে জাতির জনককে মানুষের মন থেকে মুছে দেওয়া যায় না। এই সরল সত্যটা গেরুয়ার ঠিকা নেওয়া নেতারা যত তাড়াতাড়ি বোঝেন, ততই মঙ্গল।
[আরও পড়ুন: ৫০০ টাকার নোট সরিয়ে ২০ টাকা! খোদ রেলকর্মীর ‘হাতসাফাইয়ের’ ভিডিও ভাইরাল]
ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য নীতিন শুক্লাকে ফোন করলে কথা বলতেই রাজি হননি তিনি। আশ্রমের কার্যালয়ে থাকা আধিকারিক সুরজ প্যাটেল জানান, ওপর থেকে যেমন নির্দেশ আসে তেমনভাবেই চলতে হয়। বাপুর জন্মদিবসে সকাল থেকে ভিভিআইপিদের ভিড়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত ছিল। শ্রদ্ধা জানাতে হাজার হাজার মানুষ লাইন দিয়ে আশ্রমে এসেছিলেন বলে জানান। আর সেদিনই দেশজুড়ে স্বচ্ছ ভারত (Swachh Bharat Abhiyan) অভিযান করা হয়েছিল। আশ্রম আগের মতোই প্রাণচঞ্চল রয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। কিন্তু দর্শনার্থীদের স্পষ্ট কথা–রাজনীতির ফাঁসে আটকে পড়েছেন জাতির জনক।