shono
Advertisement

‘অখণ্ড ভারত’ কি খণ্ড-খণ্ড হবে, মণিপুরে কোন ভবিষ্যতের ইঙ্গিত?

মণিপুর আসলে একটি নমুনা। দৃষ্টান্ত। মডেল। কীসের?
Posted: 12:38 PM May 27, 2023Updated: 12:38 PM May 27, 2023

মণিপুর আসলে একটি নমুনা। দৃষ্টান্ত। মডেল। কীসের? না, বিজেপির ‘অল ইন্ডিয়া’ প্রোটোকল, তথা সংখ‌্যালঘুর উপর সংখ‌্যাগুরুর আধিপত‌্যকায়েমির। খুদে রাজ‌্যটিতে মেইতেই ও নাগা-কুকিদের তীব্র সংঘাত, কারফিউ, থামতে না-চাওয়া অশান্তি বুঝিয়ে দিচ্ছে- সারা দেশে চাপিয়ে দেওয়া সংখ‌্যাগরিষ্ঠতাবাদের ফলে কীভাবে এই ‘অখণ্ড ভারত’ খণ্ড-খণ্ড হয়ে যেতে পারে। কলমে জয়ন্ত ঘোষাল

Advertisement

 

ত্তর-পূর্ব ভারতের ছোট্ট রাজ‌্য মণিপুর। ১৯৪৭ সালে মণিপুর স্বাধীন রাজ‌্য হিসাবে আত্মপ্রকাশের ইচ্ছা প্রকাশ করে। পাশে বর্মার (বর্তমান মায়ানমার) আগ্রাসী মনোভাবে ’৪৯ সালে রাজা বোধচন্দ্র সিংহ ভারত অন্তর্ভুক্তির সম্মতিপত্রে সই করেন। ১৯৫৬ সালে এটি কেন্দ্রশাসিত রাজ‌্য হয়। ১৯৭২ সালে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পায়।

মণিপুর এখন অশান্ত, হিংস্র। সেখানকার ‘মেইতেই’ সংখ‌্যাগরিষ্ঠ উপজাতির তফসিলি জাতির স্বীকৃতির দাবি নিয়ে আন্দোলন ওই ছোট্ট রাজ্যে নাগা-কু‌কি জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে পালটা প্রত‌্যাঘাতের জন্ম দিয়েছে। অতএব, রক্তাক্ত লড়াই। কারফিউ। পুলিশের গুলি। দিল্লির যন্তরমন্তরে মেইতেই হিন্দু-বৈষ্ণব গোষ্ঠীর নজরকাড়া আন্দোলন, নাগা-কুকিদের বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপের শ্রীবৃদ্ধি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, হাই কোর্টের রায়ের জন‌্যই নাকি এত ঝামেলা।

হাই কোর্ট কী করেছে, হাই কোর্ট ক্রমবর্ধমান মেইতেইদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে সেখানকার বিজেপি সরকারকে অবিলম্বে তা বাস্তবায়িত করার নির্দেশ দিয়েছে। দর্শন ও ইতিহাস বলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই এমনি-এমনিই হয় না। মণিপুরের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিরও সকারণ পটভূমি আছে। মণিপুরের ঘটনা দিয়েই সমগ্র দেশে সংখ‌্যাগরিষ্ঠতাবাদের আধিপত‌্যকামিতার সম্ভাব‌্য ভয়াবহ পরিণতির কথা আলোচনা করতে চাই। মণিপুর একটি নমুনা। দৃষ্টান্ত। মডেল। এই ছোট রাজ্যের থামতে না-চাওয়া অশান্তি দেখে বুঝতে সুবিধা হয়- দেশে চাপিয়ে দেওয়া সংখ‌্যাগরিষ্ঠতাবাদের ফলে কীভাবে এই ‘অখণ্ড ভারত’ খণ্ড-খণ্ড হয়ে যেতে পারে।

[আরও পড়ুন: ‘বন্ধু’ বাংলাদেশে গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে কেন নারাজ মোদি সরকার?]

১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চল বলতে সাধারণত তিনটি রাজ‌্যকে বোঝাত: নেফা-সহ অবিভক্ত অসম, অন‌্য দুই রাজ‌্য ত্রিপুরা ও মণিপুর। পরে অসম ভেঙে চারটি উপজাতি রাজ‌্য সৃষ্টি হয়। নাগ‌াল‌্যান্ড (১৯৬৩), মেঘালয় (১৯৭২), মিজোরাম (১৯৮৭), অরুণাচল প্রদেশ (১৯৮৭)। পরে সাত বোনের সঙ্গে ‘সিকিম’ নামে আর-এক বোনের নাম পরিবারে যুক্ত হয়। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পার্বত‌্য এলাকাকে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা করার ব্রিটিশ পরিকল্পনা নেওয়া হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। তৎকালীন বড়লাট লর্ড ওয়াভেল উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড় এলাকা আর ব্রহ্মদেশকে নিয়ে ব্রিটিশ ‘ক্রাউন কলোনি’ তৈরির ‘ব্লু প্রিন্ট’ তৈরি করেন। এই ব্লু প্রিন্ট নিয়ে ওয়াভেল লন্ডনে যান। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, তখনই ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারছিল সম্ভবত ভারত তাদের ছাড়তেই হবে। তার আগে সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই সীমান্ত এলাকায় যাতে তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে সে চেষ্টা তারা করে।

তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অ‌্যাটলির নেতৃত্বে ‘লেবার পার্টি’ লন্ডনে ক্ষমতায় আসে, আর মাউন্টব‌্যাটেন গুরুত্বপূর্ণ ব‌্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। তিনি ক্রাউন কলোনিকে পরিত‌্যক্ত করে ধর্মের নামে ভারতকে খণ্ডিত করার নতুন প্রকল্প গ্রহণ করেন। উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও সাম্রাজ‌্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু অটুট থেকে যায়।

মোদ্দায়, আটটি রাজ‌্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছাতার তলায় থাকলেও এই আট বোন একজন অন্যজনকে ভাল করে জানে না। ত্রিপুরা বিশ্ববিদ‌্যালয়ের মহাত্মা গান্ধী অধ‌্যাপক ড. মহাদেব চক্রবর্তী এই অঞ্চলের বিভিন্ন রাজ‌্য নিয়ে গবেষণা করেন। ‘উত্তর-পূর্ব ভারত- সেদিন ও আজ’-এ (প্রথম খণ্ড) মহাদেববাবু লেখেন, ১৯৬৭ সালে চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনের সময় ‘মৈতেয়ি স্টেট কমিটি’ নামে এক রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম হয় যার প্রধান দাবি ‘স্বাধীন মণিপুর’।

সুনীতি চট্টোপাধ‌্যায়ের ‘কিরাত জন-কৃতি’ বই থেকে জানা যায়, এত ছোট রাজ্যের মধ্যে এত অল্প মানুষের মধ্যেও কতরকমের ধর্মীয় ভেদাভেদ। ‘মেইতেই’ শব্দটির উৎস: ‘মেই’: বর্মি ভাষায় মানুষ, আর ‘তাই’: থাই জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠী চিনের মধ‌্যাঞ্চল থেকে এসেছিল। সাতটি আলাদা গোষ্ঠীর মানুষ মিলেমিশে তৈরি হয় ‘মেইতেই’। তারা হল মইরাং, নিংথৌজা, অঙ্গম, চেংলি, নাংগবা, লায়াং এবং খুমন বা খুমল। আর একটা মত হল, দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড়রা এসে ব্রহ্মদেশ আর নাগা পাহাড়ের মধ‌্য দিয়ে পৌঁছে মণিপুরে ‘মেইতেই’ নাম ধারণ করে। এই এলাকাকে বলা হত: কিরাত ভূমি।

তখন মণিপুরের রাজবংশেও নাগা প্রভাব ছিল খুব বেশি। মণিপুরে বিষ্ণুভক্ত বিষ্ণুপ্রিয়ারা ছিল। এদের মধ্যে আর্য সংস্কৃতি ছিল, মেইতেইদের মধ্যে ছিল কুকি-চিন গোষ্ঠীর সম্পর্ক। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মহারাজা গরিব নওয়াজ-এর এর রাজত্বকালে শান্তিদাস গোস্বামী মেইতেইদের বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা দিয়ে হিন্দু ধর্মের আওতায় নিয়ে আসে। তখন অবশ‌্য মেইতেই আর বিষ্ণুপ্রিয়াদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

মণিপুরি মানে ছিল মেইতেই ও বিষ্ণুপ্রিয়া; মেইতেইরা তবু বিষ্ণুপ্রিয়াদের বলত ‘মায়াং’ বা বহিরাগত। তামিলনাড়ুতে দ্রাবিড় কাঝাগাম ও দ্রাবিড় মুনেত্রা কাঝাগাম স্বাধীন দ্রাবিড় স্থানের দাবিতে সংস্কৃতায়নকে পুরোপুরি নস‌্যাৎ করতে চায়। কিন্তু মণিপুরে মায়াং-বিরোধী আন্দোলন ছিল বিষ্ণুপ্রিয়াদের বিরুদ্ধে, কিন্তু আস্তিক হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এই আন্দোলনকারীরা রাজার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে বৈষ্ণববিরোধী হয়ে যায়। রাজবাড়ি সংলগ্ন গোবিন্দজির মন্দির ভাঙা হয়।

আন্দোলনকারীরা স্থানীয় অতীতের মেইতেই দেবতা সনমাহি রাধা-কৃষ্ণকে উৎখাত করতে চায়। সময়ের হাত ধরে এই উপজাতি গোষ্ঠীর জীবনযাত্রাতেও অনেক পরিবর্তন আসে। মণিপুরে ১৬টি জেলা। এর মধ্যে ৩৪টি ছোট-বড় নানা জনগোষ্ঠী। তবে মেইতেইরাই সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী। মোট জনসংখ‌্যার শতকরা ৫৩ ভাগ তারাই। মূলত সমতলে থাকে। আর্থ-সামাজিক দিক থেকেও বেশি এগিয়ে। এদের মধ্যে একতা থাকলেও আজ নাগা-কুকিরা পাহাড় এলাকায় বেশি। তারা বেশিরভাগ সংখ‌্যালঘু খ্রিস্টান। আর, মেইতেইদের মধ্যে উপজাতি ডিএনএ থাকলেও এখন এরা হিন্দু ধর্মের ছাতার তলাতেই আছে। ব্রিটিশ জমানায় খ্রিস্টান হয়ে যাওয়ার সংখ‌্যাও অনেক।

এখন সারা দেশে ওবিসি আন্দোলন নিয়ে নানা বিতর্ক জায়মান, ভারতের জনসংখ‌্যায় ‘ওবিসি’ বা তফসিলি নিম্নবর্গ আসলে কত তা প্রকাশ করার জন‌্য বিরোধীদের অনেকেই দাবি করছেন।

এমতাবস্থায় মণিপুরে সর্বভারতীয় দল বিজেপি ক্ষমতাসীন। মেইতেই সংখ‌্যাগরিষ্ঠ জনসমাজ বিজেপির ভোটব‌্যাংক ছিল। নাগা-কুকিরা মূলত পাহাড়বাসী খ্রিস্টান সংখ‌্যালঘু হতে পারে হাই কোর্ট এই দাবি সমর্থন করায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে গিয়েছে। মেইতেই বনাম নাগা-কুকি, সংখ‌্যাগরিষ্ঠ বনাম সংখ‌্যালঘু, হিন্দু বনাম খ্রিস্টান, দেশীয় এবং বহিরাগত-সংঘাত নানা স্তরে বিপজ্জনক রূপ নিয়েছে। মুখ‌্যমন্ত্রী বীরেন সিংহ এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেও চূড়ান্ত ব‌্যর্থ।

আসলে প্রশ্নটি প্রশাসনিক বীরত্বর নয়। মূল শিক্ষা হল- ভারতের বহুত্ববাদী, গণতন্ত্রকামী, রাজনৈতিক সংস্কৃতির ঐতিহ‌্যকে রক্ষা করতে হবে। অতীতের ভারতেও ঐক‌্যর শক্তির পাশাপাশি বিভাজনের শক্তিও ছিল ভয়াবহভাবে। সেদিনও ব্রিটিশ সাম্রাজ‌্যবাদী শক্তি বিভাজনের সুযোগ নিয়েছে। এখন শুধু দেশীয় রাজনীতিতেও তা ব‌্যবহার করা হচ্ছে- এটাই দুঃখ।

 

(মতামত নিজস্ব)

[আরও পড়ুন: কর্ণাটকের সহজপাঠ, দুর্নীতিতেই ধাক্কা খেয়েছে ব্র্যান্ড মোদি]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement