শংকর: আমার ছাত্রাবস্থায় দু’জন সুভাষ-পাগল মানুষ দেখেছিলাম, একজন হাওড়ার হেজোদা (অধ্যাপক অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়), আরেকজনও হাওড়ার- শঙ্করীপ্রসাদ বসু। শেষজন বলতেন, “স্বামী বিবেকানন্দকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিলেন সুভাষচন্দ্র, তারই পরিণতি ‘নেতাজি’। আমি যদি স্বামীজির মায়ামোহে না পড়তাম, তাহলে সুভাষই হতেন আমার অবলম্বন।” এই বলে, সুভাষ ও সমকালীন ভারত সম্বন্ধে বিরাট এক ধারাবাহিক রচনা শঙ্করীদা শুরু করেছিলেন, অধুনালুপ্ত এক সাপ্তাহিক পত্রিকায়। আমার প্রাথমিক শিক্ষার জন্য শঙ্করীদা আমাকে একখানি ‘ইন্ডিয়ান পিলগ্রিম’ উপহার দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘তোর জন্য দুঃখ হয়, সুভাষ-কালে জন্ম নিয়েও তো সুভাষ বোসকে চোখে দেখলি না। তোর ভাগ্য ভাল, ওঁর দাদা শরৎ বোস ইংরেজের জেল থেকে বেরিয়ে হাওড়ায় এলেন, তাঁকে দেখলি। তোর তো আরও ভাগ্য, সুভাষ বোস যেবার বনগাঁ গিয়েছিলেন, তোর দাবি, তোদের পেয়াদাপাড়ার বাড়িতে তিনি নাকি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছিলেন।’ সেসব তো আমার স্বপ্নের কাহিনি হয়ে আছে!
[আরও পড়ুন: প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে মানুষের জীবনযাত্রা কি সত্যিই সুখকর?]
আমার আরও সুভাষ-সম্পর্ক রয়েছে৷ আমাদের ছাত্রাবস্থায় ‘আমি সুভাষ বলছি’ বলে একখানা বই তোলপাড় তুলেছিল, এবং পরবর্তীকালে আমার একখানা প্রিয় সংগ্রহের নাম দিয়েছিলাম, ‘আমি বিবেকানন্দ বলছি’। এক রসগোল্লা-নির্মাতার বেঙ্গল ক্লাবের সেমিনারে একবার গিয়েছিলাম। সেখানেই পাশে বসেছিলাম কৃষ্ণা বসুর। তিনি বলেছিলেন, দেশোদ্ধার হয়ে গেলে নেতাজি নিশ্চয়ই খাওয়াদাওয়ায় আরও একটু নজর দিতেন।
সুভাষের জননীসমা বিভাবতী দেবীর এক আত্মীয় আমার সহকর্মী। তাঁর কাছে দুপুরবেলায়, টিফিনটাইমে নানা গল্প শুনতাম কলেজ স্ট্রিটের বিভাবতী সম্পর্কে, এবং শুনতাম দাদা শরৎচন্দ্র বসুর বিয়েতে বরযাত্রী সুভাষচন্দ্র বসুর বইপাড়ায় আসার গল্প৷ সুভাষের দাদা শরৎচন্দ্রকে হাই কোর্টে ব্যারিস্টার-রূপে অবশ্যই দেখেছি, এবং বাবুদের বেঞ্চিতে তাঁর বিষয়ে নানা কথা। সুভাষের জন্য করতে পারতেন না, এমন কিছুই ছিল না তাঁর কাছে। আবার সেই সঙ্গে এক প্রতিযোগী শ্বেতাঙ্গ ব্যারিস্টারের কথাও শুনেছি, শরৎচন্দ্র আকস্মিক ইংরেজদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পরে যিনি বিনা ফি-তে তাঁর অসমাপ্ত মামলাগুলো লড়তেন, নিঃশব্দে।
শরৎ বসুর পুত্রবধূ কৃষ্ণা বসু আমাকে বলতেন, যেমন ভাই, তেমন দাদা, তেমন বউদি- এসব নিয়ে এদেশের ছেলেরা আজও সব জানল না। আমি বলতাম, এর সঙ্গে যোগ দেওয়া যেতে পারে, “তেমন ভাইপো শিশির বসু, যিনি সব ভয় তুচ্ছ করে একদা গভীর রাত্রে এলগিন রোড থেকে গাড়ি চালিয়ে কাকাকে পৌঁছে দিলেন গোমো রেল স্টেশনে, একেই বলা হয়ে থাকে ‘মহানিষ্ক্রমণ’।” এই দুঃসাহসিক ‘মহানিষ্ক্রমণ’-কথা এখন তেমন আর শোনা যায় না- এটাই আমাদের দুঃখ!
আমরা সুভাষচন্দ্রের অনেক কথা জেনেও জানি না। শঙ্করীদা আমাকে বলেছিলেন, তুই তো আইনপাড়ার বাবু, একটু সময় নিয়ে দিল্লির লালকেল্লায় আইএনএ ট্রায়ালের ব্যাপারটা এদেশের মানুষদের সহজ ভাষায় শুনিয়ে দে, তুই তো পরে জেনারেল শাহনওয়াজ খানকে রেলের মন্ত্রী হিসাবে দেখেছিস।
এসব তো ছোটখাটো কথা। কৃষ্ণাদি বিখ্যাত লেখক নীরদচন্দ্র চৌধুরীর ভাইঝি। তাঁর আরেক কাকা, বিখ্যাত শিশু চিকিৎসক ডাক্তার ক্ষীরোদচন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে ব্যারিস্টার বারওয়েল সাহেবের বিশেষ হৃদ্যতা ছিল। সেই সূত্রে কৃষ্ণাদি মাঝে মাঝে গল্প করতেন, বলতেন তাঁর নেতাজি কাহিনি-সংগ্রহের কথা। তিনি নিজে আমাকে দেখিয়েছিলেন সেই বিখ্যাত মোটরগাড়িটি, যেটি চড়ে ১৭ জানুয়ারি ১৯৪১ রাত দেড়টার সময় সুভাষচন্দ্র এলগিন রোড থেকে পুলিশের চোখ এড়িয়ে শেষবারের মতো কলকাতা ছেড়েছিলেন, এবং আর কখনও ফিরে আসতে পারেননি। ওঁর মুখেই শুনেছিলাম, গভীর রাতে এলগিন রোডের বাড়ি ছাড়ার আগে ভাইঝি ইলাকে তিনি বলেছিলেন, ঘরের আলোটা নিভিও না, আরও একঘণ্টা অন্তত জ্বালিয়ে রেখো, যাতে নজরদারি পুলিশের মনে হয়- সুভাষ বোস এখনও কাজ করছেন।
কীভাবে ইংরেজের চোখে ধুলো দিয়ে সুভাষ আফগানিস্তান হয়ে জার্মানি চলে গেলেন- সে এমন এক কাহিনি, যার পুরোটা আজও পরিষ্কার হয়নি। শোনা যায়, কলকাতা পিটিআই-এর প্রধান নৃপেনদা এবং সম্ভবত ফজলুল হক ব্যাপারটার আগাম গন্ধ পেয়েছিলেন। নেতাজি-ভক্ত নৃপেনদা এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হতেন না, মুখ বন্ধ রেখে প্রায় পঙ্গু অবস্থায় পিটিআই অফিসে অর্ধশায়িত অবস্থায় তামাক খেতেন। আজও ভাবি, আমরা কেন খুঁজে বের করলাম না সেসব ভারতীয় পুলিশকর্মীকে, যাঁরা ’৪১ সালের জানুয়ারি মাসে গভীর রাতে সুভাষের উপর নজর রাখছিলেন। তাঁরা সেদিন সজাগ সাবধানী সন্ধানী ছিলেন না; না কি তাঁরা দেখেও দেখেননি- তা আর কোনও দিন প্রকাশিত হবে বলে মনে হয় না। এঁদের পরিবারের লোক এখন কোথায়?
স্বামীজির বিশেষ ভক্ত, স্বামী ব্রহ্মানন্দের মন্ত্রশিষ্য স্বামী ভাস্বরানন্দ (১৯০০-১৯৭৮), যিনি ‘ব্রহ্মচারী বুদ্ধচৈতন্য’ নামে একসময় সুপরিচিত ছিলেন, নেতাজির পরবর্তী জীবনের অনেক কথা জানতেন। এঁর সঙ্গে বিশেষ পরিচিত ছিলেন বর্তমানে সেন্ট লুইস, আমেরিকা-প্রবাসী স্বামী চেতনানন্দ। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছি স্বামী ভাস্বরানন্দের কথা, যিনি কুয়ালা লামপুরে বেদান্ত প্রচারে (১৯২২-২৬) নিযুক্ত হন, এবং ১৯২৭ সালে স্বামী শিবানন্দের কাছে সন্ন্যাস নিয়ে একসময় সিঙ্গাপুরে রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ হন। তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘শোনানে নেতাজি’ একসময় ছাত্রসমাজে বিস্ময়ের উদ্রেক করত, কিন্তু এখন তেমন আর শুনি না। সিঙ্গাপুরের নাম যে ‘শোনান’, তা স্বামী ভাস্বরানন্দ মারফত এদেশের ছাত্রদের কাছে একসময় অজানা ছিল না। পরবর্তীকালে দেশে ফিরে এসে স্বামী ভাস্বরানন্দ কাশী সেবাশ্রমের অধ্যক্ষ (১৯৪৮-’৬৯) হয়েছিলেন, এবং ১৯৬১ থেকে তিনি ছিলেন রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের ট্রাস্টি ও গভর্নিং বডির সদস্য, ১৯৭৮ সালে ৭৮ বছর বয়সে দেহত্যাগ পর্যন্ত৷ এই বিস্ময়সাধু-র নেতাজি-স্মৃতি সম্বন্ধে স্বামী চেতনানন্দ বলেছেন, ‘তিনি এত সরল ছিলেন যে কিছু গোপন করতে পারতেন না। এতে মাঝে মাঝে এমন অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হত যে অনেক সাধু তাঁর সামনে মুখ খুলতে চাইতেন না।’
অদ্বৈত আশ্রমের লাইব্রেরিতে বসে সন্ন্যাসী চেতনানন্দ এক সময় মন দিয়ে বুদ্ধ মহারাজের ‘শোনানে নেতাজি’ লেখাটি উদ্বোধন পত্রিকা থেকে পড়তেন। সময় পেলেই নেতাজি সিঙ্গাপুর আশ্রমে গিয়ে ধ্যান করতে বসতেন। অনেক দিন পরে (১৯৬২-’৬৩) কলকাতায় জাপানি অফিসের এক কর্মরত অফিসার ডিহি এন্টালি রোডে বই কিনতে এসে চেতনানন্দকে বলেছিলেন, তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজে নেতাজির বডিগার্ড ছিলেন, এবং একদিন নেতাজি তাঁর সিঙ্গাপুর আশ্রম থেকে একটি জপমালা কিনে আনতে বলেন। তিনি ৫৪টি রুদ্রাক্ষের একটি মালা এনে নেতাজিকে দেন, নেতাজি বলেন, আমি চাই ১০৮ রুদ্রাক্ষের মালা। সঙ্গী বলেন, ১০৮-এর মালা সেখানে নেই৷ আপনি দু’বার ওই মালা ঘোরালে ১০৮ মালা হবে। সেই জাপানি অফিসারের নাম স্বামী চেতনানন্দ মনে রাখতে পারেননি।
স্বামী ভাস্বরানন্দ ১৯৩৯-’৪৫ সাল পর্যন্ত সিঙ্গাপুর রামকৃষ্ণ মঠের অধ্যক্ষ। ১৯৪২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জাপানিরা সিঙ্গাপুর দখল করে তার নতুন নাম দেয় ‘শোনান’, যার অর্থ দক্ষিণ সাগরের আলো। বুদ্ধ মহারাজ একদিন হোটেলে গিয়ে রাসবিহারী বসুর সঙ্গে দেখা করেন, এবং রাসবিহারী বলেন, ‘এখন ধর্মটর্ম সব রেখে দিন। সবাই কাজে লেগে যান। ভারত স্বাধীন হলে ওইসব নিয়ে ভাবা যাবে।’
বুদ্ধ মহারাজ বর্ণনা দিয়েছেন, এলগিন রোড থেকে বেরিয়ে মোটরে চড়ে তিনি গোমো স্টেশনে এসে রেলে আফগানিস্তানে যান এবং সেখান থেকে ইতালি হয়ে জার্মানিতে উপস্থিত হন। জার্মানরা তাঁকে সাবমেরিনে ভূমধ্যসাগরে নিয়ে যায়, এবং সেখান থেকে জাপানিরা তাদের সাবমেরিনে ‘শোনান’-এ নিয়ে আসে, সেখান থেকে নেতাজি বিমানে টোকিও যান।
এবার স্বামী ভাস্বরানন্দ-র লেখা থেকে কিছু উদ্ধৃতি: ‘কয়েক মাস পরে শুনিতে পাইলাম- সুভাষবাবু টোকিওতে আসিয়াছেন, তিনি রেডিওতে তিনদিন তিনটি বক্তৃতা করিয়াছিলেন।’ টোকিও রেডিওতে যিনি নেতাজির ভাষণের সব ব্যবস্থা করেছিলেন- তাঁর সঙ্গে জাপানে আমার দেখা হয়েছিল ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বরে, তখন আমি আমেরিকা থেকে দেশে ফিরছি। সে এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। সেই সময় আরেকজন উপস্থিত ছিলেন। জামাল আহমেদ, বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনার হিসাবে পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতাতেও কিছুদিন সময় কাটিয়েছিলেন। এঁর কিছু কথা ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’ বইতে লিখেছি।
টোকিও থেকে নেতাজি যে-বক্তৃতাগুলি দিয়েছিলেন, তার বিবরণ স্বামী ভাস্বরানন্দ লিখেছেন- ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অমূল্য সুযোগ মিলিয়াছে, এই সুযোগ হারাইলে বহু বৎসর আর এইরূপ সুযোগ মিলিবার সম্ভাবনা নাই। …বৃটিশরাজ যেমন আমার ভারতের বহির্গমন বন্ধ করিতে পারে নাই, তেমন আমার ভারতে প্রত্যাগমন বন্ধ করিতে পারিবে না৷ আপনারা জানেন যে আমেরিকার সাহায্য লইয়া ডি. ভেলেরা আয়ার্ল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রাম চালাইয়াছিলেন। আমাদেরও এইরূপ একটা বড় স্বাধীন রাজ্যের সহায়তা মিলিয়াছে। জাপান আধুনিক জগতের এক পরাক্রমশালী জাতি, আমরাও তাহাদের সাহায্য লইয়া ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম চালাইব। আমি আশা করি, ইহাতে আপনারা আমার সহায়ক হইবেন, আমি শীঘ্রই শোনানে যাইতেছি।’
ভাস্বরানন্দ লিখেছেন, “সাতদিনের মধ্যেই তিনি বিমানযোগে শোনানে আসিলেন।… তাঁহার সঙ্গে কয়েকজন জার্মানপ্রবাসী ভারতীয়। নির্দিষ্ট সময়ে রাসবিহারীবাবু সুভাষবাবুকে লইয়া বক্তৃতামঞ্চে উপস্থিত হইলেন। বিপুল জনতার সামনে রাসবিহারী বলিলেন, ‘Here is your beloved leader Subhas Babu. I hand him over to you… I hope you will follow him implicitly as your destined leader!’
স্বামী ভাস্বরানন্দ জানাচ্ছেন, ‘শোনান’-এ সমুদ্রতীরে প্রাসাদোপম মায়ার্স ম্যানসনে তাঁর বাসস্থান ঠিক হয়েছিল। জাপানিরা তাঁকে সর্বতোভাবে রক্ষার বন্দোবস্ত করেছিলেন৷ স্বামী ভাস্বরানন্দের স্মৃতিকথা- ‘তাঁহার সহকর্মীদের নিকট শুনিয়াছি, তিনি রাত্রিতে কখনও তিন ঘণ্টার বেশি নিদ্রা যাইতেন না।… শোনান মিউনিসিপ্যাল অফিসের সম্মুখে সুবৃহৎ ময়দানে এক জনসমুদ্রের মধ্যে তিনি তাঁহার খালয়ে আসার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে প্রায় দেড়ঘণ্টাকাল বক্তৃতা করিলেন। ভাষণের মধ্যেই প্রচণ্ড বৃষ্টি নেমেছিল, কিন্তু শ্রোতারা এই বৃষ্টি উপেক্ষা করে তাঁর কথা শুনেছিলেন, যা সুভাষচন্দ্রকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি পরিচিতদের বলতেন, আমাদের কাজের জন্য সাধারণের সহানুভূতি অপর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যাবে, এতে কিছু মাত্রও সন্দেহ নেই।’
ভাস্বরানন্দর স্মৃতি অনুযায়ী, বিজয়া দশমীর রাত্রে (১৯৪৩) সুভাষচন্দ্র গাড়ি পাঠিয়ে ‘আমাকে তাঁর সহিত অনতিবিলম্বে দেখা করিতে অনুরোধ করিলেন, তখন রাত্রি ৯টা হইবে। আমি ওই গাড়িতেই তাঁহার সহিত দেখা করিতে গেলাম।… সেক্রেটারি মিস্টার হাসান আমাকে উপরে সুভাষবাবুর নিকট লইয়া গেলেন। তিনি অতি বিনীত ও শ্রদ্ধাবনত হইয়া প্রণাম করিয়া আমাকে বসিতে বলিলেন এবং সহকারীদের চা আনিতে আদেশ দিলেন।’ সেইদিন অনেক আলোচনা হয়েছিল, নেতাজির অনুরোধে ‘নৈশ আহার এইখানেই সেরে আশ্রমে ফিরতে প্রায় রাত্রি বারোটা বাজিয়া গেল। তাঁহার সহিত দেখা করিতে গেলেই তিনি কখনও ভোজন না করাইয়া ছাড়িতেন না। তাঁহার আদর-আপ্যায়নে সত্য সত্যই কেহই মুগ্ধ না হইয়া থাকিতে পারিত না।’
শ্রীশ্রীমায়ের জন্মদিনে সুভাষচন্দ্র সিঙ্গাপুর মিশনে এসেছিলেন, এবং ‘সেই দিনে ঠাকুরঘরে প্রায় আধঘণ্টা কাল ভাবাবিষ্ট হইয়া বসিয়াছিলেন।… প্রায় একঘণ্টা কাল এই রূপে অতিবাহিত হইবার পরে তিনি একটি চণ্ডীর জন্য বিশেষ ঔৎসুক্য প্রকাশ করায়, আমার চণ্ডীটি তাঁহাকে উপহার দেওয়ায় তিনি অতিশয় আনন্দ প্রকাশ করিলেন।’ আরও খবর দিয়েছেন স্বামী ভাস্বরানন্দ: ‘সিঙ্গাপুরে মিশনের অনাথালয় বাড়ি নির্মাণের জন্য তিনি নিজে প্রায় ৫০,০০০ ডলার দান করেন, এবং আরও ৫০,০০০ ডলার সংগ্রহ করিয়া দেন। তিনি স্বয়ং আসিয়া বয়েজ হোম-এর দ্বারোদঘাটন করেন। অনাথালয়ের ছেলেমেয়েদের অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা তিনিই করিয়া দিয়াছিলেন, কারণ যুদ্ধকালীন ব্ল্যাক মার্কেট ও ফুড কনট্রোলের দিনে তিনশত ছেলেমেয়ের অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা করা আমাদের পক্ষে একটা কঠিন সমস্যা হইয়াছিল।’
এই স্বামী ভাস্বরানন্দের সঙ্গে পরবর্তীকালে স্বামী চেতনানন্দের অনেক কথা হয়েছিল কাশীতে (১৯৭৭ সালে)। সেসব স্বামী চেতনানন্দ কিছুটা লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর ‘প্রাচীন সাধুদের কথা’ বইয়ের প্রথম খণ্ডে।
আমরা বরং ফিরি সেই ঐতিহাসিক ‘মহানিষ্ক্রমণ’ পর্বে। ১৭ জানুয়ারি, ১৯৪১ নেতাজি রাত দেড়টায় ৩৮/২ এলগিন রোডের বাড়ি থেকে (আজকের ‘নেতাজী ভবন’) বিদায়কালের ব্রাহ্মমুহূর্তে তাঁর ভাইঝি ইলাকে যে ঘরের আলো জ্বালিয়ে রাখতে বলেছিলেন, তা পুলিশকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য। আমার সঙ্গে সিইএসসি-র যোগাযোগের ব্যাপারটা কৃষ্ণাদি জানতেন বলে আরও কিছু বৈদ্যুতিক সংবাদ দিতে তিনি উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, ‘এই বাড়িতে বিদ্যুৎ এসেছে ১৯০৯ সালে, সুভাষচন্দ্রের পিতৃদেব কটক থেকে এসে এই ভবন গড়ে তুলেছিলেন। সুভাষ এসেছিলেন উড়িষ্যা থেকে অনেক পরে, কটক র্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে, কলকাতার প্রেসিডেন্সিতে পড়াশোনা করতে। এই বাড়িতেই জানকীনাথ বসুর দেহান্ত, সুভাষচন্দ্র তখন বিদেশে, খবর পেয়ে চলে এলেন এবং এলগিন রোডের বাড়িতে তখনই তাঁকে অন্তরিন করা হল। পিতৃশ্রাদ্ধের পরে মুণ্ডিতমস্তক সুভাষচন্দ্রের একটা ছবি (১৯৩৫) দেখেছি, ঠিক যেন সন্ন্যাসী।’
কৃষ্ণাদি বলেছিলেন, ‘আমার শ্বশুরমশাই সুভাষের দাদা শরৎচন্দ্র বসুর কথাও না এসে উপায় নেই। তিনি প্রথমে যে পাশের বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিলেন, তা এখন আর নেই। এরপরেই এপাড়ার দ্বিতীয় বসুবাড়ি ১ নম্বর উডবার্ন পার্ক, সেখানেও সুভাষচন্দ্র বসবাস করতেন।’ এ বাড়ির কথা বলতে গিয়ে কৃষ্ণাদি আমাকে খবর দিয়েছিলেন, কে না এখানকার ঘরগুলো আলোকিত করে গিয়েছেন- মহাত্মা গান্ধী, মোতিলাল নেহরু, জওহরলাল, তাঁর তরুণী কন্যা ইন্দিরা গান্ধী, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, সরোজিনী নায়ডু, আবুল কালাম আজাদ।
কৃষ্ণা বসু আমাকে খবর দিয়েছিলেন, শুনুন, এই বাড়িতেই মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে দু’বার এসেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখন লিফট নেই, যাঁরা তাঁকে চেয়ারে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় তুললেন, তাঁদের মধ্যে শরৎচন্দ্র, জওহরলাল ও মহাদেব দেশাই ছাড়াও চতুর্থ ব্যক্তিটি কে ছিলেন জানেন? তাঁর নাম সুভাষচন্দ্র বসু। আর রবীন্দ্রনাথের চটি কে এগিয়ে দিয়েছেন জানেন? তাঁর নাম মহাত্মা গান্ধী। তখনও সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সুভাষচন্দ্র বসু। তখন কে জানত, এই মানুষটিই একদিন হয়ে উঠবেন আমাদের পরম বিস্ময়ের নেতাজি সুভাষ। এলগিন রোডের ধার দিয়ে আজও যখন যাই, তখন বলতে ইচ্ছা করে–‘দাঁড়াও, পথিকবর, জন্ম যদি তব/ বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল!’ এই স্মৃতিভরা মন্দিরে।
(মতামত নিজস্ব)