shono
Advertisement

ছিটের জামার আলোয় মাতোয়ারা উৎসব, ঠিক তালে ছুঁয়ে যেত ক্যাপ-বন্দুক

চাঁদায় আদরের জোর ছিল, জুলুম নয়।
Posted: 04:45 PM Oct 11, 2023Updated: 04:45 PM Oct 11, 2023

শুভদীপ সাহা: সবুজ ঘাস যেখানে না-ফুরোনো মাঠের আকাশে মিশে যেত, সেই আকাশে পেঁজা তুলোর মেঘে সওয়ার হয়ে আমাদের ছোটোবেলার পুজো আসত। আর খেলার বিকেলে কোনও বাড়ি থেকে ভেসে আসা ‘এই প্রাণ ঢালা উৎসবে’র শালিমারী সুর ছিল পুজোর নান্দীমুখ। স্কুল ছুটির আগে হাতের লেখা দিতেন দিদিমণি-মাস্টারমশাইরা। তখনও এমন খামোখা প্রথমা মাখামাখি পুজো ছিল না। প্রথা মেনেই ছিল ষষ্ঠীতে শুরু। চারদিনের পুজো তখনও দশদিনে পৌঁছায়নি। তার আগে যখন ‘নন্দীবাড়ির আটচালাতে কুমোর ঠাকুর’ গড়ত আর আমাদের মন বসত না। ঘাড় গুঁজে লিখতে হত ‘দুর্গা’, ‘পুজো-পূজা’, ‘প্রতিমা নিরঞ্জন হয়, বিসর্জন নয়’। খুঁটিপুজোর খুঁটিনাটি নিয়ে ততটা উচ্চিংড়েপনা আমাদের ছিল না, যতটা ছিল পেপারকাকুর দিয়ে যাওয়া রংচঙে মলাটের মোটা বইয়ের খাঁজে। বিমল দাস বা সুধীর মৈত্রর প্রচ্ছদে আমাদের পুজো শুরু হত। হা-পিত্যেশ করে বসে থাকা সারা বছর শুধু ওই একটা বইয়ের জন্য, তেমন বই কেন হারিয়ে গেল?

Advertisement

ছিটের জামার আলোর ছটায় আমরা মাতোয়ারা তখন। জামা তখন দর্জিযোগে, এখনকার মত মর্জিযোগে নয়। পাড়ার মোড়ে যে কাকু আজ পুজোর আগেও মাছি তাড়ান, তখন সেই কাকুর ‘ডেট’ পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। সেমি-পছন্দের জামা-প্যান্ট না হয় বাগানো হল, কিন্তু তারপর? বাবা-মায়ের চোখের আড়ালে প্যান্টের ঝুল আরেকটু বাড়িয়ে নেওয়া- ‘কাকু, বুকপকেট দিও কিন্তু’।

[আরও পড়ুন: পদ্ম নয়, ১০৮টি অপরাজিতায় সন্ধিপুজো হয় উত্তর কলকাতার এই বনেদি বাড়িতে]

অষ্টমীর সকালে যে কাঙালপনা ছিল পুরুতমশাইয়ের টাক তাক করে উদাসীন ফুল, সেই কাঙালপনা বদলে গেল বড় হয়ে। একটু বড় হয়েও তাকানো ততটা সহজ ছিল না, হাত ধরা তো দূর অস্ত। দ্বিধা থরথর চূড়ে ভর করা প্রাণের দশা ছিল মহিষাসুরের থেকেও সঙ্গীন। সঙ্গিনীহীন জীবনগুলোতে অপেক্ষা ছিল দীর্ঘ। অপ্রাপ্তি ছিল, অপ্রাপ্তির দুঃখ ছিল, দুঃখবোধ ছিল। তাতে দ্বেষ ছিল না, ছিল না প্রাপ্তির বাহুল্য– তাই উচ্ছাসও ছিল সংযমে বাঁধা। অষ্টমীর সকালে সলজ্জ সেই তাকানোটুকুতেই অনেকখানি প্রাপ্তি ছিল, যা আর কোনওদিন দেখা না হওয়ার অপ্রাপ্তির থেকেও বেশি।

উৎসবের আনন্দে ধর্মের আতিশয্য চোখে পড়েনি কোনওদিন, চোখে পড়েনি ভিআইপি লাইন, সবাই সমান ছিল, মায়ের কাছে বড়-ছোট আবার কী? মূর্তির গায়ে রঙের ছোপ একটু কম ছিল কি? হবে হয়তো। তাই হয়তো ধর্মের ছোপ বেশি পড়েনি। চাঁদায় আদরের জোর ছিল, জুলুম নয়। কোনও কোনও বাড়ির চাঁদা আদায়ের ইন্টারভিউ ছিল সর্বজনবিদিত। একসময় দু’তিনটে পাড়া মিলে যে পুজো হত, ভাঙতে ভাঙতে এখন একটা পাড়ায় দুতিনটে পুজোয় এসে পৌঁছাল। যা ছিল সর্বজনীন তা হল একার অধীন।

[আরও পড়ুন: যিনি ট্র্যাফিক পুলিশ, তিনিই মৃৎশিল্পী! পথসুরক্ষা সামলে প্রতিমা গড়েন বাঁশদ্রোণীর সুকুমার]

ক্যামেরা কম হলেও স্মৃতি ছিল ঝকঝকে। ক্রমশ ঠাকুর বদলে গেল মূর্তিতে। আয়তচোখের দৃষ্টি আটকে গেল মোবাইল ক্যামেরার আয়তক্ষেত্রে। জিয়া তখনও নষ্ট হয়ে টাল খায়নি, আলো ছিল। পুজোর গানের সম-ফাঁকে ক্যাপ-বন্দুক ঠিক তালে ছুঁয়ে যেত। অতি বড় দীর্ঘতম বৃক্ষে দেবতা বসত না। হাত বাড়ালেই ঘরের মেয়ে উমাকে পেত মায়েরা। দশমীর মনখারাপে মণ্ডপের এককোণে একলা জেগে থাকা প্রদীপ জানত, ছেড়ে চলে যাওয়া জীবন আদতে কিছুটা অগোছালো, বাকিটা এলোজেলো।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement