shono
Advertisement

সবে মিলে করি কাজ

বিরোধী শিবিরের বাক্‌-সংযম এই মুহূর্তের প্রধান দাবি।
Posted: 10:21 AM Apr 19, 2023Updated: 10:21 AM Apr 19, 2023

সার্বিক ঐক্য ছাড়া বিজেপির জগদ্দল পাথর নড়ানো অসম্ভব। তাই ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ ভুলে বৃহত্তর বিরোধী জোটগঠনে সকলের সৎ উদ্যোগ একান্ত আবশ‌্যক। লিখলেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement

কয়েক দিন ধরে কিছু তৎপরতায় মনে হচ্ছে বিজেপি-বিরোধী রামধনু জোট গঠনের কাজ অবশেষে ঠিকঠাকভাবে শুরু হল। এই সময় বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের মতো সবার উদ্দেশে একটি সাবধানবাণীও উচ্চারণ করা প্রয়োজন। বিরোধী নেতাদের এমন কিছু বলা বা করা উচিত নয়, যা ঐক্য প্রচেষ্টায় সন্দেহ ও সংশয়ের কাঁটা গেঁথে দিতে পারে। যাতে মনে হয়, এই ঐক্য বালির বাঁধ। বিরোধী শিবিরের বাক্‌-সংযম এই মুহূর্তের প্রধান দাবি। কথাটা লিখতে হল, কেননা, এই ধরনের ‘ভুল’-এর প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। নেতারা এখন থেকে সতর্ক না হলে, কড়া হাতে হাল না ধরলে বিপদ।

জোট নিয়ে আশার বড় ঝলকানি বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের দিল্লি সফর এবং কংগ্রেসের সঙ্গে বৈঠক। বিজেপি (BJP) ছেড়ে বেরিয়ে এসে বিজেপির বিরুদ্ধে পোক্ত জোট গঠনে তিনি যে সত্যি সত্যিই আগ্রহী– এই সফরের মধ্য দিয়ে নীতীশ তা বোঝালেন। মনে রাখতে হবে, সফরের আগে বিহারে সিপিআই (এমএল)-এর একাদশ সাধারণ সম্মেলনে কংগ্রেস নেতা সলমন খুরশিদের উদ্দেশে‌ নীতীশ বলেছিলেন, ‘‘দলকে বলুন জোট গঠনের উদ্যোগ নিতে। ঠিকঠাক জোট হলে বিজেপি দেশে ১০০ আসনও জিততে পারবে না।’’ সেদিন ছিল ১৯ ফেব্রুয়ারি। সেই প্রথম কংগ্রেসের প্রতি নীতীশ প্রকাশ্যে বার্তা দিলেন। টাইমিংও ছিল মোক্ষম। কংগ্রেসের প্লেনারি অধিবেশন শুরুর ঠিক আগে।

[আরও পড়ুন: ‘বিজেপি ক্ষমতায় এলে ফুলের মালা দিয়ে ফেরানো হবে টাটাকে’, সিঙ্গুরে প্রতিশ্রুতি শুভেন্দুর, পালটা তৃণমূলের]

প্লেনারিতে কংগ্রেসও দিল স্পষ্ট সংকেত। সোনিয়া, রাহুল (Rahul Gandhi), প্রিয়াঙ্কার পাশাপাশি সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গেও জোটের পক্ষে জোরালো সওয়াল করলেন। তিনটি স্পষ্ট বার্তা ওই সম্মেলন থেকে বেরিয়ে আসে। এক, কংগ্রেসকে ছাড়া কোনও বিরোধী জোট হতে পারে না। দুই, জোটের নেতৃত্ব নিয়ে কংগ্রেস জোরাজুরি করবে না। যে কেউ উদ্যোগী হোক, কংগ্রেস পাশে থাকবে। তিন, বিরোধী জোটের মুখ হিসাবে কংগ্রেস কাউকে চাপিয়ে দেবে না।

প্লেনারি পরবর্তী ঘটনাবলি দ্রুত এগয়। বাজেট অধিবেশনে আদানি বিতর্ক প্রাধান্য পায়। বিজেপি বুঝতে পারে, রাহুল আরও একবার মোক্ষম জায়গায় ঘা মেরেছেন। সংসদ অচল থাকে। রাহুল বিদেশ সফরে গিয়ে দেশের ‘গণতন্ত্রহীনতা’ ও ‘স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা’ নিয়ে সরকারের সমালোচনা তুঙ্গে তোলেন। বিজেপি তা হাতিয়ার করে। ‘দেশবিরোধী’ প্রচারের তীব্রতা বাড়ায়। চার বছরের পুরনো মানহানি মামলায় সুরাট আদালত রাহুলকে দোষী ঠাওরায়। পরদিন তাঁর সাংসদ পদ খারিজ হয়। সিদ্ধান্তটি নিমেষের মধ্যে বিরোধী জোটের অনুঘটকের কাজ করে। তৃণমূল কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি বা ভারত রাষ্ট্র সমিতি-র মতো দলগুলো যারা এতদিন পর্যন্ত ছোঁয়াছুঁয়ির বাছবিচার করে চলছিল, তারা কংগ্রেসের পাশে এসে দাঁড়ায়। নীতীশের দিল্লি সফর ও কংগ্রেসের সঙ্গে বৈঠক ওই সন্ধিক্ষণে।

[আরও পড়ুন: আধার কার্ড দিয়ে পচাগলা দেহ শনাক্ত, দু’মাস পর ‘নিখোঁজ’ ছেলের খোঁজ পেলেন বাবা]

বৈঠকে সবার মনোভাবই ছিল ইতিবাচক। খাড়গের বাড়িতে রাহুলের হাজির হওয়া, সলমন খুরশিদকে ডেকে নেওয়া, নীতীশের সঙ্গে তেজস্বীর উপস্থিতি, সঙ্গে মনোজ ঝা-লালন সিং-কে রাখা– সব মিলিয়ে চমৎকার এক যৌথ উদ্যোগ। বৈঠক পরবর্তী বিবৃতিও ছিল ইঙ্গিতবাহী। বিরোধী ঐক্য স্থাপনের উদ্যোগকে ‘ঐতিহাসিক’ লিখে রাহুল বললেন, ‘‘সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে দেশের জন্য লড়ব।’‘

ওই বৈঠকেই ঠিক হয় নীতীশ উদ্যোগী হবেন মমতা-কেজরিওয়াল-নবীন-কেসিআর-দের পাশে টানতে, ইউপিএ সঙ্গীদের সঙ্গে কথা বলবেন খাড়গে নিজে। সেই রাতেই নীতীশ দেখা করেন কেজরিওয়ালের সঙ্গে। হয় জোট গঠনের আলোচনাও। এই সলতে-পাকানো পর্বের তাল কিছুটা কাটে তিনটি অবাঞ্ছিত ঘটনায়। প্রথমটির জন্য দায়ী রাহুল নিজে। সাভারকরকে নিয়ে তাঁর মন্তব্যর কড়া প্রতিক্রিয়া দেন উদ্ধব ঠাকরে। সামাল দেন শরদ পওয়ার। রাহুল নিজেও দ্রুত ‘ভুল’ শুধরে নেন। সোমবার তাঁর দূতেরা উদ্ধবের সঙ্গে দেখাও করেছেন। মেঘ কেটে সম্পর্ক ফের ফুরফুরে।

দ্বিতীয়টির স্রষ্টা মারাঠা স্ট্রংম্যান: শরদ পওয়ার। এতদিন ধরে আদানি বিতর্ক চলছে। তিনিও চুপ ছিলেন। হঠাৎই বলা নেই কওয়া নেই গৌতম আদানির প্রশংসা করলেন! জেপিসি গঠনের বিরোধিতা করলেন! আদানি-কাণ্ড নিয়ে বিজেপি যখন কোণঠাসা, প্রধানমন্ত্রীর মুখে যখন রা নেই, সরকার ও দল নির্বাক, তখন হঠাৎ গৌতম আদানিকে সার্টিফিকেট দিতে গেলেন কেন পওয়ার? টেলিভিশন চ্যানেল তাঁকে ডেকেছিল, নাকি তিনি নিজেই আগ্রহী হয়েছিলেন কাউকে ‘অন্য বার্তা’ দিতে? বেসুরো গাইতে? সত্যিটা তিনিই জানেন। কিন্তু জনতা জানল আদানি নিয়ে বিরোধী শিবিরও ছাড়া-ছাড়া। এ-ও জানল, আদানির দুর্দিনের বন্ধু অনেকেই। এই সময় ওই ধরনের কথা বলার অর্থ কী, পোড়খাওয়া পাওয়ার তা খুব ভাল বোঝেন। মুশকিল হল, সেই বোধবুদ্ধি বিরোধী ঐক্যর সহায়ক নয়। তৃতীয় ভুলের জন্যও দায়ী কংগ্রেস। এই ভুল শেষ পর্যন্ত কোন দিকে মোড় নেবে জানা নেই, তবে পুনরাবৃত্তি কড়া হাতে বন্ধ না হলে জোট-প্রচেষ্টায় খিঁচ ধরবেই। জলেও যেতে পারে।

অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি-র সঙ্গে কংগ্রেসের সখ্য-সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। দিল্লিতে কংগ্রেসি মৌরসিপাট্টার অবসান কেজরিওয়ালেরই ঘটানো। সেই থেকে রাজধানীতে কংগ্রেসের ভাঙা কোমর জোড়া লাগেনি। পাঞ্জাবেও কংগ্রেসের দেউটি নিভিয়েছেন তিনি। গোয়ায় বাড়া ভাতে ছাই ফেলেছেন। কংগ্রেসের একটা বড় অংশ এখনও মনে করে, বিজেপির সঙ্গে আপের লড়াই ‘ডব্লিউডব্লিউএফ’-এর মতো নির্ভেজাল ‘মক ফাইট’। দিল্লি প্রদেশ নেতৃত্ব তাই কোমর কষে ঝগড়া করেই চলেছে। কেজরিওয়ালের ‘সততার মুখোশ’ টান মেরে খুলে ফেলতে চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না। বিশেষ করে আবগারি নীতি নিয়ে।

বন্ধুত্বর হাত কিন্তু কেজরিওয়ালই প্রথম বাড়ান রাহুলের সাংসদ পদ খারিজ হওয়ার দিন। টুইট করে কংগ্রেসের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। রাহুলও ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাল কাটে কেজরিওয়ালকে সিবিআই ডাকার দিন। দিল্লি প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অনিল চৌধুরী তালি বাজিয়ে বলার ঢঙে জানিয়ে দেন, মুখ্যমন্ত্রীই নাটের গুরু। তাঁকে গ্রেফতার করা উচিত। সত্যেন্দ্র জৈন ও মণীশ সিসোদিয়ার মতো কেজরিওয়ালেরও ঠিকানা হওয়া উচিত তিহার জেল। পরের দিন রাহুল-ঘনিষ্ঠ অজয় মাকেন সেই ধোঁয়ায় ধুনো দিয়ে বলেন, কোনও সহানুভূতি নয়। কংগ্রেস সমর্থক আইনজীবীরা যেন কেজরিওয়ালের হয়ে না দাঁড়ান। পাপের ফল ওঁর ভোগা উচিত।

খাড়গে অবশ্য চেষ্টা করেছেন জল যাতে বেশি দূর না গড়ায়। কেজরিওয়ালকে ফোন করে পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন। ভালই করেছেন। এই সন্ধিক্ষণে এটাই কাম্য। কিন্তু সেটাই সব নয়। দল যদি মনে করে বিরোধী জোট গঠন এই মুহূর্তে একমাত্র কাজ, সময়ের দাবি, ঐক্য ছাড়া বিজেপির জগদ্দল পাথর নড়ানো অসম্ভব, তাহলে যে কোনও মূল্যে সেই ঐক্যস্থাপন করা ও তা ধরে রাখা প্রয়োজন। কংগ্রেস সভাপতি তো বটেই, গান্ধী পরিবারেরও উচিত কঠিন ও কঠোরভাবে সর্বস্তরে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া যে, ঐক্যহানি হয় এমন কোনও মন্তব্য বা সমালোচনা কিংবা কটাক্ষ কেউ যেন না করেন। পরিস্থিতি যখন কঠিন, প্রতিপক্ষর একক মোকাবিলা যখন অসম্ভব, তখন বিকল্প একটাই। জোটবদ্ধতা। ক্ষতিসাধনের অর্থ নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারা। বড় দলের দায়িত্বও বেশি। কংগ্রেসের উচিত সেই দায়িত্ব রক্ষায় যত্নবান হওয়া। অন্যদেরও।

ইডি-সিবিআইয়ের অপব্যবহার রুখতে চতুর্দলীয় উদ্যোগে জল ঢেলে সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি বিরোধীদের মুখের উপর আয়না ধরেছে। জানিয়েছে, আদালত নয়, রাজনীতির মোকাবিলা করতে হবে রাজনৈতিকভাবেই। সেজন্য ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ ভুলে বৃহত্তর বিরোধী জোট গঠনই একমাত্র উপায়। এই সারসত্য আন্তরিক অনুধাবনের পাশাপাশি ছুটকো নেতাদের বালখিল্য আচরণ বন্ধ করা জরুরি। না হলে তিমিরাবসান দুরস্ত।

(মতামত নিজস্ব)
saumyabandyo@gmail.com

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement