Advertisement
হালকা উপসর্গকে অবহেলা নয়, শীতেই বাড়ে রোগের ঝুঁকি, কোন কোন লক্ষণে সতর্ক হবেন?
এই লক্ষণগুলি জানান দেবে শরীরে সংক্রমণ হয়েছে কি না।
শীতকালে বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বাড়ে। একদিকে যেমন শহরাঞ্চলে বায়ুদূষণের প্রভাবে নাজেহাল হতে হয় মানুষকে, ঠিক তেমনই ঠান্ডা আবহাওয়ায় ভাইরাস ঘটিত রোগের সংক্রমণ সবচাইতে বেশি দেখা যায়। এছাড়াও, উচ্চ রক্তচাপ, ড্যাবেটিস, কোলেস্টেরল প্রভৃতি শারীরিক সমস্যা ঠান্ডাতেই বাড়তে থাকে নীরবে। তাই, এই সময় সাবধানে থাকা আশু প্রয়োজন।
শীতকালে সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি ঘটে। শরীরে কোনও রোগের সংক্রমণ ঘটলে চট করে বোঝা যায় না। কারণ, প্রাথমিক পর্যায়ে হালকা জ্বর, গলা ব্যথা, হাত-পা ব্যথা এমন সব উপসর্গ ফুটে ওঠে। পেনকিলার খেলে উপসর্গ কমেও যায়। তবে রোগ তীব্র আকার নেওয়ার প্রস্তুতি নেয় ভিতর ভিতর।
নিম্ন তাপমাত্রার কারণে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা 'ইমিউন সিস্টেম' কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সংক্রমণের প্রকোপ বাড়ে। অনেক সময় আমরা সাধারণ অসুস্থতা ভেবে ভুল করি, যা পরবর্তীতে বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা যখন ৯৯° ফারেনহাইট থেকে ১০০° ফারেনহাইটের মধ্যে ঘোরাফেরা করে, তখন তাকে 'লো-গ্রেড ফিভার' বলা হয়। শীতকালে কোনও সংক্রমণ ঘটলে শরীর তা প্রতিহত করার চেষ্টা করে। ফলে শরীরের তাপমাত্রা সামান্য বেড়ে যায়। অনেকে একে সাধারণ ক্লান্তি ভেবে ভুল করেন। কিন্তু যদি এই জ্বর ২-৩ দিনের বেশি স্থায়ী হয়, তবে বুঝতে হবে ভেতরে কোনও 'ইনফ্ল্যামেশন' বা প্রদাহ চলছে। একে অবহেলা করলে সংক্রমণ রক্তে বা ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে। এটি শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার একটি প্রাথমিক সংকেত যা ইঙ্গিত দেয় যে কোনও প্যাথোজেন শরীরে বাসা বেঁধেছে।
সংক্রমণের সময় শরীরের সমস্ত শক্তি শ্বেত রক্তকণিকা তৈরিতে ব্যয় হয়। এর ফলে রোগী তীব্র অবসাদ বা 'ম্যালাইজ' অনুভব করেন। পর্যাপ্ত ঘুমানোর পরেও যদি শরীর ম্যাজম্যাজ করে বা হাত-পায়ে জোর না পাওয়া যায়, তবে তা ভাইরাল লোড বাড়ার লক্ষণ হতে পারে। ডাক্তারি পরিভাষায় একে 'পোস্ট-ভাইরাল সিনড্রোম'-এর প্রাথমিক ধাপ বলে। এই ক্লান্তি কেবল শারীরিক নয়, মানসিক জড়তাও তৈরি করে। শীতকালীন অলসতা ভেবে একে এড়িয়ে যাওয়া ঠিক নয়, কারণ এটি হৃতপিণ্ড বা কিডনির ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করতে পারে।
শীতকালীন সংক্রমণের অন্যতম সাধারণ লক্ষণ হল 'ফ্যারিনজাইটিস' বা গলার ভেতরে প্রদাহ। অনেক সময় ঘাড়ের বা কানের পেছনের গ্রন্থি বা 'লিম্ফ নোড' ফুলে ওঠে এবং স্পর্শ করলে ব্যথা লাগে। লিম্ফ নোড হল শরীরের ফিল্টারেশন সিস্টেম। যখনই কোনও ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস শরীরে ঢোকে, এই গ্রন্থিগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে। যদি খাবার গিলতে কষ্ট হয় বা গলার স্বর বদলে যায় (হোর্সেনেস), তবে বুঝতে হবে সংক্রমণটি উপরিভাগ থেকে গভীরে প্রবেশ করছে। ঘরোয়া টোটকা বা পেনকিলারে এটি সাময়িকভাবে কমলেও চিকিৎসকের পরামর্শ না নিলে বিপদ ঘটতে পারে।
ভাইরাল ইনফেকশনের অন্যতম উপসর্গ হল 'ম্যালজিয়া' বা পেশির তীব্র ব্যথা। শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতির কারণে আমাদের ইমিউন সিস্টেম সাইটোকাইন নামক এক ধরণের প্রোটিন নিঃসরণ করে, যা পেশিতে প্রদাহ ও ব্যথা তৈরি করে। শীতকালে এমনিতেই বাতাসের শুষ্কতা ও ঠান্ডায় পেশি সংকুচিত থাকে। তার ওপর সংক্রমণের এই ব্যথা রোগীকে কাবু করে ফেলে। অনেকে একে কেবল শীতের ব্যথা ভেবে পেইনকিলার খান। কিন্তু পেইনকিলার কেবল উপসর্গ কমায়, সংক্রমণের মূল কারণ দূর করে না। সঠিক অ্যান্টি-ভাইরাল বা সাপোর্টিভ কেয়ার না নিলে এটি শারীরিক দুর্বলতা তৈরি করে।
বায়ুদূষণ ও ভাইরাসের কারণে শীতকালে শ্বাসনালীর সংক্রমণ বা 'আপার রেসপিরেটরি ট্রাক্ট ইনফেকশন' খুব বেড়ে যায়। যদি কাশির সাথে শ্বাস নিতে কষ্ট হয় বা বুকের খাঁচায় চাপ অনুভব হয়, তবে তা ফুসফুসে সংক্রমণের লক্ষণ হতে পারে। ডাক্তারি পরিভাষায় একে 'ডিসপনিয়া' বলা হয়। পিএম ২.৫ কণার প্রভাবে ফুসফুসের অ্যালভিওলাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে অক্সিজেন আদান-প্রদান ব্যাহত হয়। সংক্রমণের এই পর্যায়ে কাশির সিরাপ খেয়ে সময় নষ্ট করা বিপদজনক। বিশেষ করে প্রবীণ ও শিশু রোগীদের ক্ষেত্রে এটি দ্রুত নিউমোনিয়ার আকার নিতে পারে, তাই আগেভাগেই পালমোনোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
শরীর যখন সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে, তখন পরিপাকতন্ত্রের কার্যকারিতা কিছুটা কমে যায়। একে বলা হয় 'অ্যানোরেক্সিয়া'। খাবারের গন্ধ সহ্য করতে না পারা বা বমি বমি ভাব (নসিয়া) সংক্রমণের একটি পরোক্ষ লক্ষণ হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে শীতকালীন ফ্লু থেকে পেটের সমস্যা বা 'গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস' দেখা দেয়। এর ফলে শরীরে ডিহাইড্রেশন ঘটে। যদি নিয়মিত খাবারের অভ্যাসে হঠাৎ পরিবর্তন আসে এবং ওজনে ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়, তবে বুঝতে হবে শরীরের অভ্যন্তরীণ বিপাক ক্রিয়া কোনও সংক্রমণের কারণে ব্যাহত হচ্ছে। সঠিক পুষ্টি না পেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও ভেঙে পড়ে।
সংক্রমণের সময় মস্তিষ্কের চারপাশের রক্তবাহী ধমনীগুলিতে চাপ সৃষ্টি হতে পারে, যাকে 'ভাস্কুলার হেডেক' বলা হয়। সাইনাসের সংক্রমণের কারণেও কপালে ও চোখে তীব্র ব্যথা হতে পারে। শীতকালে ঠান্ডার কারণে এই ব্যথা আরও তীব্র অনুভূত হয়। এছাড়া সংক্রমণের প্রভাবে মেজাজ খিটখিটে হওয়া, মনোযোগের অভাব বা ঘুমের সমস্যা হতে পারে। এটি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে সংক্রমণের আগাম সতর্কবার্তা হতে পারে।
সংক্রমণের অনেক লক্ষণ ত্বকের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। কোনও কোনও ভাইরাসের ক্ষেত্রে শরীরে ছোট ছোট লাল দানা বা 'ইরাপশন' দেখা দিতে পারে। এছাড়া শীতকালে রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হওয়ায় সংক্রমণের কারণে আঙুলের মাথা নীলচে হওয়া বা 'সায়ানোসিস' দেখা দিতে পারে। যদি ত্বকে অস্বাভাবিক চুলকানি বা ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায় যা সাধারণ ময়েশ্চারাইজারে সারছে না, তা নিশ্চিত ভাবে কোনও সংক্রমণ হতে পারে। ডাক্তারি পরিভাষায় একে 'কিউট্যানিয়াস ম্যানিফেস্টেশন' বলে।
Published By: Buddhadeb HalderPosted: 09:10 PM Dec 22, 2025Updated: 09:10 PM Dec 22, 2025
Sangbad Pratidin News App
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
