কেউ তালাবন্ধ হাজত থেকে বেরিয়ে এসেছেন অবলীলায়। অন্যের রোগ টেনে এনেছেন নিজের শরীরে। কেউ নিমেষে তালুবন্দি করেছেন কাঙ্খিত বস্তু। কেউ আবার একই সময়ে একাধিক জায়গায় থেকেছেন। বুদ্ধিতে এসবের ব্যাখ্যা মেলে না। অথচ বুজরুকি বললে ইতিহাসকে অপমান করা হয়। অণিমা, লঘিমা, গরিমা, প্রাপ্তি, প্রাকাম্য, মহিমা, ঈশিতা, বশিতা। অষ্টসিদ্ধি করায়ত্ত করা সাধকদের খুঁজেছেন গৌতম ব্রহ্ম। আজ প্রথম পর্ব।
এ কী অসভ্যতা!
নগর-পরিক্রমায় বেরিয়েছেন কাশীর নতুন ম্যাজিস্ট্রেট। দশাশ্বমেধ ঘাটে মুখোমুখি তৈলঙ্গস্বামী। গায়ে একটা সুতোও নেই। পুরো নগ্ন! দোর্দণ্ডপ্রতাপ ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট রেগে আগুন। এই বেয়াদপকে কড়া সাজা দিতে হবে। সাহেব আগে তো কাশীর চলমান শিবের সাক্ষাৎ পাননি! জানবেন কী করে? অতএব বিচারকের আদেশে সন্ন্যাসীকে নিক্ষেপ করা হল হাজতে। পরদিন ভোরবেলা তৈলঙ্গস্বামীকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট স্বয়ং হাজির হাজতের সামনে। কিন্তু এ কী! বন্দি যে দিব্যি হাজতের বাইরে বেরিয়ে বারান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
এদিকে গারদে ইয়া বড় বড় তালা ঝুলছে যেমন কে তেমন! রক্ষীদের যোগসাজশ? ম্যাজিস্ট্রেট কোনও ঝুঁকি নিলেন না। সন্ন্যাসীকে আবার হাজতে পুরে নিজের হাতে ফটকের লোহার দরজায় তালা লাগালেন। তারপর চাবি নিয়ে চলে গেলেন বিচারশালায়। এজলাসে বসামাত্র চক্ষু চড়কগাছ! আদালত কক্ষের এককোণে দাঁড়িয়ে সেই বিশালদেহী উলঙ্গ সন্ন্যাসী। পকেটে হাত দিয়ে সাহেব টের পেলেন, হাজতের চাবি যথাস্থানে মজুত।
কোন শক্তিতে তালাবন্ধ হাজত থেকে তৈলঙ্গস্বামী বেরিয়ে আসতেন? যোগীবর শ্যামাচরণ লাহিড়ীকে কেন একই সময়ে একাধিক জায়গায় দেখা যেত? কোন মন্ত্রবলে স্বামী বিশুদ্ধানন্দ সরস্বতী কাটা হাত জুড়ে দিতেন? রামঠাকুর কীভাবে অন্যের রোগ নিজের শরীরে টেনে নিতেন? সবই অষ্টসিদ্ধির মহিমা।
[আরও পড়ুন: বারাণসীতে খোঁজ মিলল ৪ হাজার বছরের পুরনো শিবলিঙ্গর]
সাধনার সোপান বেয়ে যোগী যতই উঁচুতে উঠতে থাকেন, তত একের পর এক সিদ্ধি তাঁর সেবায় নিযুক্ত হয়। কিন্তু কখনও নিজের ক্ষমতা জাহির করার জন্য যোগীরা এই সিদ্ধাইয়ের প্রয়োগ করেননি। ভক্তের আকুল ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে কখনও প্রকাশ হয়ে পড়েছে সিদ্ধাই। তৈলঙ্গস্বামীর ক্ষেত্রেও তা-ই। বাবাকে দাহ করে শ্মশান থেকে আর বাড়ি ফেরেননি শিবরাম (পূর্বাশ্রমে এই নাম ছিল তৈলঙ্গস্বামীর)। চিতার পাশে কুঁড়েঘর গড়ে বসবাস শুরু। তারপর একদিন গুরু ভগীরথস্বামীর কথায় পরিব্রাজনে বেরোলেন। বহু তীর্থ ঘুরে এলেন বারাণসী। তেলঙ্গ দেশ থেকে আগত বলে কাশীর মানুষের কাছে পরিচিত হলেন তৈলঙ্গস্বামী নামে।
ক্রমে কঠোর সাধনায় ও গুরুর কৃপায় তৈলঙ্গস্বামী হয়ে উঠলেন মহা শক্তিধর যোগসিদ্ধ পুরুষ। তাঁর বহু অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী বারাণসী। কিন্তু কখনও ক্ষমতা জাহির করতে নিজের অলৌকিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করেননি। প্রকৃত যোগীরা এমনই হন। কখনও অষ্টসিদ্ধিকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেন না। মানব কল্যাণে ব্যয় করেন। সেই ইংরেজ ম্যাজেস্ট্রট নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। ক্ষমা প্রার্থনা করে মুক্তি দিয়েছিলেন আত্মভোলা সন্ন্যাসীকে। তৈলঙ্গস্বামী শুধু মুচকি হেসেছিলেন। বলেছিলেন, “সাহেব, তুমি অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতো শুধু জড় ও জড়ের শক্তিই বোঝো। এই বিশ্ব সংসারেই জড়িয়ে আছে এক মহাচৈতন্যলোক। তার সঙ্গে যাঁর যোগাযোগ হয়েছে, কোনও বন্ধনই তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।’’
অষ্টসিদ্ধি আট প্রকার- অণিমা, লঘিমা, গরিমা, প্রাপ্তি, প্রাকাম্য, মহিমা বা কামাবসায়িতা, ঈশিত্ব বা ঈশিতা, বশিত্ব বা বশিতা। সিদ্ধ যোগীরা ইচ্ছা করলে অণুর মতো ক্ষুদ্র আকার ধারণ করতে পারেন, কিংবা বায়বীয় অবস্থায় চলে যেতে পারেন। এই সিদ্ধিকে বলে অনিমা। ইচ্ছেমতো হালকা হয়ে জলের উপর হেঁটে যেতে বা শূন্যে ঘুরে বেড়াতে পারেন। একে বলে লঘিমা। আর ভারী হওয়াকে বলে গরিমা। যে কোনও স্থান থেকে যা ইচ্ছা তাই পেতে পারেন। এই সিদ্ধি অর্জনকে বলে প্রাপ্তি। ‘প্রাকাম্য’ নামের সিদ্ধাইয়ের বলে যোগী চাইলে নিজের যে কোনও বাসনা পূরণ করতে পারেন। কেউ কেউ মর্জিমাফিক যে কোনও রূপ ধরতে পারেন। এই ধরনের সিদ্ধি অর্জনকে বলে মহিমা বা কামাবসায়িতা। যোগী চাইলে কোনও স্থানে যা খুশি সৃষ্টি করতে পারেন, চাইলে কোনও কিছু ধ্বংস করাও তাঁর হাতের মুঠোয়। এই সিদ্ধির নাম ঈশিতা। জড় উপাদানকে ইচ্ছা অনুসারে নিয়ন্ত্রণ, সৃষ্টির প্রতিটি জীবকে নিজের বশীভূত করাকে বলে বশিতা।
[আরও পড়ুন: ইয়েস ব্যাংকের গেরোয় পুরীর জগন্নাথদেবও, আটকে ৫৪৫ কোটি টাকার ফিক্সড ডিপোজিট]
অষ্টসিদ্ধি অর্জন সহজ নয়। চাই প্রবল কৃচ্ছসাধনস সঙ্গে উত্তুঙ্গ তপোবল। প্রথমে সদগুরুর আশ্রয়ে নিজেকে শুদ্ধ করতে হয়। দীক্ষাগ্রহণের পর গুরুর দেখানো পথে সাধনযাত্রা। নির্জন স্থান বেছে নিয়ে অভীষ্ট পূরণে কঠোর যোগাভ্যাস, তপস্যা।
কিন্তু পৃথিবীতে কিছু অসাধু যোগী আছেন, যাঁরা সিদ্ধাইয়ের নাম করে লোক ঠকানোর কারবারে নিয়েজিত। এঁদের কেউ হয়তো দৈবকৃপায় সিদ্ধির একটি অংশ লাভ করেছেন। তাই দেখিয়েই নিজের আখের গোছাচ্ছেন। আর আমরা সেই নকল বিভূতিতে বিভোর হয়ে ‘ভণ্ড’ যোগীদের ঈশ্বরের অবতার বলে ভাবতে শুরু করছি। মনে রাখতে হবে, প্রকৃত সাধক কোনও দিন নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করেন না। কোনও ভক্তের থেকে অর্থ দাবি করেন না। বরং মানবকল্যাণে নিজেকে উজাড় করে দেন। যেমন ছিলেন তৈলঙ্গস্বামী।
The post তালাবন্ধ হাজত থেকে বেরিয়ে এলেন নগ্ন সন্ন্যাসী, পড়ুন সাধকের অলৌকিক শক্তির কাহিনি appeared first on Sangbad Pratidin.