shono
Advertisement

আনন্দ ভৈরবী

রামকৃষ্ণকে পথ দেখিয়েছিলেন এক ভৈরবী।
Posted: 03:07 PM Feb 07, 2023Updated: 03:07 PM Feb 07, 2023

মহাসিদ্ধসার তন্ত্র অনুসারে, বিন্ধ্যপর্বতের পূর্বভাগে যে সমস্ত তন্ত্রপদ্ধতি প্রচলিত, তাদের ‘বিষ্ণুক্রান্তা’ বলে। শ্রীরামকৃষ্ণ তন্ত্রসাধনায় এক ভৈরবীকে ‘গুরু’ বলে বরণ করে নিয়েছিলেন। বিষ্ণুক্রান্তা-য় প্রচলিত ৬৪টি তন্ত্রর প্রতিটি সাধনপদ্ধতি রামকৃষ্ণকে দিয়ে একে-একে পালন করিয়েছিলেন সেই ভৈরবী, ও বীরভাবের সাধনমার্গে উত্তীর্ণ করিয়েছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি শ্রীরামকৃষ্ণর জন্মতিথি। লিখলেন দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত

Advertisement

গুরু ভৈরবী

রামকৃষ্ণকে ‘অবতার’ হিসাবে প্রমাণ করার পর মন্দির চৌহদ্দিতে শুধু রামকৃষ্ণরই নয়, ভৈরবী ব্রাহ্মণীর গুরুত্বও অনেকটা বেড়ে গেল। এখন থেকে তিনি আরও নির্বিঘ্নে রামকৃষ্ণ-পরবর্তী সাধনপথ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন। ‘পরবর্তী সাধন’, অর্থাৎ মূলত তন্ত্রসাধন।

সাধন অনুষ্ঠানের জন্য রামকৃষ্ণর হাতে তৈরি পঞ্চবটীর তলায় একটি বেদি নির্মিত হল– তার নিচে শিবা, সর্প, সারমেয়, বৃষ এবং মানুষের করোটি। বিশেষ কিছু অনুষ্ঠানের জন্য নির্জনতর বেলগাছের তলায় তৈরি করা হল আর-একটি বেদি, তার নিচে তিনটি নরমুন্ডি— ত্রিমুণ্ডাসন। ভৈরবীয় নির্দেশে রামকৃষ্ণ এই দুই আসনের ওপর ধ্যান, পুরশ্চরণ, জপ ইত্যাদিতে দিন-রাত কাটাতে লাগলেন। ভৈরবী দিনের বেলা নানা জায়গা ঘুরে ঘুরে শাস্ত্রোক্ত নানা দুষ্প্রাপ্য উপকরণ সংগ্রহ করতেন, রাত্রে দুই বেদির কোনও একটিতে সব আয়োজন সমাধা করে রামকৃষ্ণকে ডাক দিতেন। গভীর রাত অবধি চলত ক্রিয়াকর্ম। মাসের পর মাস কীভাবে কেটে যাচ্ছে, খেয়াল থাকত না দু’জনের কারও।

এই সময় রামকৃষ্ণর দর্শনের পর দর্শন, অনুভবের পর অনুভব। আর কঠিন কঠিন কত সাধন, যা করতে গিয়ে অধিকাংশ সাধক পথভ্রষ্ট হয়, মায়ের নাম করে অগ্রসর হয়ে রামকৃষ্ণ তার সবেতেই উত্তীর্ণ হন। কোনও সাধনে তিনদিনের বেশি আটকে থাকতে হয়নি তঁাকে।

একদিন ভৈরবী মড়ার খুলিতে মাছ রান্না করে তাই দিয়ে জগদম্বার তর্পণ করলেন, তারপর রামকৃষ্ণকেও তা করতে নির্দেশ দিলেন। রামকৃষ্ণ গুরুর আদেশ নির্দ্বিধায় পালন করলেন। নিজেই আশ্চর্য হলেন, কোনওরকম ঘৃণা হল না তো!কিন্তু প্রবল ঘৃণার উদয় হল তারপর একদিন। সেদিন ব্রাহ্মণী কঁাচা নরমাংসর টুকরো দিয়ে মায়ের তর্পণ করে প্রসাদ হিসাবে তা নিজের জিহ্বায় স্পর্শ করলেন। না, রামকৃষ্ণর পক্ষে এটা করা অসম্ভব। তিনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ভৈরবী মিষ্ট স্বরে বললেন, সে কী বাবা, এই দেখো আমি মুখে ছোঁয়াচ্ছি, ঘৃণা করতে নেই। কথা বলতে বলতে খানিকটা মাংস রামকৃষ্ণর মুখের সামনে ধরলেন।

রামকৃষ্ণ দেখলেন মা জগদম্বা যেন ভয়ংকরী চণ্ডিকা রূপে তঁার সামনে এসেছেন। ‘মা-মা’ ডাকতে ডাকতে রামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট হলেন। দেখলেন ভৈরবী তঁার মুখে মাংসর টুকরো প্রবেশ করালেন। তঁার আর কোনও বিকার হল না। মাঝে কয়েক দিনের জন্য এক অস্বাভাবিক খিদে পেতে লাগল রামকৃষ্ণর। যতই খাচ্ছেন, পেট
কিছুতেই যেন ভরছে না। এই খেয়ে উঠছেন, আবার তখনই খাবার ইচ্ছা! দিন-রাত্তির কেবল খাই খাই। এ আবার কী ব্যারাম হল! চিন্তিত রামকৃষ্ণকে ভৈরবী আশ্বস্ত করেন– বাবা, ভয় নেই, ঈশ্বরপথে এগতে গেলে ওরকম অবস্থা কখনও কখনও হয়ে থাকে, শাস্ত্রে এমন কথা আছে। আমি তোমার ওটা ভাল করে দিচ্ছি।

মথুরবাবুকে বলে ঘরের ভেতর চিঁড়ে-মুড়কি থেকে রসগোল্লা, সন্দেশ, লুচি ইত্যাদি হরেক খাবার থরে থরে সাজিয়ে রাখা হল। ভৈরবী বললেন, বাবা, তুমি এই ঘরে দিন-রাত্তির থাকো আর যখন যা ইচ্ছা হবে, তখনই তা খাও। রামকৃষ্ণ সেই ঘরে থাকেন, ঘুরে বেড়ান, খাবারগুলো দেখেন, নাড়েন চাড়েন, এটা থেকে খানিক খান, ওটা থেকে খানিক খান। তিনদিনের মধ্যে দেখা গেল, সত্যিই অমন অদ্ভুত খাওয়ার ইচ্ছা চলে গেল।

মহাসিদ্ধসার তন্ত্র অনুসারে ভারতের বিন্ধ্যপর্বতের পূর্বভাগে যে সমস্ত তন্ত্রপদ্ধতি প্রচলিত, তাদের ‘বিষ্ণুক্রান্তা’ বলে। ভৈরবী বিষ্ণুক্রান্তায় প্রচলিত ৬৪টি তন্ত্রর সবক’টি সাধনপদ্ধতি রামকৃষ্ণকে দিয়ে একে-একে অনুষ্ঠান করিয়েছিলেন। বৈষ্ণবের যেমন পুরাণ মত, শাক্তর তেমন তন্ত্র। বৈষ্ণব যা সাধন করে, তা প্রকাশে দোষ নেই। কিন্তু তান্ত্রিকের অনেকটাই গোপন, তাকে সবটা বোঝা দুষ্কর।

তুমি সিদ্ধ

একদিন রাত্রে পুজোর সব উপচার গুছিয়ে ভৈরবী ডাক দিলেন তঁার শিষ্যকে। রামকৃষ্ণ এসে দেখেন পূজাস্থলে ভৈরবীর পাশে আর-এক স্ত্রীলোক– এক পূর্ণযৌবনা সুন্দরী। রামকৃষ্ণ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভৈরবী সেই মেয়েটির শরীর থেকে একে-একে সব আবরণ সরিয়ে নিলেন, তঁাকে বসালেন দেবীর আসনে। তারপর রামকৃষ্ণকে বললেন, বাবা, এঁকে দেবীবুদ্ধিতে পুজো করো।

রামকৃষ্ণ স্থিরচিত্তে যথাবিহিত পূজা সম্পন্ন করলে এল কঠিনতর নির্দেশ, বাবা, জগজ্জননী মনে করে এঁর কোলে বসে একমনে জপ করো।

রামকৃষ্ণ আতঙ্কে কেঁপে উঠলেন। তিনি মা জগদম্বাকে স্মরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন, মা, তোর শরণাগতকে এ কী আদেশ করছিস? দুর্বল সন্তানের পক্ষে এমন দুঃসাহস দেখানো কি সম্ভব?

কিন্তু কোথায় দুর্বল? রামকৃষ্ণ অনুভব করলেন, তাঁর মধ্যে যেন এক দিব্যবলের সঞ্চার হয়েছে। আবিষ্ট রামকৃষ্ণ মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে সেই নগ্নিকার ক্রোড়ে গিয়ে বসলেন এবং মুহূর্তে সমাধিস্থ হলেন।

জ্ঞান ফিরল ভৈরবীর ডাকে, ক্রিয়া পূর্ণ হয়েছে, বাবা; অন্য লোকে এই অবস্থায় কিছুকাল মাত্র জপ করতে পারে, আর তুমি শরীরবোধের ঊর্ধ্বে উঠে সমাধিস্থ হয়েছ। রামকৃষ্ণ স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। গভীর কৃতজ্ঞতায় বারবার মা জগদম্বাকে প্রণাম জানালেন।

বস্তুত, রামকৃষ্ণ বুঝতে পারেন, মা কালীর উপর তঁার এই অচলা ভরসা, তঁার এই সন্তানভাব, সকল রমণীর প্রতি তঁার এই মাতৃবোধই তঁাকে একের পর এক কঠিন, ভয়ংকর বিপদসংকুল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করে দিয়েছে।
অচলানন্দ রামকৃষ্ণর এই সন্তানভাবে তন্ত্রসাধনাকে স্বীকার করতে চাইতেন না। সেই সময় ভৈরবীর প্রশ্রয়ে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে অনেক তান্ত্রিক আসতেন, কিছুদিন করে থাকতেন। রামকৃষ্ণ তঁাদের জন্য আলাদা করে কারণবারি, চালভাজা, ছোলা, কঁাচালঙ্কা জোগাড় করে রাখতেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম কালীঘাটের অচলানন্দ তীর্থাবধূত। তিনি প্রায়শই আসতেন, কারণ পান করে একটুও মাতাল না-হয়ে স্থির বসে গম্ভীর মুখে জপধ্যান করতেন। তিনি জেদ করে রামকৃষ্ণকে বলতেন, স্ত্রীলোক লয়ে বীরভাবে সাধন তুমি কেন মানবে না?

এমন তান্ত্রিকদের চক্রে উপস্থিত থাকলেও রামকৃষ্ণ কারণপান করতেন না, আঙুলের ডগায় কারণ নিয়ে কপালে ফোঁটা কেটে আলোচনায় যোগ দিতেন। অচলানন্দর অভিযোগ শুনে তিনি বালকের সারল্যে বলতেন– কে জানে বাপু, আমার ওসব কিছুই ভাল লাগে না, আমার সন্তানভাব।

এই ভাবের বশেই রামকৃষ্ণ তঁার তন্ত্রসাধনের অনেক বিপজ্জনক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছেন, কাম জয় করতে পেরেছেন। কখনও এমন হয়েছে, দিশেহারা রামকৃষ্ণ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে মাকে আহ্বান করেছেন, উচ্চৈঃস্বরে ‘জয় কালী, জয় কালী’ বলতে বলতে আনন্দ আসনকে বারবার প্রদক্ষিণ করেছেন, মায়ের জপধ্যানে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছেন।

সেদিন যেমন। সেদিন ভৈরবী রামকৃষ্ণকে দেখালেন সম্ভোগরত নারী-পুরুষ, বললেন ওদের সামনে সংযত হয়ে জপ করতে হবে। রামকৃষ্ণ কালী মায়ের শরণ নিলেন, স্মরণ করলেন তঁাকেই। তঁার মনে হল, তিনি যেন শিব ও শক্তির লীলাবিলাস প্রত্যক্ষ করছেন। অলৌকিক আনন্দে আবিষ্ট হলেন তিনি। সমাধিস্থ হলেন।
চেতনে ফিরলে রামকৃষ্ণ ভৈরবীর গলা শুনলেন, বাবা, তুমি আনন্দ আসনে সিদ্ধ হয়ে দিব্যভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে, এটিই বীরভাবের শেষ সাধন!

কয়েক দিন পর এক সকালে কালীঘরের নাটমন্দিরে ভৈরবী রামকৃষ্ণকে দিয়ে সবার সামনে কুলাগার পূজা করিয়ে বীরভাবের সাধন যথাবিধি সম্পূর্ণ করালেন। রামকৃষ্ণ ভক্তিভাবে পঁাচ সিকে গুরুদক্ষিণা দিলেন। নিশ্চিন্ত হয়ে পঞ্চবটী এবং বেলতলার বেদি দু’টি ভেঙে নরমুণ্ড এবং কঙ্কালগুলি গঙ্গায় ছুড়ে ফেললেন।
(মতামত নিজস্ব)

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement